বাংলাদেশি নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষা সৈনিক মমতাজউদদীন আহমদ।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ১৫৩তম (অধিবর্ষে ১৫৪তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৮৯৬ : বিশ্বের প্রথম বেতার যন্ত্রের নিবন্ধন করেন মার্কোনি।
১৯৯৯ : ভুটান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস প্রথমবারের মতো দেশটিতে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে।
১৮৪০ : টমাস হার্ডি, ইংরেজ সাহিত্যিক।
১৯২৩ : লয়েড শ্যাপলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত গণিত ও অর্থনীতিবিদ।
১৯৭৫ : ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু।
১৯৮১ : বাঙালি কথাশিল্পী ও ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন।
২০১১ : প্রখ্যাত সংবাদপাঠক, আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০১৯ : বাংলাদেশি নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষা সৈনিক মমতাজউদদীন আহমদ।
মমতাজউদদীন আহমদ ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ; যিনি এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেন। তার অভিনয় দর্শকদের হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে। তার লেখা মঞ্চ নাটকগুলো ঢাকার মঞ্চ নাটককে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তার লেখা টেলিভিশন নাটক কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসে। বাবার নাম কলিমুদ্দিন আহমদ ও মা সখিনা বেগম। মালদহ আইহো জুনিয়র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যস্ত লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
মমতাজউদদীন আহমদ ৩২ বছরের বেশি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষাদান করেছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও থিয়েটারের মাধ্যমে তার কর্মজীবনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এছাড়াও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি ১৯৭৭-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রখ্যাত এই নাট্যকারের লেখা– ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ ও ‘রাজা অনুস্বরের পালা’ বই দুটি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত। তার লেখা নাটক তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে।
তার লেখা সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটকের মধ্যে রয়েছে- ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’, ‘বকুলপুরের স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বর্ণচোরা’, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘সুখী মানুষ’, ‘বিবাহ’, ‘রাজার পালা’, ‘সেয়ানে সেয়ানে’, ‘কেস’, ‘উল্টোরঙ্গ’, ‘হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার’ ইত্যাদি।
টেলিভিশন ও বেতারের জন্যেও প্রচুর নাটক লিখেছিলেন তিনি। টেলিভিশনের জন্যে তার লেখা প্রথম নাটকের নাম ‘দখিনের জানালা’। তার লেখা ‘সহচর’ নাটকটি বিটিভির ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত নাটকের মধ্যে একটি। এই নাটকে তিনি স্কুল শিক্ষকের চরিত্রে অভিনয় করেও সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তার লেখা আরও একটি সাড়া জাগনো নাটক ‘কূল নাই কিনার নাই’। কাজী আবদুল ওয়াদুদের উপন্যাস থেকে নাটকটির নাট্যরূপ দিয়েছিলেন তিনি।
মমতাজউদদীন লেখা শতাধিক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, এক যে মধুমতী, সজল তোমার ঠিকানা, এক যে জোড়া, অন্ধকার নয় আলোর দিকে, সাহসী অথচ সাহস্য, মহানামা মহাকাব্যের গদ্যরূপ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে নিয়মিত কলামও লেখেন।
সফল নাট্যকার হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন ১৯৭৬ সালে। ১৯৯৭ সালে পান একুশে পদক। এছাড়াও আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কারসহ শিল্প ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্যে আঞ্চলিক পর্যায়েও বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।
তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা, লেখক ও অধ্যাপক। সেই সঙ্গে তিনি একজন ভাষা সৈনিক। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রবল। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। আপাদমস্তক সফল মানুষ। গুণী এই মানুষটি রাজধানী ঢাকাতে ২০১৯ সালের ২ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত