চলতি বছরগুলোতে দেশে ই-কমার্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। করোনালগ্নে ঘরে বসে অর্ডার করে দোরগোড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসটি পেতে প্রচুর মানুষ শরণাপন্ন হয়েছে অনলাইন শপিংয়ের। অনেকের ক্ষেত্রেই তা ‘নেহায়েত প্রয়োজন’ থেকে পরিণত হয়েছেন দৈনন্দিন অভ্যস্ততায়। তবে অনলাইনে শপিংয়ের সুযোগ বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে প্রতারণার ঘটনাও।
গত বছর অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ১১ শতাংশের বেশি ক্রেতা। এ-সময়টাতে দেশে যত ধরনের সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে ১১.৪৮ শতাংশই ছিল এই প্রতারণার ঘটনাগুলো।
সম্প্রতি দেশীয় কিছু ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আর এর প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক কর্তৃক ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বিষয়টিকে লাইমলাইটে এনেছে। ফলশ্রুতিতে সম্ভাবনাময় এই খাতটি এখন ভুগছে আস্থার সঙ্কটে।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে ‘শপিং ক্রাউড’ নামের একটি পেজে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আগাম মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ৪টি শার্ট কেনেন ইউসুফ আলী। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শার্ট বুঝে না পাওয়ায় যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখেন পেজটিতে দেয়া ফোন নম্বরটি ব্লক; ফেসবুকে সেই পেজটিও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
ইউসুফ আলীর মতো বহু ক্রেতাই অনলাইনে কেনা জিনিসটি কখনো হাতে পান না। আর স্মার্টফোনের প্যাকেটে স্মার্টফোনের বদলে পেঁয়াজ বা কাপড়কাচা সাবান কিংবা নামীদামী ব্র্যান্ডের পোশাকের অর্ডারে চকবাজার বা গুলিস্তানের নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের ঘটনা আছে দেদার!
ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের প্রায় ২ শতাংশ মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে। ছোট-বড় মিলিয়ে ২০০০+ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই খাতে। ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা করছে আরও প্রায় ৫০ হাজার বিক্রেতা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো এর অনেকগুলোই ব্যবসায়িক নৈতিকতা মানছে না। পরিণামে গ্রাহকরা শিকার হচ্ছে হয়রানি ও প্রতারণার।
গত ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়, সব মিলিয়ে গেল দেড় বছরে এসব কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হদিস নেই অন্তত এক হাজার কোটি টাকার!
জুলাই, ২০১৮ থেকে জুন, ২০২১ পর্যন্ত ১৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা ১৩,৩১৭টি অভিযোগ করেছেন, যার বেশিরভাগই নির্ধারিত সময়ের ২ থেকে ৬ মাস পরও পণ্য বুঝে না পাওয়া নিয়ে। এ-ছাড়াও আছে ‘চেক ডিজ-অনার’, ‘রিফান্ডের’ টাকা ফেরত না পাওয়া ইত্যাদি।
ধরুন, আপনার অর্ডারের পণ্যটি প্রতিশ্রুত সময় পার হওয়ার পরও হাতে আসেনি, আপনি সংশ্লিষ্ট ই-কমার্স সাইটের হেল্পলাইনে ফোন করলেন সুরাহার জন্যে। ওপাশ থেকে দেয়া হলো শীঘ্রই পণ্য সরবরাহের আশ্বাস। এরপরও দেরি হচ্ছে দেখে আপনি আবারও ফোন করলে দেয়া হলো নতুন আশ্বাস।
আপনি কি জানেন, অনলাইন ক্রেতাদের এভাবে মিথ্যা আশ্বাস দেয়াটাই অনেকের রুটিরুজি?
লোক ঠকানোর অভিযোগ আর বিপুল দেনায় ডুবতে বসা একটি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের একজন সাবেক কর্মী, যিনি কিছুদিন আগেও ওই কোম্পানির কল সেন্টারে কাজ করতেন, তার স্বীকারোক্তি- আমাদের দায়িত্ব ছিল শুধু মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া। একটা মানুষের পক্ষে দিনের ১৪/১৫ ঘণ্টা অনবরত মিথ্যা কথা বলা, এটা সহ্য করাও কঠিন!
অনলাইন শপিংয়ে কিন্তু গ্রাহকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে টাকা কেড়ে নেয়া হয় না; গ্রাহক নিজেই তার কষ্টার্জিত টাকা প্রতারকের হাতে তুলে দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয় অযৌক্তিক মূল্য হ্রাস, কম দামে বেশি মূল্যের পণ্য পাওয়ার ‘লোভ’।
এ-ছাড়াও আছে ‘শপিং ম্যানিয়া’, বাজার ঘুরে কেনাকাটায় আলসেমি, কনজিউমারিজম বা পণ্যদাসত্ব, লোকদেখানো মানসিকতা ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক সময়ে ই-কমার্স খাতে প্রতারণা বাড়ার কারণ হিসেবে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহিদ তমাল বলেন, ‘করোনাকালে হঠাৎ করে অনেকেই ই-কমার্স ব্যবসায় এসেছে। অনেকেই নিয়ম-নীতি না মেনে ব্যবসা করছে। অনেকের ট্রেড লাইসেন্সও নেই। শুধু ফেসবুক পেজ দিয়ে পণ্যের অর্ডার নিচ্ছে।
আপনি যদি অনলাইন শপিংয়ে প্রতারণার শিকার হন তাহলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুই ধরনের মামলাই করতে পারেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী ক্রেতা যেসব বিষয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন তার মধ্যে আছে- মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রতারণা, প্রতিশ্রুত পণ্য সরবরাহ না করা, পণ্যের ওজন পরিমাণ বা পরিমাপে কারচুপি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয়, অবহেলা ইত্যাদি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শাহনাজ সুলতানা বলেন, ‘ধরুন, কোনো ক্রেতা যদি অনলাইনে তার পছন্দের পণ্য কেনেন, কিন্তু হাতে পান অন্য পণ্য, সে ক্ষেত্রে সাত দিনের মধ্যে ফেরত না নিলে বা যোগাযোগ না করলে উপযুক্ত প্রমাণসহ যদি ক্রেতা অভিযোগ করেন তবে আমরা এর তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের কাছে প্রতিদিন প্রায় ২০০ অভিযোগ আসে।’
আসলে তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে আমরা ই-কমার্সকে অগ্রাহ্য করতে পারছি না। গ্রাহকেরা এখন অনলাইনে এমন অনেক দরকারি পণ্য কিনতে পারেন যা সাধারণভাবে পাওয়া যায় না, বা কোথায় পাওয়া যায় তা খুঁজে বের করাও কঠিন। তবে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই যেহেতু শপিং করতে হচ্ছে, তাই সতর্কতার বিকল্প নেই।
এ-ব্যাপারে অনলাইন মার্কেটিং এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কিছু টিপসঃ
ই-কমার্সে প্রতারণার একটি বড় হাতিয়ার হলো চটকদার বিজ্ঞাপন। অস্বাভাবিক মূল্য ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার, সাথে ‘এ সুযোগ সীমিত সময়ের জন্যে’- এমন বিজ্ঞাপন দেখে পড়িমরি করে অর্ডার করেন অনেকেই।
আপনিও যদি এই দলেরই একজন হয়ে থাকেন তাহলে আপনার কাছে প্রশ্ন- আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন অর্ধেক দামে একটি এসি বিক্রি করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে লাভ করে!
তারা কিন্তু দানসত্র খুলে বসে নি, বসেছে টাকা কামাই করতে। ভোগ্যপণ্যে ৫০% বা তারও বেশি ডিসকাউন্ট দেয়ার পর মুনাফা করতে তাদের নিশ্চয়ই এমন পথ ধরতে হয় যা সাধারণ্যে অজানা, এবং সেটা অবৈধ হওয়াটা বিচিত্র নয়। আর গুটিকতক ক্রেতাকে বিশাল ডিসকাউন্টে পণ্য সরবরাহের ‘চোখ সাঁফাই’য়ে বহুসংখ্যক মানুষের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার নজির তো আমরা সম্প্রতিই দেখলাম!
কাজেই এ-ধরণের বিজ্ঞাপন দেখে হুট করে অর্ডার করা থেকে বিরত থাকুন।
প্রতারক চক্র অনেক সময়ই স্বনামধন্য বা প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স সাইটের নকল সাইট তৈরি করে। কখনো বানানে সামান্য পরিবর্তন এনে, কখনো ডিজাইনে। সুতরাং আপনার কাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইটে ঢোকার আগে বানান এবং ডিজাইনের দিকে খেয়াল করুন।
মনে রাখবেন, প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা ব্র্যান্ড হুটহাট তাদের নামের বানান বা লোগো’র ডিজাইন পরিবর্তন করে না।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আফিফা আব্বাস বলেন, “সত্যিকারের ওয়েবসাইটে ঢুকছেন কি-না তা দুইভাবে বোঝা যায়।
১. একটি অরিজিনাল ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেসের শুরুতে অবশ্যই https থাকবে এবং ওয়েবসাইটটির একটি পূর্ণ ডোমেইন নেম থাকবে। অর্থাৎ www. এরপর একটি নাম এবং শেষে .com থাকবে।
২. ওয়েবসাইটটি কোন র্যানডম (এলোমেলো) নম্বর দিয়ে শুরু হবে না।”
যে সাইট থেকে অর্ডার করবেন সেটার রিভিউ দেখে নিন। অবশ্য ফেক বা মিথ্যা রিভিউও থাকতে পারে। এ-ক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে রিভিউয়ের বেশিরভাগই নতুন কি-না।
এ-ছাড়াও, অর্ডার প্লেস করার আগে বেশিসংখ্যক রিভিউ পড়ে প্রতিষ্ঠানটির সেবা সম্পর্কে ধারণা নিন। দেখে নিন ওয়েবসাইটে বাস্তব কোনো ঠিকানা এবং ফোন নম্বর আছে কি-না।
ফেসবুকে যে ই-কমার্স পেজগুলোর মাধ্যমে প্রতারণা করা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো নতুন। সুতরাং আনকোরা কোনো পেজ থেকে অর্ডার করার আগে সেটি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিন। পেইজটিতে যেসব পোস্ট বুস্ট করা হয়েছে সেগুলোর তুলনায় অন্য পোস্টগুলোতে লাইক-কমেন্ট অস্বাভাবিক কম থাকলে সতর্ক হোন।
এছাড়াও দেখুন রিভিউয়ের অপশন আছে কি-না। কারণ ভুয়া পেইজগুলো অনেক ক্ষেত্রেই এই অপশনটি রাখে না।
যে পণ্যটি কিনতে চান সাইটে সেটির মাপ, ওজনসহ বিস্তারিত বিবরণ আছে কি-না দেখুন। সেটির ছবি সংশ্লিষ্ট সাইট ছাড়াও নির্ভরযোগ্য অন্য কোনো উৎস থেকে দেখে নিন। প্রতিষ্ঠানটির রিটার্ন এবং রিফান্ড পলিসি আছে কিনা, থাকলে তা কী সেটাও দেখুন।
অনলাইন শপিংয়ে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করতে হয় যে-সব ক্ষেত্রে প্রতারণার ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায় সেখানেই। কাজেই সেসব সাইটের মাধ্যমেই কেনাকাটা করতে চেষ্টা করুন যেখানে ক্যাশ-অন-ডেলিভারি বা পণ্য বুঝে পেয়ে মূল্য পরিশোধের সুযোগ আছে। প্রি-পে ও পোস্ট-পে দুইয়েরই ব্যবস্থা থাকলে বেছে নিন দ্বিতীয়টাকে।
তবে সে-ক্ষেত্রেও মূল্য পরিশোধের আগে পণ্যটি ঠিকঠাক আছে কিনা এবং আপনার অর্ডারের সাথে মেলে কিনা তা যাচাই করুন। মনে রাখবেন, একজন ক্রেতা হিসেবে ক্রয়কৃত পণ্য যাচাই করার সমস্ত অধিকার আপনার আছে।