বাংলাদেশি কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এর মৃত্যুদিন
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে আজ বছরের ২৪৬তম (অধিবর্ষে ২৪৭তম) দিন। এক নজরে দেখে নিই ইতিহাসের এই দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা, বিশিষ্টজনের জন্ম ও মৃত্যুদিনসহ আরও কিছু তথ্যাবলি।
১৮৬৬ : জেনেভায় কার্ল মার্কসের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
১৮৭৫ : পোলো প্রথম অফিশিয়াল খেলা পরিচয় হওয়ার পরে আর্জেন্টিনায় খেলা হয়।
১৯৬৭ : সুইডেনে ডেগেন এইচ: ড্রাইভিংয়ে সুইডেনে বাম-হাত থেকে ডান-হাতের ট্র্যাফিকে স্থানান্তর করা হয়।
১৮৫৬ : লুইস হেনরি সালিভ্যান, মার্কিন স্থপতি।
১৮৬৪ : ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, ভারতীয় বাঙালি দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও আচার্য।
১৮৯৯ : ফ্র্যাঙ্ক ম্যাকফারলেন বার্নেট, অস্ট্রেলীয় জীববিজ্ঞানী, নোবেল বিজয়ী।
১৯০৫ : কার্ল ডেভিড অ্যান্ডারসন, মার্কিন পরীক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞানী, নোবেলজয়ী।
১৯২৬ : মহানায়ক উত্তম কুমার, ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি অভিনেতা।
১৯৭১ : কিরণ দেশাই, ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাহিত্যিক, ম্যান বুকার পুরস্কার বিজয়ী।
১৮৮৩ : রাশিয়ার লেখক ইভান তুর্গেনেভ।
১৯৩৩ : ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদ বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত।
১৯৬২ : মার্কিন কবি ই ই কামিংস।
১৯৯৮ : ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা অনুপ কুমার।
২০০৭ : ভারতীয় বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী অশেষ প্রসাদ মিত্র।
২০০৮ : বাংলাদেশি কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান।
২০১৮ : বাংলাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী।
আন্তর্জাতিক সিডও (CEDAW) দিবস। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। এরপর থেকেই এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো প্রতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সিডও দিবস হিসেবে পালন করে।
ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ছিলেন একজন বাংলাদেশি কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। তার আরেক ভাই প্রখ্যাত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ১৫ আগস্ট যশোর শহরের খড়কী পাড়ায়। বাবা মোহাম্মদ শাহাদাত আলী। মায়ের নাম রাহেলা খাতুন।
আট ভাইয়ের মধ্যে মনিরুজ্জামান ছিলেন সবার বড়। স্ত্রীর নাম রাশিদা জামান। এ দম্পতির একমাত্র মেয়ে রুহিনা হাসমিন জামান করিম।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান যশোর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ১৯৫৮ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে, ব্রিটিশ কাউন্সিল বার্সারি বৃত্তি নিয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন।
এমএ পাস করেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথমে শিক্ষক-ফেলো, পরে লেকচারার পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৮-৮১ সালে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান দৈনিক মিল্লাত (১৯৫২) পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্য-গবেষণা এবং কবিতা লেখা ছিল তার নেশা। কিছুকাল তিনি বাংলাদেশের লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনায় আগ্রহ দেখালেও পরে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সময় তিনি বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। তিনি পনেরো বছর (১৯৭৮-৯৩) এ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।
আধুনিক কাহিনীকাব্যে মুসলিম জীবন ও চিত্র (১৯৬২) তার প্রথম গবেষণাগ্রন্থ। তিনি ১৯৬৯ সালে ‘আধুনিক বাংলাকাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬৯-৭০ সালে লন্ডন বিশ্বাবদ্যালয়ের School of Oriental and African Studies-এ Post-Doctoral গবেষণা করেন।
গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও তার দায়িত্ব ও নিষ্ঠা উল্লেখ করার মতো। অধ্যাপনাকালে তার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন চল্লিশজন গবেষক।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লন্ডনের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি ও ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির ফেলো মনোনীত হন এবং এদেশের দুটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান- বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও বাংলা একাডেমীর জীবন সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৮২ সালে। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৬-৮৭ বর্ষে রোটারি আন্তর্জাতিক (৩২৮/বাংলাদেশ)-এর গভর্নর পদে নির্বাচিত হন।
প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে সৃজনশীলতায় মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন পঞ্চাশের দশকের কাব্যসাহিত্যের একজন অন্যতম প্রধান কবি। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলায় সমকাল (১৩৬৪) পত্রিকার মধ্য দিয়ে নতুন একটি কবিগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। এ কবিগোষ্ঠীর অন্যতম ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। নিসর্গপ্রীতি, মানবপ্রেম, দেশাত্ববোধ, নাগরিক জীবনের জটিলতা তার কবিতার বিষয়বস্তু।
‘কবিতায় আর কী লিখব?/ যখন বুকের রক্তে লিখেছি/ একটি নাম/ বাংলাদেশ।’ এমন প্রত্যয়দীপ্ত কাব্য পঙ্ক্তি মোহাম্মদ মনিরুজ্জানের কবি-সত্তাকে স্বাতন্ত্র্য রূপ দিয়েছে, যাতে স্বাজাত্যবোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার শিল্পী-মন। এটা লক্ষ করা যায় তার রচিত অসাধারণ সুন্দর গানেও।
আধুনিক গান রচনায় তার ভূমিকা অনন্য। তিনি চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক এবং দেশাত্মবোধক গান রচনা করে বাঙালি শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় ও সম্মানিত হয়েছেন। বলা যেতে পারে গান রচনার জন্যেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতিতে স্মরণীয় হবেন দীর্ঘদিন। তার জননন্দিত একটি গানের কয়েক পঙ্ক্তি
‘আমার দেশের মাটির গন্ধে/ ভরে আছে সারা মন/ শ্যামল কোমল পরশ ছাড়ায়ে/ নেই কিছু প্রয়োজন।’
স্বদেশের সরস মাটির গন্ধ যেন তার ভাষায় বাণীমূর্তি লাভ করেছে। এছাড়াও প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে, হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়ের মতো বহু গান রচনা করেছেন তিনি। অনির্বাণ ও নির্বাচিত গান তার গানের সংকলন।
কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে : দুর্লভ দিন, শঙ্কিত আলোকে, বিপন্ন বিষাদ, ভালবাসার হাতে, ভূমিহীন কৃষিজীবী ইচ্ছে তার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কাব্য সংগ্রহ, Selected Poems (Honolulu,1979) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কবি ও গীতিকার হিসেবে বিখ্যাত হলেও সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে- সম্পাদনা, অনুবাদ, গবেষণায়ও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সব মিলে তার গ্রন্থ-সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তার অনূদিত গ্রন্থ: এমিলি ডিকিনসনের কবিতা, ইউজিন ও’নীলের জাম্বুবান (দি হেয়ারি এপ); গবেষণা-গ্রন্থ : আধুনিক বাংলা সাহিত্য, আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, বাংলা কবিতার ছন্দ, বাংলা সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা, সাময়িকপত্রে সাহিত্য চিন্তা: সওগাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ইতিহাস; সম্পাদিত গ্রন্থ, ঢাকার লোককাহিনী, নজরুল সমীক্ষণ, যশোরের লোককাহিনী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচনাবলী (১ম ও ২য় খণ্ড), মুহম্মদ এনামুল হক স্মারকগ্রন্থ, সৈয়দ আলী আহসান সংবর্ধনা গ্রন্থ, আবদুল গনি হাজারী রচনাবলী ইত্যাদি।
অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আত্মগোপনে থাকার কারণে ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং ‘বি’ জোনের সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান এক ফরমান জারি করে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন এবং ছয় মাস কারাদন্ড ঘোষণা করেন। এসব সত্ত্বেও তিনি গভীরভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনড় থাকেন।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে লন্ডনের International Who’s Who in Poetry তাকে ‘Certificate of Merit for Distinguished Contribution to Poetry’ প্রদান করে। তিনি ১৯৭২ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার। ১৯৮৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করে।
বহু গুণে গুনান্বিত এই মানুষটি ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী ঢাকাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: সংগৃহীত