অন্যের থেকে নেয়ার চেয়ে দেয়াতেই শতগুণ বেশি আনন্দ
জ্যাকি মার্মা
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: ৭ অক্টোবর ২০২৪
২০০৩ সাল। কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার বলতে গেলে শুরুর দিকেই বাবা-মা আমাকে ভর্তি করিয়ে যান। স্কুলের তখন একচালা ছনের ঘর। এসব দেখেও আমার বাবা-মা ভরসা করেই কোয়ান্টামের হাতে আমাকে দিয়ে যান। আশা ছিল তাদের সন্তান এখানে থাকলে সত্যিই একদিন শিক্ষিত হবে, ভালো মানুষ হবে।
মাত্র চার বছর বয়সেই এখানে ভর্তি হয়েছিলাম। যে বয়সটা মায়ের কোলে, মায়ের ভালবাসা মমতায় পরিপূর্ণ হয়ে থাকার কথা সেই বয়সেই কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে ভর্তি হয়েছি। মায়ের অভাবটা অনুভব করলেও খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিলাম। স্কুলে ও ছাত্রাবাসে শিক্ষক, শিক্ষিকা, সিস্টার, হলের দায়িত্বশীলদের ভালবাসা-মায়া-মমতায় ঘিরে থাকত আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। পেছন ফিরে তাকালে একটু অবাক লাগে, ২০০৩ সালে শিশুশ্রেণিতে ভর্তি হওয়া সেই শিশু জ্যাকি আজ দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই সংগ্রাম, জীবনের এই যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না।
বাবা-মা এবং তিন ভাই নিয়ে আমাদের ছোট পরিবার। বাবা জমিতে কাজ করতেন। কখনো বেকার থাকতেন। বেশিরভাগ সময় কাজের সন্ধানে থাকতেন। বাবা মৃত্যুর আগে ছোট একটা দোকানে বসে ব্যবসা করেছেন। আর বাবার সাথেই জমিতে কাজ করতেন আমার মা।
২০০৩ সাল থেকে ২০১৬, এই দীর্ঘ ১৩ বছরের পুরো সময়টা অতিবাহিত হয়েছে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে। ২০১৪ সালে আমি এসএসসি-তে কসমো স্কুল থেকে প্রথম গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। তারপর ২০১৬ সালে কসমো কলেজ থেকে ভার্সিটি কোচিং করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে মেধাতালিকায় ১৬৮ তম হয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগে অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছি। বর্তমানে সেখানেই মাস্টার্সে (২০২৩) অধ্যয়নরত আছি।
আমার জীবনে বেশিরভাগ কৃতিত্ব ও সাফল্য সবই অর্জিত হয়েছে এই স্কুলের কল্যাণে। এখানেই শিখেছি কীভাবে নিজেকে এবং সমাজকে পরিবর্তন করতে হয়। আমাদের এই সমাজ পরিবর্তনের জন্যে যে-সব শিক্ষা দরকার সবই শিখেছি এই প্রতিষ্ঠানে এসে। উদার মানসিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, পরের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করার প্রচেষ্টা—সবই শিখেছি দীর্ঘ ১৩ বছর কোয়ান্টামে শিক্ষালাভের মাধ্যমে।
২০০৯ সালে যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি, তখন ঢাকায় ২৮৭ তম কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এটাই আমার জীবনে চলার পথে এক স্মরণীয় দিন। জীবনকে জানা, নিজেকে চেনা, রাগ-ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা, জীবনের মনছবি দেখা, মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে যে আনন্দ তা জেনেছি, শিখেছি এই মেডিটেশন কোর্স করে। এজন্যে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাব আমার গুরুজী দাদুর প্রতি, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এবং এর আত্মিক অভিভাবকদের প্রতি।
সালটা হয়তো ২০০৮-এর দিকে, ঠিক মনে পড়ছে না। ছালেহ আহমেদ স্যার ঢাকা থেকে আমাদের কসমো স্কুলের দায়িত্বে বদলি হয়ে এসেছেন। এই মানুষটার কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকব। একজন শিক্ষকের প্রধান সাফল্য হলো ছাত্রের মধ্যে লুকায়িত সুপ্ত প্রতিভা ও মেধাকে বিকশিত করা। তিনি তা পেরেছিলেন বলেই আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছালেহ স্যারের ছায়ায় কাটানো আমার শৈশব আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
কোয়ান্টাম আমাকে সবসময় নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস স্থাপন ও মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা শিখিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ জাগ্রত করতে শিখিয়েছে। অন্যের থেকে নেয়ার চেয়ে দেয়ার মধ্যে শতগুণ বেশি আনন্দ উপভোগ করা যায়। এই মহৎ উপদেশটি আমি আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
আমি, আমার বড় ভাই এবং ছোট ভাই কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমাদের দায়িত্ব কোয়ান্টাম নিয়েছিল বলেই আমরা তিন জনই আজ বড় স্বপ্ন দেখি। সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারার জন্যে বিশেষভাবে ফাউন্ডেশনের সকল আত্মিক অভিভাবকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাদের একটু আন্তরিকতা, মমতা, ভালবাসায় বেড়ে উঠুক আমার মতো আরো হাজারো, লাখো বঞ্চিত শিশু।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]
quantummethod.org.bd