(৪)
স্মৃতির পাতা থেকে – কামারগ্রাম কান্ঞ্চন একাডেমী
৯ম ও ১০ম শ্রেণী ( ১৯৬৯- ১৯৭০ ).
জহুরুল হক ।
মানুষের জীবনের গতিপ্রকৃতির একমাত্র পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা । তা না হলে জীবনের এতবৈচিত্রে আসে কোথ্ থেকে ?
৮ম শ্রেণী পাস করে জয়নগর হাই স্কুল ত্যাগ করে বাড়িতে এসে ভাবছি কি করব ? এদিকে জাফর ভাই বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ৮ ম শ্রেণীতে বানা এম এ মজিদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেয়েছে । তার উপর পরিবার , বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এলাকার মানুষের ভালোবাসা বহুগুণে বেড়ে চলেছে ।
আবার সে জয়নগর হাই স্কুলে চলে যাবে এ সিদ্ধান্তে অটল এবং স্কুল খুললে ভর্তি হবে । অপরদিকে আমার অবস্হান তলানিতে এসে ঠেকেছে । বাড়িতে ফিরে বানা এম এ মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠরত পুরোনো বন্ধুদের সাথে মিলিত হলাম । তবে বানা এম এ মজিদ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা একেবারে নেই ।
বন্ধুরা অনেকেই এ স্কুল থেকে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করছে । তন্মধ্যে বেল বায়নার হাফিজ , মান্নান ও রুদ্রবানার আক্কাছ , হাবিবুর অন্যতম ।
ইতিমধ্যে আমি জয়নগর থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি এবং transfer certificate ও আমার সাথে আছে বরাবর আমার কাশিয়ানী হাই স্কুলের প্রতি দুর্বলতা ছিল ।
কাশিয়ানীর খারাট এর জলকাপাড় রশীদ মিয়ারা আমাদের আত্মীয় । একদিন কাউকে না জানিয়ে ওখানে বেড়াতে চলে গেলাম । আমার ছোট চাচা মোসলেম মিয়া এ বাড়িতে থেকে কাশিয়ানী হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন ।
ওখানে যেয়ে ছকুর সাথে পরিচয় হলো । দক্ষিণ মালার সাবু খান এর ফুফু বাড়ি আমাদের রুদ্রবানা গ্রামে । মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত মোল্লা তার ফুফাতো ভাই । সাবু খান ঘন ঘন বানা এলাকায় আসা যাওয়া করত ।
সাবু খানের ফুফাতো ভাই কালাম মোল্লার মাধ্যমে তার সাথে আমার পরিচয় হয় । এক সময় তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । আমি তাদের বাড়িতে ২/৩ দিন কাটালাম । কিন্তু এখানে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করা গেল না ।
আমি যা কিছু করছি তা নিজে নিজে । আমাকে নির্দেশনা দেয়ার মতো পিছনে কেউ ছিল না । আমি তখন সবেমাত্র ১৫ বছরে পা দিয়েছি । হাফিজ এর বড় বোনের বাড়ি কামারগ্রাম। মুনশী বাড়ির আকতার মুনশী তার ভগ্নিপতি ।
হাফিজ বললো চল কামারগ্রাম কান্ঞ্চন একাডেমীতে ভর্তি হই। সহপাঠী আক্কাছ এরও একই সিদ্ধান্ত । আমার ২ জন স্কুল বন্ধু জুটে গেল । আবার গোলাম সারোয়ার এর ভাই সিদ্দিক কাকা কামারগ্রাম মেয়ে দেখেছে নজরুল সাহেব এর বোনকে। সেখানে সিদ্দিক কাকার বিয়ে পাকাপাকি হতে চলেছে ।
এসব ঘটনাপ্রবাহ আমাকে কামারগ্রাম স্কুলে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করে । ইতিমধ্যে জানতে পারলাম খোলাবাডিয়া নিবাসী মালেক মাস্টার কামারগ্রাম স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ।
রুদ্রবানা লুৎফর দরজীর ভাই বাকু মিয়া মালেক মাস্টার এর পাশে বাড়ী জাপান এর বোনকে বিয়ে করেছেন। একদিন ঐ বাড়িতে গেলাম এবং স্যার এর সাথে দেখা করলাম ।
স্যার বললেন ঠিক আছে । কামারগ্রাম পড়তে পার অনেক ছাত্র ছাত্রী এখান থেকে হেঁটে ও বাইসাইকেলে করে এ স্কুলে পড়ে । স্যার এর মেয়ে ছকিনা ও ছেলে সিদ্দিক ( বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ) এ স্কুলের ছাত্র ।
শেষমেষ সিদ্ধান্ত হলো কামারগ্রাম কান্ঞ্চন একাডেমীতে ভর্তি হব ৯ ম শ্রেণীতে মানবিক বিভাগে । কারন , আমি অংকে একেবারেই কাঁচা ছিলাম ।
কামারগ্রাম আমাদের বাড়ি হতে ৫ মাইল দূরে অবস্থিত । স্কুলে যাওয়ার দুইটা পথ ছিল। এক , বেড়ি দিয়ে বানা , খোলাবাড়িয়া, দিগনগর , পাড়াগ্রাম, হেলেঞ্চাহাটি , কুঁচিয়াগ্রাম, পাকিস্তানের হাট , চানড়া হয়ে কামারগ্রাম ।
দুই , বানা , খোলাবাড়িয়া , দিগনগর মধুমতি নদী পাড় দিয়ে কালতাশুর , খোলা মাঠ , চানড়া বেড়ি বাঁধ হয়ে গোপালপুর , কামারগ্রাম ।
প্রথম দিনের কথা মনে আছে । আমি বাড়ি হতে সরাসরি হাফিজকে নিয়ে মধুমতি নদীর পাড় দিয়ে চানড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কোনাকুনি মেঠো পথ ধরে কামারগ্রাম স্কুলে পৌঁছে গেলাম ।
হেঁটে যেতে কষ্ট হয়েছিল । স্কুলে যেয়ে সরাসরি মালেক স্যার এর সাথে দেখা করলাম । তিনি ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন । আমাকে ডেকে সব স্যার এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।
স্কুলের মৌলভী সাহেব আমাকে কাছে ডাকলেন । আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন । আমি হুজুর কে বললাম আমি ছোট মানুষ । বানা বাড়ি ।এতদূর থেকে পায়ে হেঁটে আসতে পারব না ।
তাছাড়া লম্বায় ছোট হওযায় বাইসাইকেল চালাতে কষ্ট হয় । তিনি অত্যন্ত স্নেহের সাথে বললেন চিন্তা কর না । দেখি তোমার জন্য কি করতে পারি ? তিনি বললেন তোমার এসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার আমাকে সব বলেছেন ।
তিনি বললেন আগামী বৃহস্পতিবার স্কুলে আসবে । এদিন তোমার থাকার ব্যাপারে কথা হবে । তখন ক্লাস শুরু হয়নি । ভর্তি চলছে বিভিন্ন ক্লাসে । তবু স্কুলে খেলাধুলা চলছে । মাঠে ক্রিকেট
খেলা হচ্ছে দেখলাম । হাফিজ ও ভর্তি হয়ে গেল । তার বোনের বাড়ি কামারগ্রাম হওযায় তার থাকার চিন্তা নাই । আকাচ্ছ ও ভর্তি হল ।
ভর্তির পালা শেষ হলো । এবার থাকা ও লেখাপড়া করার পালা । হুজুরের কথামতো বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটির পর শিক্ষক রুমে হুজুরের সাথে দেখা করলাম । উনি স্নেহের সাথে কাছে ডাকলেন । হুজুরের সামনে একটি লোক বসা ছিল ।
তাঁকে সম্বোধন করে বললেন সভাপতি সাহেব এই ছেলেটি দ্যাখেন ! আপনাকে এ ছেলেটি দিতে চাই । ছেলেটির বাড়ি অনেক দূর । এত ছোট মানুষ দূর পথ থেকে ক্লাস করতে পারবে না । পড়াশোনা ও হবে না ।
বাইসাইকেল ও চালাতে পারে না । লম্বায় ছোট । সভাপতি সাহেব আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কুশলাদি বিনিময় করলেন । এরপর হুজুর বললেন এখন যাও । ২/১ দিন পর আমার সাথে দেখা করো । কেমন ?
হুজুরের কথামতো ২ দিন পর দেখা করলাম । হুজুর বললেন হ্যা! সভাপতি সাহেব তাঁর নিজের বাড়িতে তোমাকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন । বাড়িতে সকলের সাথে আলাপ করে জানিয়ে গেছেন । হুজুর বললেন , তুমি কবে আসতে চাও ? আমি বললাম আপনি যে দিন বলবেন । এভাবে খান সাহেবের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল ।
তখন কামারগ্রাম কান্ঞ্চন একাডেমীর সভাপতি ছিলেন কামারগ্রাম এর লেবন খান সাহেব । সকলে তাঁকে খান সাহেব বলে ডাকতেন । খান সাহেব অনেক সম্মানীয় মানুষ ছিলেন । তখনকার দিনে এ এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ।
যাকে গ্রামের পরিভাষায় মোড়ল বলে থাকে ।
এ প্রভাবশালী ব্যক্তির কিছু পরিচয় তুলে ধরা দরকার । তাহলে এ এলাকার সুনাম ও উন্নতির একটা চিত্র পাওয়া যাবে । কাঞ্চন মুনশীর পর উনারা হচ্ছেন যোগ্য উত্তরসূরী ।
খান সাহেবরা দুই ভাই ছিলেন । তন্মধ্যে খান সাহেব বড় । উনার ৩ ছেলে । ২ স্ত্রী । সানা , বকুল ও ধলা ছেলেদের ডাকনাম । কনিষ্ঠ স্ত্রীর ১ মেয়ে ছিল । এ মেয়েকে তিনি চানড়া গ্রামের বীরবিক্রম মান্নান সাহেবের সাথে বিবাহ দেন ।
ছোট ভাইয়ের নাম ছিল সাঈদ খান । ছেলেমেয়েদের নাম শাহাদাত , হেমায়েত , ফিরোজা , এনায়েত , ইরানী , বিলায়েত , সাফায়েত । এ পরিবারের সকলে শিক্ষিত । এ পরিবারের সদস্য হচ্ছেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খান বিলায়েত হোসেন । এ পরিবারের সকলে লেখাপড়া করে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত আছেন ।
খান সাহেব এ এলাকার গুনী ও সুধীজনের সাথে চলাফেরা করতেন । প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাঞ্চন মুনশী যার নামে কামারগ্রাম স্কুল নামকরণ করা হয়েছে তাঁর বড় ছেলে বজলু মুনশী এবং ঐ বাড়ির আতিয়ার মুনশী চা পর্বে এ বাড়িতে আসতেন । আমি নিজে এ বাড়ির বাসিন্দা থাকায় তাদের চা
চক্র অবলোকন করার সুযোগ হয়েছে । মাঝে মাঝে উনারা সকলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমাকে ডাকাডাকি করতেন ।
সে কথা মনে করে আজ নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় । আমার জীবনে এধরনের গুনী জনের সাক্ষাৎ আর পাইনি । এ বাড়ির খাওয়া দাওয়ার সাথে অন্য কোনো বাড়ির তুলোনা হতো না । তখনকার দিনে কোন বাড়িতে আপ্যায়ন ব্যবস্হাকে বিশেষ সম্মানের সাথে দেখা হতো ।
খান সাহেব সপ্তাহে ২ দিন গোপালপুর ও পাকিস্তানের হাটে যেতেন । সাথে উনার নাতী নাতনি জামান, চামেলি ও আমাকে থাকতে হতো । ৩ জনকে বাজার বয়ে আনতে হতো ।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আস্তে আস্তে নতুন সহপাঠীদের সাথে পরিচয় হতে শুরু হলো । বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষককের বাড়ি খোলাবাড়িয়া ও পন্ডিত সুরেন্দ্র বাবুর বাড়ি দিগনগর হওযায় কামারগ্রাম স্কুলের উত্তরে অবস্থিত সকল গ্রামের ছেলে মেয়েরা এ স্কুলে পড়াশোনা করত । এদের উত্তরের ছেলে মেয়ে বলা হতো ।
উত্তরের maximum ছেলেমেয়েরা ভালো ছাত্র ছাত্রী ছিল । আমি এ স্কুলে ভর্তি না হলে তা জানতে পারতাম না ।
এটা মনে হয় সারা জীবন আমার অজানাই থেকে যেত । ভর্তি হয়েই পরিচয় হলো সুলতান , দিগনর এর সিদ্দিক , বারু ( অবসর প্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রার ) , বারিক (অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ ক্যাডেট কলেজ) , খিজির আহমেদ (অবসর প্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) , সিদ্দিক (অবসর প্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ) , মোক্তার , মুহাম্মদ , ছাতিয়ারগাতির জহুর এরা সকলে কামারগ্রাম স্কুলের উত্তরের ছাত্র । এঁরা দল বেঁধে স্কুলে আসে আবার স্কুল ছুটি হলে দল বেঁধে বাড়ি চলে যায় ।
সকাল ৮ টা বাজলে দেখা যেতো উত্তরের ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে বেড়ি ও নদীর তীর দিয়ে কামারগ্রাম স্কুলে বই হাতে করে পড়তে যাচ্ছে । আবার বিকেল হলেই একই দৃশ্য চোখে পড়তো । এতদিন পর ও সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে । আহা ! কি সুন্দর ! ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য দীর্ঘ পথ চলা !
খুব অল্প দিনের মধ্যে কামারগ্রাম এর চরের রাজ্জাক , মবু , আহমদ , মোস্তফা ভাই , জাপান ভাই , মিজান ভাই , আজাদ ভাই , ক্যাপ্টেন নিলু এবং খোকা ভাই , খোকন ভাই , বালাম ভাই ( দোলন এর বাবা ) , হিমু , শিমু , মিন্টু ( আসাদুজ্জামান মিয়া ডিএমপি কমিশনার ) , ফারুক , নজরুল ভাই এদের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাছাড়া , গোপালপুর এর মফিদুল , কুদ্দুস, বাহার ( বর্তমান আলফাডাঙ্গা কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি ), আলমগীর , টূনু (সাংবাদিক ও লেখক ) , ওমর ( পানাইল ) এরা আমার প্রিয়ভাজন হয়ে পড়লো ।
এর একমাত্র কারণ আমি এ এলাকার সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তিদের সহচারযে আসতে পেরেছিলাম ।
অত্যন্ত প্রতিশয়তা শিক্ষকরা এখানে শিক্ষকতা করতেন । জনাব রওশন আলম প্রধান শিক্ষক , জনাব মালেক মিয়া সহকারী প্রধান শিক্ষক , পন্ডিত স্যার বাবু সুরেন্দ্র কুমার , Game Teacher কওসার মুনশী , জিল্লুর রহমান , অমল বাবু , পাঙ্খারচর এর মৌলভী হুজুর , কেরানি আবজু মুনশী । তন্মধ্যে প্রধান শিক্ষক অনেক রাশভারী মানুষ ছিলেন ।
তিনি কাঞ্চন মুনশীর জামাতা ছিলেন । আমার সাথে কোনোদিন কথা হয়নি । স্কুল চালাতেন বলতে গেলে সহকারী প্রধান শিক্ষক মালেক মিয়া । তিনি উত্তর এর ছেলে মেয়েদের নিয়ে গর্ব করতেন । তার একমাত্র কারণ ছিল উত্তর এর ছেলে মেয়েরা পরীক্ষায় ভালো result করত।
এখানে নতুন পরিবেশে লেখাপড়া শুরু হয়ে গেল । এ বাড়িতে সবাই ছাএ ।ধলা ভাইজান বিএ , শাহাদাত ভাই আই এস সি , হেমায়েত ভাই আই এ , ফিরোজা ৮ম শ্রেণী , এনায়েত , ইরানী , বিলায়েত , চামেলি , জামান , আরিফ, লিলি,লাকি এরা নিচের শ্রেণীতে পড়ে।
আমি ও তাদের মধ্যে একজন ছাত্র। এ বাড়িতে এনায়েত বয়সে সমসাময়িক হওয়ায় আমার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সব সময় একসাথে থাকতাম । এনায়েত সাধারণত
লেখাপড়া করতে চাইতো না ।
লেখাপড়া আর লেখাপড়া । ৯ম শ্রেণীতে ভালো ফলাফল হতে লাগলো । স্কুল সহপাঠীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হতে লাগলো। হাফিজ আকাচছ বাল্যবন্ধু। বারু মিয়ার মামা বাড়ি ও একমাত্র ভগ্নিপতির বাড়ি কামারগ্রাম । আর হাফিজ এর বড় বোনের বাড়ি কামারগ্রাম হওয়ায় বারু মিয়ার সাথে আমার আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে ।
প্রথম বছর ১৯৬৯ সাল ভালো কাটলো । ভালো পড়াশোনা হচ্ছে । বাড়ি যেতে পারছি যখন তখন। এখান থেকে বাড়ি কাছে । মা বাবা ও খুশি । ৯ম শ্রেণীতে ভালো ফলাফল নিয়ে উর্ত্তীণ হলাম। সুলতান ও সিদ্দিক first boy Second boy হলো।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (১৯৬৯) :
গ্রামে আমাদের অবস্থান হওয়ায় আমরা তেমন টের পাইনি । দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। ঢাকা সহ সব জায়গাতেই আন্দোলন হচ্ছে । গ্রামের বাড়িতে যেয়ে দেখলাম বানা বাজারে বিদ্যালয়ের মাঠে মিটিং হচ্ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন । পিডিপির এডভোকেট সালাম খান বক্তৃতা দেয়ার সময় তার মাইকের তার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ।
এ নিয়ে জটলা পাকাপাকি হচ্ছে। আমার ছোট চাচা মোসলেম উদ্দিন মিয়া আমার মেজ কাকার ঔষধের দোকানে পিডিপির সালাম খান এর সাথে কথা বলছেন ।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে হারড্রিজ ব্রীজ পরিদর্শন :
১৯৭০ সাল । ১০ম শ্রেণীতে উঠে আরো বেশি লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়লাম । কারন, আগামী বছরে এস সি পরীক্ষা । সব subject গুলো ভালো করে পড়ছি । পূর্বেই বলেছি পাকিস্তানে স্বাধীনতা দিবস অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হতো ।
এ বছর সরকার থেকে বিশেষ নির্দেশ আসছে ভালো করে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে হবে । অন্যান্য অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বাড়তি আয়োজন আমাদের স্কুলে নাটক হবে । সে নাটকে আমাকে অভিনয় করতে হবে । কিন্তু আমার অভিনয় ভালো লাগে না। তবুও রিহার্সাল দিলাম। রিহার্সাল বন্ধ করে কি জানি কি মনে করে বন্ধু রাজ্জাক ও বারু এর সাথে যুক্তি করলাম স্বাধীনতা দিবসে পাকশী হারড্রিজ ব্রীজ দেখতে যাব ।
এ উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সালের ১৩ই আগস্ট দুপুরে স্কুল থেকে পালিয়ে এলাম । এসে ফিরোজা কে বললাম তুমি আমাকে খাবার দাও । ও বাড়িতে এখনো রান্না হয়নি । ফিরোজা আমাকে খাবার দিল । বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আমরা তিন বন্ধু সহস্রাইল স্টশনে চলে গেলাম । ওখান থেকে ট্রেনে কালুখালী । কালুখালী হতে পোড়াদহ ।
পোড়াদহ থেকে পাকশী হারড্রিজ ব্রীজ । সকালে যেয়ে পাকশী পৌঁছিলাম । কিন্তু বিধি বাম। কিছুতেই ব্রীজের উপর বেড়াতে যেতে দিবে না । পুলিশ পাহারায় আছে । দেশে এবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে স্বাধীনতা দিবসে হারড্রিজ ব্রীজ পরিদর্শন বন্ধ । বসে বসে তিন বন্ধু অনেক ভাবলাম ।
একটা উপায় বের করতে হবে । শেষে তিনজন মিলে একসাথে পুলিশের কাছে সবকিছু খুলে বললাম । অবশেষে পুলিশ রাজি হয়ে গেল । শুধুমাত্র আমাদের তিনজনের permission দিল । এরপর সারাদিন ব্রিজে থাকলাম। এরমধ্যে কয়েক বার ট্রেন যাওয়া আসা করলো । ট্রেন উপরে আমরা নিচে । কি যে সুন্দর শব্দ !. রেল গাড়ী ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম । ওখানে নিচে শিকল লাগানো বালতি ছিল। বালতি গুলো লাল রং করা । পানি তুললাম । পদ্মায় অনেক পানি । বর্ষাকাল । ভীষণ স্রোত । জেলে মাঝিরা পালের নৌকা করে ইলিশ মাছ ধরছে । আর ঝড়ের বেগে বাতাস।
খুব মজা ও আনন্দ হলো । খিদে লেগেছে । খাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলাম । বিকেল বেলা আবার পাকশী থেকে পোড়াদহ। পোড়াদহ হতে কালুখালী । কালুখালী হতে ভাটিয়াপাড়া লাইনে সহস্রাইল স্টশনে । আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল ।
মন ভরে পাকশী হারড্রিজ ব্রীজ দেখা হলো যা ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা তৈরি করে গেছে ।
রাতে নাটক মঞ্চস্থ হবে । যা রিহার্সাল করা ছিল সেভাবে উপস্থাপনা হলো । তবে খারাপ হয়েছিল না । একটা সংলাপ ছিল মা বলে জড়িয়ে ধরা । যা দেখে সকল দর্শক হাততালি দিয়েছিল ।
তবে বিপত্তি হলো খান বাড়িতে । কেন কাউকে না বলে একটা দিন বাইরে কাটিয়ে এলাম ! কেন বা পাকশী গিয়েছিলাম ?
Pre Test ও Test পরীক্ষা : সারা বছর ভালো পড়াশোনা হয়েছে । অমল স্যার আমার পড়ালেখায় বেশি সন্তুষ্ট ও আশাবাদী । নভেম্বর মাসে পরীক্ষা হলো ।
Test পরীক্ষার ফলাফলে আমি সন্তুষ্ট। আমি ১ম ও ২য় হওয়ার মতো ছাত্র ছিলাম না কখনো । তবে ভালো preparation হয়েছে । এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে প্রথম বিভাগে অবশ্যই পাশ করব । এভাবে ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর পড়া শেষ হলো । আগামী বছর ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে এস এস সি পরীক্ষা শুরু হবে ।
এখন অপেক্ষা ও পরীক্ষা দেওয়ার পালা । বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও আমাদের (১৯৬৯ – ১৯৭০) লেখাপড়া :
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন । তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল আকার ধারণ করে ।
কিন্তু আমাদের গ্রাম্য এলাকায় এ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে লেখা পড়ার কোনো ক্ষতি হয় নাই ।
১৯৭০ সালে এমএনএ ও এমএলএ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । আমাদের এলাকায় পিডিপি এর সালাম খান নির্বাচন করেন । আর আওয়ামী লীগ থেকে ডাক্তার আফতাব উদ্দিন নির্বাচন করেন।
জনাব আফতাব ও ব্যারিষ্টার সালাউদ্দিন নির্বাচনে বিজয়ী হন । উক্ত এমএলএ ও এমএনএ নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ।