বাংলাভাষার প্রথম প্রাণপুরুষ আইনজীবী, সমাজকর্মী ও ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ৩০৬তম (অধিবর্ষে ৩০৭তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৭৭২ : মর্নিং পোস্ট পত্রিকার প্রথম প্রকাশ।
১৮৭৬ : কেশবচন্দ্র সেনের উদ্যোগে ‘ইন্ডিয়ান রিফর্মার অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সংস্কার সভা’ স্থাপিত হয়।
১৯৪৯ : ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। এর আগে দেশটি সাড়ে তিনশ বছর ধরে হল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল।
১৮৩৩ : মহেন্দ্রলাল সরকার, ভারতীয় চিকিৎসক ও অধ্যাপক।
১৮৬৫ : ওয়ারেন জি. হার্ডিং, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৯তম রাষ্ট্রপতি।
১৮৮৬ : বাংলাভাষার প্রথম প্রাণপুরুষ আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯০৯ : অরুণ মিত্র, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা কবি ও ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও অনুবাদক।
১৯২৯ : রিচার্ড এডওয়ার্ড টেইলর, নোবেলজয়ী কানাডীয়-মার্কিন পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ।
১৯৩৫ : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক ও গল্পকার।
১৮১৮ : বিখ্যাত ব্রিটিশ আইন সংস্কারক স্যামুয়েল রোমিলি।
১৯৫০ : নোবেলজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’।
১৯৬৬ : নোবেলজয়ী ডাচ বংশোদ্ভূত আমেরিকান পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ পিটার জোসেফ উইলিয়াম ডিবাই।
১৯৭৪ : বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও লেখক বরকতউল্লাহ।
জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান এবং মরণোত্তর দিবস।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বাংলাভাষার প্রথম প্রাণপুরুষ আইনজীবী, সমাজকর্মী ও ভাষা সৈনিক। দেশ বিভাগের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত অংশে এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে সক্রিয় ছিলেন।
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন বাংলা প্রদেশের ত্রিপুরা জেলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে। বাবা জগবন্ধু দত্ত ছিলেন কসবা ও নবীনগর মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার। স্ত্রী সুরবালা দাস। তাদের ঘরে সাত মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে সঞ্জীব দত্ত লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ধীরেন্দ্রনাথ পড়াশোনা করেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কুমিল্লা কলেজ থেকে এফ.এ, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ থেকে বি.এল পরীক্ষা পাস করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ বছরখানেক কুমিল্লার মুরাদনগর বাঙ্গুরা উমালোচন হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আইন ব্যবসা করার জন্যে ১৯১১ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা বারে যোগদান করেন। ১৯০৭ সালে ‘ত্রিপুরা হিতসাধনী সভা’র সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ১৯১৫ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কাজে অংশগ্রহণ করেন।
মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণে তিনি ‘মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা গঠন করেন। কুমিল্লার সুপরিচিত জাতীয়তাবাদী সংগঠন অভয় আশ্রম-এর কর্মকাণ্ডের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন এবং ১৯৩৬ সালে ত্রিপুরা (বর্তমানে কুমিল্লা) জেলা বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং ব্যারিস্টার আবদুর রসুলের রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে তিনি তিন মাসের জন্যে আইন ব্যবসা স্থগিত রাখেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন, বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনী আইন পাসের সাথে ধীরেন দত্ত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দেন। ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের জন্যে তিনি বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে বিভিন্ন কারাগারে বিনাশ্রম ও সশ্রম দণ্ড ভোগ করেন।[৬]
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের টিকিটে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্যে ওই বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ থেকে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলির জন্যে ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবি নাকচ করে দেন।
১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তখন থেকে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। এতদসত্ত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী অ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদানের জন্যে ১৯৯৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার’ হিসেবে তাকে ‘ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
এছাড়াও কুমিল্লা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বিশিষ্ট সংসদ সদস্য ও আইনজীবী হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে রাস্তার নামকরণ করে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন সড়ক পর্যন্ত রাস্তাটি এখন থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক নামে পরিচিত।
১৮ জুলাই ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তার নামে একটি ই-লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যলয়ে ওই বছরই ছাত্রদের জন্যে ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল’ নামে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম।
সূত্র: সংগৃহীত