বঙ্গবন্ধু ৫ম সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১। ঢাকার মিরপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে একটার পর একটা ইভেন্ট চলছে। এতে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে পারফর্ম করার সুযোগ পেয়েছি আমি। ফ্লোর এক্সারসাইজ ইভেন্টে আমার সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। পেয়ে গেলাম অন্য এক জিমন্যাস্টের অসুস্থতার কারণে।
ভারত, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকার প্রতিযোগীদের এ কয়দিন কাছ থেকে দেখে যা বুঝেছি, মেধা বা কোচদের আন্তরিকতা—কোনোদিক দিয়েই আমরা ওদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। প্রয়োজন শুধু নিজের সামর্থ্যে আস্থা। আর আমার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটা আমি জানি—অবলোকন করতে পারার ক্ষমতা। আমি জানি, যেভাবে অবলোকন করব সেভাবেই ঘটবে পারফরম্যান্সের প্রতিটি মুহূর্ত।
ইভেন্ট শুরুর আগে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম আমি। মনের চোখে দেখতে শুরু করলাম প্রতিটি মুহূর্ত। কিছুক্ষণ পর শুরু করার ইঙ্গিত এলো। শুরু করলাম। ঠিক সেভাবেই ঘটল প্রতিটি মুহূর্ত, যেমনটা আমি ভেবেছিলাম। ইভেন্ট শেষ করে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালাম। বাংলাদেশের হয়ে রৌপ্য অর্জন করেছি আমি। কোচসহ অন্য জিমন্যাস্টরা সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন আমাকে। এটি ছিল বাংলাদেশের পক্ষে সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান জিমন্যাস্টিকসের ইতিহাসে প্রথম পদক। নিজের ভেতর আনন্দটাকে সংহত রাখলাম আমি। আমার লক্ষ্যের পথে মাত্র একটা ধাপ এগোলাম আমি। যেতে হবে আরো বহুদূর।
এরপর ভোল্টিং টেবিল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করলাম আমি। আমার অর্জিত দুটি পদক অবদান রাখল প্রতিযোগিতায় সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের তৃতীয় অবস্থান অর্জনের ক্ষেত্রেও। দেশের জন্যে কিছু অর্জন করার তৃপ্তি আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আমার আজকের অবস্থানে আসার প্রেক্ষাপট বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে ১২ বছর আগে।
২০০৯ সাল। বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে আমাদের গ্রামে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে একজন কর্মী এলেন। তিনি আমাদের পাড়ায় প্রত্যেকের বাড়িতে এসে পারিবারিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছিলেন। আর জেনে নিচ্ছিলেন এখানকার শিশুরা লেখাপড়া করে কিনা। সে-সময় আমাদের এলাকার মতো দুর্গম পাহাড়ি জায়গায় লেখাপড়া তো দূরের ব্যাপার, প্রতিদিনের খাবার জোটানোটাই ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের কথা সবাইকে জানালেন। সেখানে শিশুদের লেখাপড়া, থাকা-খাওয়ার এরকম সুব্যবস্থা শুনে আমাদের পাড়ায় কেউই প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় নি। ব্যতিক্রম ছিলেন আমার বাবা। তিনি তখন কৃষিকাজ করেন। বংশ পরম্পরায় আমরা ছিলাম চিকিৎসক। স্থানীয় ভাষায় যাকে ওঝা বা বৈদ্য বলে। অনেকের নিষেধ ও ভিন্নমত অগ্রাহ্য করে গ্রাম্য ডাক্তার আমার বাবা কোয়ান্টামের ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করলেন। আমাকে কসমো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন ২০১০ সালে। স্কুলে আসার প্রথম দিনটির কথা আমার আবছা মনে পড়ে। আমার মা-কে কোনোভাবেই আমি ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। খুব কেঁদেছিলাম। কিন্তু একসময় মা-বাবা আমাকে আবাসিক এই স্কুলে রেখে চলে গেলেন। এখানে নতুন নিয়মে শুরু হলো আমার জীবন।
এখানে শিক্ষকেরা সবসময় আমাদের আশা আর বিশ্বাসের গল্প বলেন। বড় স্বপ্ন দেখতে বলেন। আমার শিশুকালে এসব কথা খুব একটা বুঝিনি কিন্তু আস্তে আস্তে এখানকার পরিবেশের সাথে আমি মানিয়ে নিলাম। পড়াশোনা, খেলাধুলার মিশ্রণে চমৎকার কর্মব্যস্ত এক রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম আমি।
২০১২ সাল থেকে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় আমার জিমন্যাস্টিকস চর্চা শুরু হলো। প্রথম প্রথম খেলার আনন্দেই খেলতাম। একসময় স্কুলের নিয়মিত প্রতিযোগিতাগুলোতে বেশ ভালো করতে লাগলাম আমি। শিক্ষকরা প্রশংসা করতেন। এতে আমার আগ্রহ বাড়ে জিমন্যাস্টিকস চর্চার প্রতি। কোয়ান্টাম কসমো স্কুল কর্তৃপক্ষ আরেকটি দারুণ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন আমাদের জিমন্যাস্ট হয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। সেটা হলো, নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রায়ই ঢাকা থেকে কোচ নিয়ে আসতেন আমাদের প্রশিক্ষণকে আরো ঝালিয়ে নেয়ার জন্যে। যার ফলে আমাদের খুঁটিনাটি অনেক টেকনিক্যাল ত্রুটি আমরা শুধরে নিতে পেরেছি শুরু থেকেই।
কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের সবুজে ভরা পাহাড়ি পরিবেশ জিমন্যাস্টিকস চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক। কেননা পাহাড়ি পথে যখন আমরা দৌড়াই, অনুশীলন করি, স্বভাবতই কসরত করতে হয় সমতলের চেয়ে অনেক বেশি। এতে শরীরে মেদ জমে না। ফুসফুস ভালো থাকে, পারফরম্যান্সও ভালো হয়।
আমাদের দিন শুরু হয় ভোর ৫টা থেকে। এরপর এক থেকে দেড় ঘণ্টা পাহাড়ি পথে দৌড়ে, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ শেষে আবাসনে ফিরে আসি। গোসল ও সকালের নাশতার পর ৮টা থেকে শুরু হয় স্কুল। দুপুর ২টা পর্যন্ত স্কুল চলে। দুপুরের খাবার খেয়ে প্রস্তুতি নিয়ে বিকেল ৩—৫টা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ। আমাদের রাতের খাবার খাওয়ার সময় সন্ধ্যা ৬টায়। এরপর রাত ১০টা পর্যন্ত টানা পড়াশোনা। সে-সময় শিক্ষকরা আমাদের সাথে থেকে পড়াশোনায় সাহায্য করেন।
এভাবেই সুন্দরভাবে চলছিল সবকিছু—পড়াশোনা, জিমন্যাস্টিকস, বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া। কিছু জায়গায় ভালো করা, কিছু জায়গায় না পারার বেদনা, সব মিলিয়ে মনছবির ‘আমি’কে স্পষ্টভাবে দেখতে চেষ্টা করছিলাম আমি। এমন সময় এলো করোনা।
করোনার এই সময়টা আমার জন্যে অন্যরকম এক উপলব্ধির সময়। এ সময় প্রায় ছয় মাসের মতো আমি বাড়িতে ছিলাম পরিবারের সাথে। কারণ স্কুল বন্ধ ছিল। পরিবারকে কাছ থেকে দেখলাম, বুঝতে পারলাম আমার পারিবারিক বাস্তবতা। গোত্রীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে আমাদের আর বান্দরবানে থাকা সম্ভব হয় নি। উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিলাম আমাদের সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী। শেষ পর্যন্ত আমাদের আশ্রয় হয় রাঙামাটিতে। আমার এক চাচার জমিতে আশ্রয় মেলে আমাদের।
আমরা দুই ভাই। বড় ভাই গার্মেন্টসে চাকরি করতেন, করোনায় চাকরি হারালেন। তার স্ত্রী ও কন্যা আছে। বান্দরবানে আমরা কৃষিজমিও হারিয়েছি, বাবা গ্রামে গ্রামে মানুষকে চিকিৎসা করে যতটুকু আয় করেন, তাতে পরিবার চলে না। বাধ্য হয়ে আমার ভাই মাছের ব্যবসায় নেমেছেন। মাছ ধরার কারণে অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে নদীতে আর সমুদ্রে কাটে তার।
কসমো স্কুলে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আর বাঁধা রুটিনে প্রাণোচ্ছলতায় বেড়ে উঠেছি আমি। বাড়ি আসতাম মাঝে মাঝে। আর মা-বাবাও নিজের কষ্টের কথা কখনো মুখ ফুটে বলেন নি। ফোনে যখন কথা হতো, শুধু উৎসাহ দিতেন। বলতেন—বিশ্বাস রেখো, তুমি পারবে। অথচ বাসায় থেকে আমি আমার পরিবারের বেদনাগুলোকে কাছ থেকে দেখলাম। বস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি বুঝতে পারলাম স্কুলে কত যত্নের সাথে আমাকে গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাকে আমার মনছবিতে পৌঁছাতেই হবে। দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম আমি।
কিন্তু বাসায় ফিটনেস ধরে রাখাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে স্কুলের মতো পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস ও রুটিন অনুসরণ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরও আমি বাসার পাশের একটি লেকে নিয়ম করে সাঁতার কাটতাম, রাস্তায় দৌড়াতাম আর মনছবি দেখতাম। মনছবি থেকে কখনোই আমি সরে আসিনি।
ছয়মাস পরে সুখবর এলো, বিশেষ অনুমতি নিয়ে আবার শুরু হবে স্কুল। তবে ক্লাসের জায়গায় যার যার সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাজ করার সুযোগ থাকবে। এটা আমার জন্যে দারুণ এক সুযোগ ছিল। স্কুলে ফিরে আমি কঠোর পরিশ্রম শুরু করলাম। আমাদের জিমনেসিয়ামে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের প্রশিক্ষণের শুরুতেই থাকত মেডিটেশন ও প্রার্থনা। তারপর আমরা মূল প্রশিক্ষণ শুরু করতাম। এরপর রিল্যাক্সিং কিছু ব্যায়াম দিয়ে আমরা প্রশিক্ষণ শেষ করতাম।
বঙ্গবন্ধু ৫ম সেন্ট্রাল সাউথ এশিয়ান জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১-কে সামনে রেখে ছয় মাসের প্রস্তুতি ক্যাম্পের ডাক এলো বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন থেকে। সারাদেশের নির্বাচিত ১১ জন জিমন্যাস্টকে এ ক্যাম্পে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে। এ ক্যাম্পে আমি সুযোগ পেলাম। এবার ভালো করব, এ ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কারণ এর আগে সিঙ্গাপুর ওপেন জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৯-এর ক্যাম্পে অংশ নিয়েও শেষ মুহূর্তে ইনজুরির কারণে আর মূল ইভেন্টে অংশ নিতে পারি নি। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়তাম। অসুস্থ অবস্থায় আমাকে জেএসসি পরীক্ষা দিতে হয়, যার কারণে আমার ফলাফল আশানুরূপ হয় নি। আমি এ মাইনাস পেয়েছিলাম। ক্লাস ফাইভে পিইসি পরীক্ষায় আমি জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলাম।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় নবম বাংলাদেশ গেমস ২০২০-এ আমি ভালো করেছিলাম। ওখানে সার্বিকভাবে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছিল। টুর্নামেন্টে আমিও ব্যক্তিগতভাবে দুটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য পদক পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। এ সাফল্যের কারণে জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন থেকে আমি ছয় মাসের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলাম।
যা হোক, এবারও প্রশিক্ষণ শুরু করার কিছুদিন পরেই পায়ের ইনজুরিতে পড়লাম। অনেক এক্সারসাইজেই অংশ নিতে পারছিলাম না। আসলে বাস্তব জীবন এমনই। একটা সাফল্য পাওয়ার পর উদযাপনের সময় মনে হয়, এ সাফল্যের জন্যেই সবকিছু সাজানো হয়েছিল। কিন্তু সাফল্য অর্জনের পথে যখন একটার পর একটা বাধা-বিঘ্ন আসে, হতাশায় ভেঙে পড়তে চায় শরীর-মন। ইনজুরির সেই একমাস ছিল আমার জন্যে তেমনই এক সময়। মনে হচ্ছিল আমি আর পারছি না।
কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে আমাদের শুরু থেকেই শেখানো হয় মেধার কোনো জাত নেই, পাত নেই, ধর্ম নেই, বর্ণ নেই, গোত্র নেই। যে স্বপ্ন দেখতে পারে, মনে ছবি আঁকতে পারে, নিজের মেধাকে সৃষ্টির কল্যাণে বিকশিত করতে পারে, তার অর্জন তত বড়। আমাদের তাই এখানে ছোটোবেলা থেকেই বড় স্বপ্ন, বড় লক্ষ্য নির্ধারণের জন্যে উৎসাহিত করা হয়। আর লক্ষ্য অর্জনে নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে শেখানো হয়।
আমরা যখন একেবারেই ছোট ছিলাম, সেই সময়ের কিছু স্মৃতি আমার মনে গেঁথে আছে। গুরুজী দাদু যখন ঢাকা থেকে লামায় আসতেন, আমাদের সাথে কিছু সময় আমাদের স্কুলের মাঠে থাকতেন। আমরা চারপাশ থেকে গুরুজী দাদুকে ঘিরে ধরতাম। গুরুজী দাদু আমাদের সবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন আর বলতেন—তুমি বিশ্বাসী, তুমি সাহসী, তুমি পারবে। তুমি বিশ্বাসী, তুমি সাহসী, তুমি পারবে। কখনো কখনো বলতেন—তুমি জীবনে প্রথম হবে।
তখন আমাদের কাছে বিষয়টা অনেক মজার ছিল। গুরুজী দাদু আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিবার একই কথা বলেন। কেন বলেন, তা বুঝতাম না। তবে গুরুজী দাদুর হাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্যেই আমরা তাকে ঘিরে ধরতাম।
জীবনে চলার পথে যখনই হতাশা আসতে চায়, মনে হয়, আমার দ্বারা আর হবে না, তখনই হৃদয়ের গভীর থেকে এই স্মৃতি আমাকে শক্তি জোগায়। আমি নিজের ভেতর থেকে অদম্য একটা শক্তি পাই, সাহসী হয়ে উঠি। নিজের মাঝে বিশ্বাস আবার প্রবল হয়ে ওঠে—আমি বিশ্বাসী, আমি সাহসী, আমি পারব।
ইনজুরির সময়টাতেও আমি বার বার আমার লক্ষ্যকে অবলোকন করছিলাম। আমি যেটা করি, তা হলো লক্ষ্যটি সুস্পষ্টভাবে লিখি। এই লেখাটা আমাকে খুব সাহায্য করে। অনেকের একটা ভুল ধারণা আছে, জিমন্যাস্টিকস বোধহয় শুধুই শারীরিক কৌশলের খেলা। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। জিমন্যাস্টিকসেও প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, মাথা খাটাতে হয়। খেলার বিভিন্ন ধাপ, নিয়মকানুন পড়তে হয় দীর্ঘ সময় নিয়ে। আয়ত্ত করতে হয় লাগাতার চর্চার মধ্য দিয়ে। আমি সেই পড়াশোনাটা নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছি।
কোচরা আমাকে বলেছিলেন, পায়ের এই অবস্থায় খেলাটা আমার জন্যে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কিন্তু আমি বললাম, আমি চেষ্টা করতে চাই। অবশেষে একমাসের মাঝেই আমি ইনজুরি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলাম। এরপর শুরু হলো কঠোর অনুশীলন। আসলে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগীদের সাথে পাল্লা দিতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। আমার কোচরা আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, এজন্যে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
প্রস্তুতির সময় ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে আমার পুরো যুদ্ধটাই ছিল আমার নিজের সাথে। কারণ এখানে সুযোগ-সুবিধা ও কোচদের পরামর্শ নেয়ার সুযোগ কোনোকিছুর অভাব ছিল না। অভাব ছিল শুধু এই বিশ্বাসের যে-কোনো দেশের প্রতিযোগীর সাথে আমরাও যে সমান তালে পারফর্ম করতে পারি।
ক্যাম্পে প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে আমি যখনই সুযোগ পেয়েছি, মেডিটেশন করেছি। আত্মনিমগ্ন হয়ে মনছবি অবলোকন করেছি। নিজেকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছি, আমার লক্ষ্য অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়। আর এই প্রতিযোগিতা তার একটি ধাপ মাত্র। এখানে ভালো করলে রাশিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যাওয়ার দুয়ার খুলে যাবে আমার জন্যে। এরপর রিও অলিম্পিক এবং অলিম্পিকে যাওয়ার সুযোগ পাব আমি। বার বার অবলোকন করে ও লিখে এ লক্ষ্যের কথাই আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতাম। আর প্রতিটি ধাপে কীভাবে কী করতে হবে, সেই কৌশল ঠিক করতাম।
শেষ পর্যন্ত জুনিয়র ক্যাটাগরিতে যে তিনজন অংশ নেবে বলে ঠিক হলো, তার মাঝে সুযোগ পেলাম আমি। কোচরা আমাকে বার বার বললেন—ভালো করলে তারা খুব খুশি হবেন, কিন্তু কোনো ঝুঁকি নিয়ে ইনজুরিতে যেন না পরি। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, আমার সেরা পারফরম্যান্স করার চেষ্টাটাই আমার থাকবে। এখন ভালো লাগছে এই ভেবে যে, তাদের মুখে আমি হাসি ফোটাতে পেরেছি।
ঢাকায় এবারের ক্যাম্পে আমার জন্যে অনবদ্য এক অভিজ্ঞতা ছিল রিও অলিম্পিকে সোনাজয়ী জিমন্যাস্ট মার্গারিতা মামুনের সাথে সাক্ষাৎ। সত্যিই এটা জীবন বদলে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা আমার জন্যে। এত বড় একজন অ্যাথলেটকে কাছ থেকে দেখে আমি বুঝলাম, একজন বড় অ্যাথলেট এমনই হন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত রাশিয়ান এই জিমন্যাস্ট আমাদের সাথে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছেন, প্র্যাকটিস করেছেন। তিনি রিদমিক জিমন্যাস্টিকস চর্চা করেন। আর আমরা আর্টিস্টিক জিমন্যাস্ট।
তবে তার হাতে রিও অলিম্পিকে জেতা সোনার মেডেলটা যখন দেখলাম, তখন আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটা যেন আমার কতদিনের চেনা। এটা যেন আমাকে ডাকছে। এক প্রবল আকর্ষণ অনুভব করেছি। মার্গারিতা মামুন আমাদেরকে অনেক উৎসাহিত করেছেন। আমাদেরকে তার খেলোয়াড়ি জীবনের অনেক গল্পও বলেছেন।
আগেই বলেছি, আমার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে আমার অবলোকন করার ক্ষমতা। আমি লক্ষ্যটাকে সুস্পষ্টভাবে লিখে রাখি। মেডিটেশনে অবলোকন করি। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে আমরা যে প্রতিদিন মেডিটেশন চর্চা করি, তার সুফল আমি এখন প্রতি মুহূর্তে পাচ্ছি।
ক্যাম্পে ইনজুরির সময় আমার পায়ের ফ্র্যাকচারের কারণে যখন কোচরা আমাকে নিয়ে তেমন আশাবাদী হতে পারছিলেন না, তখনো আমি সুযোগ পেলেই মেডিটেটিভ লেভেলে চলে যেতাম, অবলোকন করতাম—আমার পা ভালো হয়ে গেছে। পায়ে কোনো ব্যথা নেই। আমি সুস্থ স্বাভাবিকভাবে খেলতে পারছি।
যে দুটি ইভেন্টে আমি পদক পেয়েছি, সে দুটিতে আসলে পায়ের কসরত অনেক বেশি। যার কারণে আমার কোচরা এখানে আমাকে খেলতে অনুমতি দেবেন কিনা ভাবছিলেন। বরং হাতের খেলাগুলোতে বেশি প্রস্তুতি নিতে বলছিলেন। কিন্তু অন্য এক খেলোয়াড়ের ইনজুরির কারণে কোচরা আমার ওপর সে-সময় আস্থা রাখলেন আর আমিও পদক পেলাম।
আমি মনে করি, এখানেই মনছবির শক্তি। মনের শক্তিকে আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে যে-কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব। আমি প্রতিদিন আমার মনছবিকে অবলোকন করি এবং এ লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছবই।
[ কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটের সাথে কোয়ান্টা রাজীব চাকমার একান্ত সাক্ষাৎকার ]