করোনাভাইরাসের উপর সওয়ার হয়ে ভার্চুয়াল ভাইরাসের আগ্রাসন, অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন জুয়া, অনলাইন গেম ও অনলাইন প্রতারণার তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলার উপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
এর সমাজ বিধ্বংসী, নৈতিকতা বিধ্বংসী, মানবতা বিধ্বংসী স্বরূপ আমরা কিছু কিছু ঘটনা উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।
এবং অনলাইন গেমকে আমরা অসহিষ্ণু, খুনী ও সন্ত্রাসী সৃষ্টির সূতিকাগার হিসেবে বর্ণনা করেছি।
কারণ এই গেমগুলো তরুণদেরকে নৃশংস, উগ্রবাদী, বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনায় আচ্ছন্ন করে ফেলে, আসক্ত করে ফেলে, এবং সেইজন্যে আমরা বলেছিলাম যে সন্ত্রাসী সংগঠনের মতো অসহিষ্ণু, খুনী ও সন্ত্রাসী সৃষ্টির এই সূতিকাগারের মূল উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।
এবং এই গেমগুলোর নেতিবাচক দিক নিয়ে আমরা কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলাম।
এই গেমগুলোর কিছু সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করে আমরা এ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলাম।
তবে ভিডিও গেমসের সাথে সহিংসতা, খুন, নৃশংসতার যে যোগসূত্র – এটা নতুন কিছু নয়।
২০১১ সালে নরওয়েতে প্রথম বড় ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটে।
আন্ডার্স ব্রেইভিক চরম মুসলিম বিদ্বেষী ও নারী বিদ্বেষী এক নরওয়েজিয়ান। ইউরোপে যে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের উত্থান ঘটছে, ব্রেইভিক তার একটি উদাহরণ।
তার লক্ষ্য ছিল ইউরোপের মাটি থেকে সমস্ত মুসলিমকে বিতাড়িত করা।
২০১১ সালের ২২শে জুলাই একটি সামার ক্যাম্পে নির্বিচার গুলি চালিয়ে সে ৭৭ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে।
মানুষ মারার প্রস্তুতি সম্পর্কে আদালতে খুব সুস্পষ্ট বর্ণনা দেয় এই সন্ত্রাসী।
‘কল অফ ডিউটি’ নামে একটি কম্পিউটার গেম খেলে সে হাত পাকায়। ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ারক্র্যাফট নামে আরেকটি ভিডিও গেম সে দিনে ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত খেলত।
ভিডিও গেমে আসক্ত এই উগ্রবাদী ব্রেইভিক বলে যে- তুমি যদি এই গেমের এনভায়রনমেন্টে কাউকে উদ্দীপ্ত করতে পারো, তাহলে তোমার দাদীআম্মাও সুপার মার্কসম্যানে রূপান্তরিত হবে।
২০১৫ সালে আমেরিকার সাউথ ক্যারোলিনাতে ২১ বছর বয়সী এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ কৃষ্ণাঙ্গদের চার্চে ঢুকে ন’জনকে গুলি করে হত্যা করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে শৈশব থেকে সেও ভায়োলেন্ট ভিডিও গেমে আসক্ত ছিল।
২০১৬ সাল, জার্মানি।
জার্মানির মিউনিখে শপিং মলে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে ১৮ বছরের তরুণ আলি ডেভিড সনবলি।
আহত করে ৩৬ জনকে। পরে আত্মহত্যা করে নিজে।
ডেভিড সনবলি তার সহপাঠীদের হাতে দীর্ঘ সাত বছর বুলিং, অর্থাৎ মানসিক উৎপীড়নের স্বীকার হয়।
তাদের সাথে সে মিশতে পারত না। এক সময়ে ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করে এবং ভিডিও গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ে।
এবং গেম খেলতে খেলতে তার ভেতরে প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি হয়।
এবং খুনের টার্গেট হিসেবে সে বেছে নেয় তার সমবয়সী টিন-এজারদের।
এবং তার মডেল ছিল খুনি এন্ডার্স ব্রেইভিক ।
জার্মানির এ দুঃখজনক ঘটনার পরে, অনেক মানসিক বিশেষজ্ঞ শিশু-কিশোরদের উপর বুলিং, অর্থাৎ সহপাঠীদের হাতে মানসিক উৎপীড়নের যে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে, এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন।
তবে এই করুণ ঘটনার পরপরই আমরা জালালিতে বলেছিলাম, যে শুধু সহপাঠীদের মানসিক নিপীড়ন, মানসিক উৎপীড়ন এজন্যে একমাত্র দায়ী নয়।
আমরা বলেছিলাম, মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে, সন্তান কীভাবে বড় করছেন, তাকে কী শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়।
সন্তান অবসর সময়ে কী করছে, কী বই পড়ছে, কী কাজ করছে বা কী করছে সে ব্যাপারে অভিভাবকরা অসচেতন বা গাফেল থাকলে সন্তানের চরম সর্বনাশ হতে পারে।
আমরা উদাহরণ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথা বলেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, তিনি কি ইন্দোনেশিয়ায় এবং তারপর আমেরিকায় দিনের পর দিন সহপাঠীদের বুলিংয়ের শিকার হন নি?
সহপাঠীদের হাতে মানসিক নিপীড়নের – মানসিক উৎপীড়নের শিকার হন নি?
হয়েছেন। কিন্তু তার মা, মা তাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন ছোটবেলাতেই, সেই ইন্দোনেশিয়ায় থাকতেই যে, কখনো রিঅ্যাক্ট করবে না, সবসময় ইতিবাচকভাবে নেবে। সমস্ত টিটকারি উপেক্ষার জবাব দেবে নিজস্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে।
সেই ছোটবেলায় বারাক ওবামা লক্ষ্য স্থির করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার। তিনি কোনো বুলিংয়ে রিঅ্যাক্ট করেন নি এবং বিষণ্ণতায়ও ভোগেন নি, হতাশায়ও ভোগেন নি।
বরং সব তিরস্কার টিটকারিকে উপেক্ষা করে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন।
আসলে অনলাইন গেম বা কম্পিউটার গেম বা ভিডিও গেম যে শুধু নরওয়ে, জার্মানি, আমেরিকায় সহিংসতার জন্যে দায়ী তা নয়।
২০১৯ সালে ১৫ই মার্চ অস্ট্রেলিয়ান তরুণ ব্রেনটন টারান্ট নিউজিল্যান্ডে দুটি মসজিদে গুলি চালিয়ে ৫১ জন মুসল্লিকে হত্যা করে।
তারও রোল মডেল ছিল নরওয়ের ব্রেইভিক। টারান্ট খুন করার দৃশ্য ফেসবুকে লাইভে প্রচার করে ও রেকর্ড করে।
গ্রেফতার হওয়ার পর টারান্টকে জিজ্ঞেস করা হয়, ভায়োলেন্স ও টেরোরিজম সে কীভাবে শিখল?
তার উত্তর ছিল, ‘স্পাইরো দ্যা ড্রাগন’ ভিডিও গেমটি আমাকে উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে, এবং ফোর্টনাইট গেমটি আমাকে কিলার হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১৯শে মার্চ ২০১৯ এর রিপোর্ট।
আসলে এই ঘটনাগুলো মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়।
২০১১ সালের রেডিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকার বার্ষিক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা স্কুল অফ মেডিসিনের একদল বিজ্ঞানী গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন।
তাদের রিপোর্টে তারা বলেন, ভিডিও গেম খুব একটা খেলে না এমন ২৮ জন তরুণের উপর পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি, মাত্র এক সপ্তাহ ভায়োলেন্ট ভিডিও গেমস খেলার পরে তাদের ব্রেনের বুদ্ধিমত্তা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।
১৯৯৮ সালে গবেষকরা শনাক্ত করেন যে ভিডিও গেমস মস্তিষ্কে ডোপামিন লেভেল ১০০% বাড়িয়ে দেয়!
আর গত ২৩ বছরে যেসব গেম বেরিয়েছে সেগুলো আরো আরো আসক্তিকর।
এখনকার ভিডিও গেমগুলো কত আসক্তিকর তা বোঝাতে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ড. নিকোলাস বলেন, ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভিডিও গেমস ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তদের চেয়ে হেরোইন ও ক্রিস্টাল মেথে আসক্তদের সুস্থ করে তোলা অনেক সহজ।
আর পেন্টাগনের এডিকশন রিসার্চ বিভাগের প্রধান ড. এন্ড্রুর মন্তব্য হলো- ভিডিও গেমস ও স্ক্রিন আসক্তি হচ্ছে ডিজিটাল মাদক।
প্রিয় সুহৃদ, আমরা যদি বোঝার চেষ্টা করি, যে এই সহিংস ভিডিও গেমের উদ্যোক্তা কারা, তাহলে আমরা দেখব যে যুদ্ধবাজ ও অস্ত্র বেনিয়া চক্র এই গেম প্রসারের মূল উদ্যোক্তা।
‘ওয়ার-প্লে, ভিডিও গেমস এন্ড ফিউচার অফ আর্মড কনফ্লিক্ট’ বইতে নিউ ইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর করি মিড পুরো ব্যাপারটা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
১৯৬০ এর দশক থেকে শুরু। পেন্টাগন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী গেমগুলো ব্যবহার করে সৈন্য রিক্রুট ও প্রশিক্ষণের কাজে।
বিশ্বজুড়ে মার্কিন সামরিক অভিযানের প্রয়োজন অনুযায়ী, পেন্টাগনের চাহিদাপত্র অনুযায়ী, গেম কোম্পানিগুলো নতুন নতুন কম্পিউটার গেম বানিয়েছে।
এবং এই গেমগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সম্ভাবনাময় তরুণদের সেনাবাহিনীতে রিক্রুট করার উদ্দেশ্যে।
আসলে যুদ্ধবাজ এবং অস্ত্র বেনিয়াদের দৌলতে এই ভিডিও গেমের বাজার যে কত বড় তা আমরা একটি আলোচনা করলেই বুঝতে পারি।
মার্কেট ওয়াচ ২রা জানুয়ারি ২০২১ সালের রিপোর্ট হচ্ছে, হলিউড-বলিউডসহ পৃথিবীর যত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আছে, সবার ব্যবসার পরিমাণ যোগ করলে এটি ১০০ বিলিয়ন ডলার হবে।
আর ভিডিও গেম ব্যাপারীদের ব্যবসার পরিমাণ হচ্ছে ১৮০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ। এটা ২০১৯ সালের হিসাব।
আসলে যে গেম যত মানুষ মারতে পারবে, খেলোয়াড় তত পয়েন্ট পাবে, যে গেম তরুণদের অসহিষ্ণু, হিংস্র, খুনি, দাঙ্গাবাজ, যুদ্ধবাজ করে তোলে, সেই গেমের নির্মাতা ও বেনিয়াদের যুদ্ধপরাধী হিসেবে বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারের আওতায় আনা উচিৎ।
কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন আপনি কী করবেন?
সন্তানকে সুস্থ রাখার জন্যে, ভালো রাখার জন্যে, গেমরূপী বা সোশ্যাল মিডিয়ারূপী ডিজিটাল মাদক থেকে রক্ষা করার জন্যে আপনি কী করতে পারেন?
এটা সম্পর্কে আমরা এর আগে কয়েকটি পয়েন্ট বলেছিলাম।
কিন্তু তার আগে চীন যে পদক্ষেপ নিয়েছে এক্ষেত্রে আমরা তা আলোচনা করতে পারি।
চীনে প্রায় আড়াই কোটি তরুণ-তরুণী স্ক্রিনে আসক্ত। এবং ৫০ শতাংশ শিশু-কিশোর মায়োপিয়ায় আক্রান্ত।
শঙ্কিত চীন সরকার তাই ২০০৮ সালে স্ক্রিন আসক্তিকে ‘মানসিক ব্যাধি’ হিসেবে ঘোষণা করে। ভিডিও গেমকে চীনে ‘ডিজিটাল আফিম’ বলা হচ্ছে।
চীন সরকার গেমিং কোম্পানিগুলোকে সে দেশে ব্যবসা করার জন্যে কিছু নিয়ম করে দিয়েছে-
১. ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো গেমার রাত দশটা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত ভিডিও গেম খেলতে পারবে না।
২. ১৮ বছরের কম বয়সীরা ছুটির দিনে তিন ঘন্টা এবং সপ্তাহে বাকি দিনগুলোতে দেড় ঘন্টা ভিডিও গেম খেলতে পারবে।
৩. শিশুকিশোররা গেমিং একাউন্টে প্রতি মাসে ২০০ ইউয়ান বা ২৪০০ টাকার বেশি রাখতে পারবে না।
আমাদের দেশেও যদি এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা নিঃসন্দেহে অভিভাবকদের জন্যে একটা স্বস্তির কারণ হবে।
প্রিয় সুহৃদ, কর্তৃপক্ষ যখন সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন আমরা অবশ্যই স্বাগত জানাবো।
কিন্তু তার আগে মা-বাবা হিসেবে সন্তানের ব্যাপারে আপনারও করণীয় রয়েছে।
প্রিয় সুহৃদ, দৃঢ় হতে হবে। দৃঢ় হবেন, কিন্তু রূঢ় নয়।
সন্তান রূঢ়তা অপছন্দ করে, কিন্তু দৃঢ়তাকে শ্রদ্ধা করে। দৃঢ় হতে হবে শুরু থেকেই।
সময় বেঁধে দেন। রাত ১১টার পর অনলাইন বন্ধ। সন্তানের জন্যে, নিজের জন্যেও।
আর এই ডিজিটাল আফিম থেকে বাঁচাতে সন্তানকে মনোযোগ ও সময়- দুই-ই দিতে হবে।