বাঙালি কবি, গীতিকার, ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এর জন্মদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ২০০তম (অধিবর্ষে ২০১তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৯২৫ : এডলফ হিটলারের ‘মাইন ক্যাম্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
১৯৫২ : গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধন।
১৯৭২ : বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মাল্টা ও ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র।
১৮৬৩ : দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বাঙালি কবি, গীতিকার, ও নাট্যকার।
১৮৯৩ : ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, রুশ এবং সোভিয়েত কবি, নাট্যকার, শিল্পী ও চলচ্চিত্র অভিনেতা।
১৮৯৪ : খাজা নাজিমুদ্দিন, পাকিস্তানের দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী।
১৮৯৯ : বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, বাঙালি সাহিত্যিক।
১৯০০ : শৈলজারঞ্জন মজুমদার, বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ, রবীন্দ্র সংগীত প্রশিক্ষক, রবীন্দ্র সংগীতের স্বরলিপিকার এবং বিশ্বভারতীর রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক।
১৯১৩ : অমল সেন, তেভাগা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।
১৯৩৬ : কাজী আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশি লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক, এবং জনপ্রিয় ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের স্রষ্টা।
১৯৩৮ : জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকর, ভারতীয় জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী।
১৯৪৩ : টমাস জন সার্জেন্ট, মার্কিন অর্থনীতিবিদ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।
১৯৫০ : কিংবদন্তি অভিনেত্রী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী।
১৯৭১ : গুয়েতেমালীয় কবি, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী রোমেলিয়া অ্যালারকন ফোলগার।
২০০০ : ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের নারী বিপ্লবী ও সাহিত্যিক কমলা দাশগুপ্ত।
২০০৮ : বাংলাদেশি কবি, কলামিস্ট ও লেখক সমুদ্র গুপ্ত।
২০১২ : বাংলাদেশি লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি.এল রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় পাঁচশ গান রচনা করেন। এই গানগুলো বাংলা সংগীত জগতে ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গান ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ’ ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। বেশ কয়েকটি নাটকও রচনা করেন তিনি। তার নাটকগুলো চার শ্রেণিতে বিন্যস্ত: প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। বাবা কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান। সে বাড়িতে বহু গুণীজনের সমাবেশ হতো। কার্তিকেয়চন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। এই বিদগ্ধ পরিবেশ বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়। তার মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল ও হরেন্দ্রলাল এবং এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যস্রষ্টা। পারিবারিক জীবনে তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আন্দুলিয়া নিবাসী প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন।
১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। এফ.এ পাস করেন কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ থেকে। পরে হুগলি কলেজ থেকে বি.এ এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম.এ পাস করেন। এরপর কিছুদিন ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জ্জি সেমিনারিতে শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান কৃষিবিদ্যা শিক্ষা করার জন্যে। রয়্যাল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় FRAS এবং MRAC ও MRAS ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। পরে তিনি দিনাজপুরে সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান।
কিশোর বয়সে লেখা গানগুলোতে প্রকৃতির মনোরম সৌন্দর্য ও লাবণ্য, জগতের শোক-জরাজাত দুঃখাবসন্নতা, ঈশ্বরভক্তি এবং স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে। এ পর্বের একটি গান হলো: ‘গগনভূষণ তুমি জনগণমনোহারী!/ কোথা যাও নিশানাথ, হে নীল নভোবিহারী!।’
উনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের প্রথমদিকে বাংলা গানের আধুনিকীকরণে যে পঞ্চ গীতিকবি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁদের অন্যতম। রবীন্দ্রযুগে বাংলা কাব্যসঙ্গীতে বিভিন্ন ধারা প্রয়োগ ও আধুনিক গান রচনায় তিনি ছিলেন একজন সার্থক রূপকার।
দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। তাদের ঘরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের যাতায়াত ছিল। এমন একটি পরিবেশে কৈশোরেই তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় ‘পূর্ণিমা সম্মেলন’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনার প্রতি তার ঝোঁক ছিল।
দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে জীবদ্দশায় প্রকাশিত আর্যগাথা (১ম ও ২য় ভাগ) ও মন্দ্র বিখ্যাত। নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind।
সাহিত্যে তার দেশপ্রেমের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। পাঠান-মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে দেশের ভারতীয় মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ের মর্মস্পর্শী বিবরণ বার বার তার নাটকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বিজেন্দ্র রচিত প্রহসন, কাব্যনাট্য, ব্যঙ্গ ও হাস্যরসাত্মক কবিতাও রয়েছে। জীবনের শেষ দশ বছর তিনি প্রধানত নাটক রচনা করেন। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক সব ধরনের নাটক রচনায়ই তিনি অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। হাস্যরসে তিনি অসামান্য পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। হাস্যরসে লেখা তার দুটি লাইন-
‘স্ত্রীর চেয়ে কুমীর ভাল বলেন সর্বশাস্ত্রী
ধরলে কুমীর ছাড়ে বরং, ধরলে ছাড়ে না স্ত্রী’।
দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা মানুষ; এজন্যে কর্মক্ষেত্রে তিনি অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুটা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসারের দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রজাদের স্বার্থে ছোটলাটের বিরোধিতা করতে কুণ্ঠিত হননি।
১৯১৩ সালের ১৭ মে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত