তবে সবচেয়ে সংগ্রামের বিষয়টি ছিল বাংলা বলাটা। কারো সাথে কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পেতাম না। শুধু ইশারায় কাজ চালিয়ে নিতাম। বাংলা শেখার জন্যে অনেক কষ্ট করেছি। শুধু নিজের নামটা ভালো করে বলতে পারতাম। আর খাবারের সময় হলে বুঝতাম। অন্যদের তুলনায় আমি বাংলা বলতে শিখেছি অনেক দেরিতে। আস্তে আস্তে ঐ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে লাগলাম। এভাবে অনেক বছর কেটে গেল।
গুরুজী দাদু দেখতে আসতেন আমাদেরকে। সালাম দেয়াটা দাদুর থেকেই শিখেছি। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিতেন।
পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। সময়টা আমার জন্যে কঠিন ছিল। আমার ছোট ভাইকে জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা গেলেন। এটা জানার পর থেকে সে-সময় আমার কোনোকিছুই ভালো লাগত না। প্রত্যেকটা নতুন দিন শুরু হতো আর মায়ের কথা মনে পড়ে যেত। মা হারানোর কষ্টে একা একা থাকতাম। কাউকে কিছু বলতাম না। এখনো মনে পড়ে সেই দিনগুলো।
তখন আমি তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না। ছোটবেলায় অনেক দুষ্টামি করতাম। ক্লাস সেভেনে থাকাকালে আমার জীবন একটা নতুন মোড় নিল। পড়ালেখায় অবহেলার কারণে আমি ফেল করি। দুবছর থাকতে হবে একই ক্লাসে। তখন মনে হলো, আগে কেন ভালো করে পড়ি নাই! নতুন ক্লাসের জুনিয়র সহপাঠীদের সাথে মিশতে হবে। মনে মনে লজ্জা পেলাম। বাবা বলেছিলেন, পড়ো ভালো করে। স্যার-ম্যাডামরাও অনুপ্রেরণা দিলেন, একবার ব্যর্থ হলেও নতুনভাবে স্বপ্নকে ছোঁয়া যায়।
আমি আবার শুরু করলাম। পেছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের লক্ষ্যের দিকে ছুটে চললাম। নতুনভাবে আত্মপর্যালোচনা করি যে, বড় হয়ে আমি কী হতে চাই।
এরপর আমি অষ্টম শ্রেণিতে একজন ভালো ছাত্র হিসেবে নিজের পরিচয় তৈরি করেছি। আগে ভাবতে পারি নি যে, এইরকম সাফল্য আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। শিক্ষকদের আন্তরিকতায় আমি অষ্টম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেলাম। সেই মুহূর্তটা আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছিল।
রেজাল্ট ভালো হওয়ায় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্যে আমি স্যারদের কাছে আবেদন করি। সেই থেকে আমার বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার নতুন যাত্রা শুরু। স্যার-ম্যাডামরাও আমাকে অনেক ভালবাসতেন। মনে মনে ভাবতাম—আমি অনেক ভাগ্যবান মানুষের মধ্যে একজন।
২০২১ সালে আমি এসএসসি-তে এ প্লাস পেলাম। আসলে আমার আপন ঘর এই কোয়ান্টামম। এখানে না এলে আমি বুঝতাম না যে, বঞ্চিত থেকেও সাফল্য অর্জন করা যায়। কোয়ান্টামের প্রতি আমার অনেক কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসা থাকবে আজীবন।
হাই স্কুলের জীবনটা অনেকে অনেকভাবে নিতে পারে। এটা হচ্ছে জীবনের প্রাথমিক স্তর যা কল্পনার শক্তিকে ব্যবহার, জ্ঞানার্জন ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করার সময়। এ সময়টা অবহেলার নয়।
এইচএসসি-তেও এ প্লাস পেলাম ২০২৩ সালে। কিন্তু এই পরীক্ষার আগমুহূর্তে আকস্মিকভাবে আমার দাদা পরলোকগমন করেন। তিনিই আমাকে কোয়ান্টামে নিয়ে আসার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন।
আমি আসলে প্রত্যন্ত অঞ্চল বান্দরবানের থানছি থেকে এসেছিলাম। তখন সেখানে তেমন কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। যাতায়াতের উপযোগী রাস্তাও ছিল না। হেঁটে অনেক দূরের পথ যেতে হতো। গহীন পথে ভয়ংকর হিংস্র জন্তুর দেখা পাওয়া যেত। সেখান থেকে আমার দাদা এবং বাবা আমাকে কোয়ান্টামে দিয়ে যান। আর বাৎসরিক ছুটিতে দাদাই বেশিরভাগ সময় আমাকে নিয়ে যাওয়া-আসা করতেন।
দাদার সাথে এই স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ছিল। তাই পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়াটা অনেক কষ্টের ছিল। এখনো অনেক মিস করি দাদাকে। তার অনুপ্রেরণায় আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল। তাকে এখনো অনেক ভালবাসি আমি। আমি থেমে না গিয়ে কষ্টকে সাফল্যে রূপ দিতে পেরেছিলাম। কারণ আমি ভাবতাম আমাকে ভালো করতে হবে।
এরপর আমার লক্ষ্যকে ছুঁয়ে দেখার উপলক্ষ এলো মেডিকেল অ্যাডমিশন জার্নি। আসলে মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন ছিল ছোট থেকে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা বলেছিলেন, বড় হয়ে তুমি ডাক্তার হবে। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। তোমার মায়ের মতো করুণ পরিণতির সম্মুখীন যেন তাদের হতে না হয়।
বাবার সেই কথাটা মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজকে বাবা অনেক খুশি। দাদা বেঁচে থাকলে আরো খুশি হতেন। তারা সবসময় চাইতেন আমি যেন নিজের সম্প্র্রদায়ের মানুষের জন্যে কাজ করি।
কিন্তু মেডিকেল ভর্তি কোচিং তো পরের কথা ফরম পূরণের সামর্থ্য আমার ছিল না তখন। কোয়ান্টাম কসমো কলেজেই আমার সবকিছুর ব্যবস্থা করা হলো। মাথায় চিন্তা আসত আমার দ্বারা সম্ভব হবে তো? নিজেকেই সব পড়তে হবে। তবে মেডিকেলে চান্স পাওয়া কামরুল ভাই, লালসেপঠা ভাইয়েরা তাদের সবটুকু দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে আমি কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। শিক্ষকেরাও আমাদের পাশে থেকে উৎসাহ দিতেন। জীবনে সঠিক নিয়মে কষ্ট করেছি বলেই আজ সঠিক জায়গায় আসতে পেরেছি।
আমি বর্তমানে পড়ালেখা করছি বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে। নিজেকে এই পর্যায়ে আনতে পেরে খুবই আনন্দবোধ করছি। ছোটবেলার স্বপ্নকে ছুঁতে পেরে অনেক ভালোলাগা কাজ করছে। মনে হয় যেন সবকিছুই সম্ভব।
আমার বাবা এখনো তার সামান্য উপার্জন দিয়ে পরিবারের সব খরচ বহন করছেন। ছোট ভাইবোনদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। চার ভাই চার বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। তাই আমাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
ভবিষ্যতে আমি ভালো ডাক্তার হতে চাই। একজন দক্ষ দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ হতে চাই। আমার জানা মতে, ম্রো সম্প্রদায়ের মধ্যে আমিই প্রথম সরকারি ডেন্টাল ইউনিটে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো সুচিকিৎসার অভাব। তাদের দুঃখ দেখার কেউ নেই। আমি সারাজীবন তাদের পাশে থাকতে চাই। কীভাবে তাদের পাশে থাকতে পারি, এটা নিয়ে আমি প্রায় সময় চিন্তা করি। আর আমি বিশ্বাস করি, আমি পারব। কারণ আমি শিখেছি, সব সম্ভব!
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]