1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৪ অপরাহ্ন

স্মৃতির পাতা থেকে :প্রথম শ্রেণী হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত (১৯৬১ – ১৯৬৫ ) ।

  • সময় সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০২১
  • ১১৩০ বার দেখা হয়েছে
স্মৃতির পাতা থেকে :
প্রথম শ্রেণী হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত (১৯৬১ – ১৯৬৫ ) ।
জহুরুল হক ।
১৯৫৫ সালের ২১ শে মে আমার জন্ম । আমি মা বাবার তৃতীয় সন্তান ।
জাফর ভাই আমার চেয়ে ৩ বছরের বড় । এই ২ ভাই একত্রে বেল বায়না ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলাম ১৯৬১ সনে । তখন ছেলেমেয়েরা একটু বয়স হলে স্কুলে যেতো ।
কেননা , বাবা মা সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি কোনো তাগিদ ছিল না । কিন্তু আমাদের বাড়িতে ভিন্ন পরিবেশ বিদ্যমান ছিল । বাবা লেখাপড়ার প্রতি যত না অনুরাগী ছিল । মা ছিল ঠিক তার উল্টো ও ভিন্ন প্রকৃতির । উনি গ্রামের মেয়ে । হাদী বাড়ির ।
সবাই এ বাড়িকে কুঠিবাড়ি বলতেন । কারন , এখানে এ পাড়াতে ইংরেজদের কুঠি ছিল । নীল কুঠি । ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা নীলের চাষ করতো । আমি ছোটবেলায় কুঠির চারপাশে যে পুকুর কেটে মাঝখানে কুঠি নির্মাণ করা হয়েছিল তার ধ্বংসাবশেষ আমি স্বচোখে দেখেছি । সারা বছর কুঠির চারপাশে পানি থাকতো ।
মার বাবার বাড়িতে নানার পদবী ছিল মুনশী । নাম মালেক মুনশী । মালেক মুনশী ধর্ম কর্মের পাশাপাশি দরজী কাজ করতেন । এক মেয়ে এক ছেলে থাকায় তিনি মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করেন । আমার দাদার নামও মালেক সেখ । তিনি মুনশীকে খুব পছন্দ করতেন । এভাবে বন্ধুর মেয়ের সাথে বড় ছেলে ছঈদ সেখের বিবাহ হয় ‌ । যিনি আমার বাবা । আমার মার নাম চাঁন বিবি ।
মায়ের মামা বাড়ি চর কঠুরাকান্দি ছিল। তাঁরা খুব ধার্মিক পরিবার ছিলেন । মার মামারা আমাদের বাড়িতে খুব যাতায়াত করতেন। মা ধার্মিক পরিবার এর মেয়ে হওয়ায় মা ধর্মীয় আচার আচরণ ও লেখাপড়ার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন ‌ । আমরা ধর্মীয় শিক্ষা মার কাছ থেকে পেয়েছি ‌ । মক্তবে পড়ি নাই । আজ এ কথা মনে পড়ে ” আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও আমি একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দিব ” ।
মায়ের অসীম আগ্রহে প্রথম ছেলে চাঁন মিঞা ওরফে এডভোকেট শামসুল আলম কে যশোর এর ঝামা মাদ্রাসা ও আমাদের ২ জনকে বেল বায়না ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করা হয় ।
তখন মুহাম্মদ মাস্টার বেল বায়না প্রাইমারী স্কুলের একমাত্র শিক্ষক ছিলেন । কারন , এ স্কুল বেল বায়না রায় বংশের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার উদ্দ্যশ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল । পরবর্তীতে সকলে এ স্কুলে সকল বর্ণের মানুষের সন্তান পড়ালেখার সুযোগ পায় । মুহাম্মদ মাস্টার হচ্ছেন রুদ্র বানা নিবাসী লুৎফর দরজীর বাবা ।
মুহাম্মদ মাস্টার বৃদ্ধ ও চাকরি করার ক্ষমতা না থাকায় স্কুলে নতুন শিক্ষকের আগমন ঘটে । ইতিমধ্যে এসব স্কুল সরকারীকরণ হয়ে যায় । হেলেঞ্চা গ্রামের লতিফ মাস্টার এ স্কুলের হেড মাস্টার এবং রুদ্র বানা গ্রামের হাদী হাই মিয়া এ স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ।
শুরু হয় লেখাপড়া নতুন আঙ্গিকে । কারন , এরা ২ জন খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন । আমি মুহাম্মদ মাস্টার , লতিফ মিয়া ও হাই মিয়া এই তিনজন শিক্ষকের ছাত্র । স্কুলের পরিবেশ খুব নাজুক ছিল ‌ । একটা মাঠ ছিল । একটা টিনের ঘর ছিল । কোনো বেঞ্চ ছিল না । কাঠের তক্তা দিয়ে বেঞ্চ তৈরি ছিল । তাও ভাঙ্গা পায়া । সেখানে গাদা গাদি করে বসতাম । যার শক্তি থাকতো সে ঠেলেঠুলে বসতো এবং অন্যজনকে বসতে দিত না । খেজুরের পাটিতে বসতে হতো । তালপাতা ও দোয়াত কালির কলম দিয়ে লিখতে হতো ।
প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও আদর্শ লিপি পড়তে হতো ।
করা, খলা, ঘটা, ধন , জন , ঝটা প্রথম ভাগের পড়া ছিল যা স্মৃতিতে রয়েছে ।
দ্বিতীয় ভাগে ঐক্য, বাক্য , মাণিক্য, মূখ্য, অখ্যাতি, উপাখ্যান , ভাগ্য , যোগ্য ,আরাগ্য মনে হয় শুরুতে ছিল । আদর্শ লিপিতে ছিল আলস্য দুঃখের আকর । জল পড়ে পাতা নড়ে । এরকম নীতি বাক্য ।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে তখন বোর্ড বই চালু হয়ে গেছে ‌। প্রথমে ছিল আরব দেশ ‌।
” অনেক অনেক দিন আগের কথা । তখন আরবের লোকেরা খুব খারাপ ছিল । তাহারা মারামারি কাটাকাটি করিত । এমন কি তাহারা মেয়ে শিশুকে জীবিত কবর দিত “।
এভাবে প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখাপড়া মনে আছে । তৃতীয় , চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর কোনো লেখাপড়া মনে নেই ‌। ২ /১ একটা কবিতা মনে আছে । যেমন আমাদের ছোট নদী , মুনাজাত‌ । মনে আছে কিছু টুকরো ঘটনা ‌।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়েছে ।
আমরা পূর্ব পাকিস্তান । এর সাথে তিন দিকে ভারত রাষ্ট্র ‌ ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর । তারপর পশ্চিম পাকিস্তান । এ হলো ৩ টি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে পাকিস্তান । মাঝখানে বিরাট ভারত রাষ্ট্র ।
পাকিস্তান হওয়ার পর এ দেশের লেখাপড়ার প্রতি সরকার মনোযোগী হয় । মুসলমানেরা লেখাপড়া শুরু করতে থাকে । হিন্দুরা আস্তে আস্তে পশ্চিম বঙ্গে পাড়ি জমায় ।
আমাদের ৭ বানা হিন্দু প্রধান এলাকা ছিল । রায়রা জমিদার ছিল । দীঘল বানার ধরেরা রায় বাড়ির রায়ত হিসেবে কাজ করতো । দীঘল বানা প্রাইমারী স্কুল ১৯১০ সালে স্হাপিত হয় । বেল বায়না প্রাইমারী স্কুল স্হাপিত হয় ১৯৩০ সালে ।
আমি যখন ১৯৬১ সালে স্কুলে ভর্তি হই তখন আমার মুসলমান ও হিন্দু বন্ধু ছিল উমারেশ , কুমারেশ , ভগবত , শিবু , রতন কর , রতন চাকী , শম্ভু , গোলাম , মান্নান , আক্কাচ , হাফিজ , জাফর , হাবিবুর , সিরাজ , হাই । হিন্দু বন্ধুরা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর কলকাতা চলে যায় ।
তখন ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস খুব ভালো করে পালিত হতো ‌। বর্ষা মৌসুমে খাল বিল নদী পানি আর পানিতে একাকার হয়ে যেতো । নৌকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না । এত পানি হতো বানা বাজার পানির নিচে তলিয়ে যেতো ‌ । এটুকু জায়গা জেগে থাকত সেখানে শুধু পিঁপড়া আর পিঁপড়া ।
বৃহস্পতিবার ও সোমবার বানার হাট বসতো বেড়ির উপর । বেল বায়না মীরি বাড়ি হতে সুইজ গেইট পর্যন্ত ‌ এ হাট বসতো ।
নৌকায় করে আমরা স্কুলে ও হাটে আসতাম ‌। একমাত্র বেড়ি ছাড়া কোনো রাস্তা ছিল না । পায়ে হেঁটে ও নৌকা ⛵ ছিল একমাত্র বাহন । কিছু মানুষ বাইসাইকেল চালাতো ।
১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে স্কুলে খেলাধুলা , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , কবিতা আবৃত্তি , নাটক , যেমন খুশি সাজো বিচিত্র ধরনের অনুষ্ঠান হতো । আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে এ অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করত । সবকিছু ছিল দেখার মতো । বর্ষা মৌসুমে নৌকা বাইচ , মেলা হাডুডু খেলা হতো ।
শীতকালে কবি গান , জারি গান , গুন যাত্রা , যাত্রা বিনোদনের মাধ্যম ছিল ‌।
প্রাইমারী স্কুল ততদিনে টিনের ঘর ভেঙে উঃ পাশে লম্বা করে ইটের ওয়াল দিয়ে উপরে টিন দিয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
লতিফ স্যার ও হাই স্যার ছাত্র ছাত্রীদের খুব ভালো শিক্ষা দেয়ার জন্য কঠিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন । আমাদের আদর্শ এসব ন্যায় নীতিবান ও জ্ঞানী শিক্ষক ।
১৯৬৫ সালে আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম । তখন পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে । পূর্ব পাকিস্তানে কোথায় কি যুদ্ধ হয়েছিল তা আমার জানা নাই ‌। তবে রাতের বেলা আলো জ্বালানো নিষেধ ছিল। আমার আব্বা তৈলের ব্যবসা করতেন । তিনি বানার হাট , বেড়ির হাট ও হেলেঞ্চার হাট করতেন ।
হাট করে বাড়িতে আসতে রাত হতো ‌ । তখন হারিকেন ও কুপির ব্যবহার ছিল । আব্বা কোনদিন হারিকেন জ্বালিয়ে অথবা কোনদিন নিভিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন ‌। সন্ধ্যার পর কোনো রকম খেয়ে আলো নিভিয়ে দিতে হতো । দিনের বেলা fighter plane দেখতাম । খুব দ্রুত গতিতে plane গুলো উড়ে চলে যেতো ‌।
কিছু কিছু প্লেন রঙিন ধুয়া ছাড়তো । নীল আকাশ রঙিন করে দিত ।
রুদ্রবানার রাজ্জাক সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়েছিলেন ‌। তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে চাকরি করতেন । তখন চিঠিপত্রের আদান প্রদান ছিল ।
চিঠিপত্রের মাধ্যমে আমরা যুদ্ধের ফলাফল জানতে পারতাম । হাটে বাজারে যুদ্ধের জয় পরাজয় নিয়ে আলাপ শুনতাম । পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে আমার স্মৃতিতে তেমন কিছু আর মনে নেই ।
(লেখা ধারাবাহিক ভাবে চলবে ) ।

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com