যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমার একটা পছন্দের খাবার ছিল শুঁটকি মাছ। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসত। আর আমি বাড়িতে না ফিরে উঠানে খেলতাম। তখন মা করত কী—শুঁটকি পুড়িয়ে কড়া একটা ঘ্রাণ বাতাসে ছড়িয়ে দিত। আমি সবকিছু রেখে বাড়িতে দৌড় দিতাম। এটা আমার মায়ের সহজসরল একটা পদ্ধতি ছিল নিজের সন্তানকে কাছে টেনে নেয়ার।
আমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে গল্পের আসর বসত। পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে বসে যেত। দেখতাম সবার হাতে একটা করে ছোট পানের কৌটা। কিছুক্ষণ পর পর পানের বোটা ছাড়িয়ে সুপারি আর চুন দিয়ে সুন্দর একটা আকৃতি তৈরি করে চোখ বন্ধ করে চিবোচ্ছে আর গল্প করছে। এভাবে কিছুক্ষণ চিবানোর পর যখন সেগুলো লাল রসে পরিণত হতো তখন সেই পানের পিকটার জায়গা হতো বাড়ির বিভিন্ন কোণায়। আমি অবশ্য বড়দের গল্পের কিছুই বুঝতাম না। মাথাটা মায়ের কোলে রেখে মায়ের পান তৈরি করা দেখতাম আর বড়দের গল্প করার ভঙ্গি দেখতে দেখতে সেখানেই ঘুমিয়ে যেতাম। পরের দিন সকালে দেখতাম মায়ের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে অথবা মাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছি। এভাবে চলে যাচ্ছিল দিন, সপ্তাহ, মাস ও বছর।
তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মা আমাদের সবাইকে রেখে পরলোকগমন করেন। সেই থেকে আমার ঘুম, শান্তির ঠিকানা মিলিয়ে যায়। মায়ের একটা কোলের জন্যে ছোট বোন আর আমার ঝগড়া, রাগ-অভিমান সব আজ শুধুই স্মৃতি। এরপরে নয়-দশটা বছর কেটে গেল। আজকের দিনের আগের প্রত্যেকটা মুহূর্তও অতীত। তবুও মায়ের মৃত্যুর দিনটি এবং পরের দিনগুলোকে অতীত বলে মেনে নিতে পারি না। যদি কখনো কোনো সূর্যোদয়, ক্লান্ত অলস দুপুর অথবা পড়ন্ত বিকেলে অতীত মনে করিয়ে দেয়, তাহলে মায়ের আদরের স্মৃতিগুলোই মনের অধিকাংশ স্থান জুড়ে থাকে। বাকি স্থানে থাকে কোয়ান্টামমে শৈশবে বন্ধুদের সাথে স্কুলে কাটানো দিনগুলো।
আমি ছোটবেলা থেকে খুব একগুঁয়ে। সবার সাথে তেমন মিশতে পারি না। কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতেই ভালো লাগত। সেই কল্পনার রঙ মিশিয়ে ছবি আঁকতে ভালো লাগত। যদিও সেই ছবিগুলো কোনোদিন কেউ নেড়েচেড়ে দেখত না। ছবি আঁকা, বিভিন্ন খেলার উপকরণ বানানো—এসব ছিল আমার পছন্দের বিষয়। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন থেকে একটা লক্ষ্য ঠিক করেছি—পৃথিবী বিখ্যাত একজন ভাস্কর হবো। তার জন্যে আমাকে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া দরকার। আমি সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করলাম। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও হয়ে গেল। আসলে আজ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তার পেছনে ছোট্ট একটা কাহিনী বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
এর আগে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আলাদা থাকতেন। আমার সম্পত্তি হিসেবে ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। এখন তো সেটাও প্রতিবেশীদের গোয়াল ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবারে চার বোন ও আমি একমাত্র ভাই। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এদিকে আমি আর ছোট বোন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুল-কলেজে দৌড়াচ্ছি। এইচএসসি পরীক্ষার পর আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল কী করব? যদি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হই তাহলে নিজের খরচ নিজেকেই চালাতে হবে। আর যদি চাকরি করি তাহলে পড়ালেখা ছাড়তে হবে।
কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি পড়ি, তাহলে ভর্তি ফি কে দেবে? তাছাড়া আমার পরিবারে এমন কেউ ছিল না যে, আমার পড়ালেখার খরচ বহন করবে। বুঝতে পারছিলাম না কী করব! তখন মাথায় একটা চিন্তা এলো, যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি, তাহলে সব সমস্যার সুন্দর সমাধান হবে। সে আশায় প্রস্তুতি শুরু করলাম এবং চান্স পেয়ে ভর্তিও হয়ে গেলাম। আমি আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারতাম না যদি কোয়ান্টাম পাশে না থাকত। আমার এই অনুভূতি হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না।
আমি ছোটবেলা থেকেই বাবার কোনো আত্মীয়স্বজনকে কাছে পাই নি। আমাদের বাড়ি ছিল মায়ের এলাকায় অর্থাৎ নানার গোত্রের মানুষেরা যেখানে বাস করে। আজ এত দূর এসেছি, বাবার জন্মস্থানে কেবল একবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু সেদিন হয়েছে কী—বাজারে বসে এলাকার বন্ধুদের সাথে গল্প করছিলাম। হঠাৎ একটা মাঝবয়সী ছেলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে আমি হাস্তরাম কিনা? আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ও তখন বলল, সে নাকি আমার দূর সম্পর্কের ভাই। বাবার ভাইয়ের ছেলে। আমি মনে মনে ভাবছি অন্য কিছু, এতদিন যাকে চিনতামও না, সে-ও আজ আমার আত্মীয় ভাই হয়ে গেল। দুনিয়াটা আসলেই বিচিত্র!
আমি ছোট থেকেই কোয়ান্টামে বেড়ে উঠেছি। এককথায় কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের প্রত্যেকটা ধূলিকণা যেন আমাকে চিনে। কারণ ১৫-১৬টা বছর আমি এখানে থেকেছি।
মাঝে মাঝে গভীর রাতে একাকী বসে অতীতে হানা দিই। আমি বেশি কথা বলতে পারি না। কিন্তু এর একটা উপকারও পেয়েছি। কথা বলতে ভালো না লাগার কারণে বেশি করে ভাবার সুযোগ পাচ্ছি।
বেশি ভালো লাগে কোনো বইয়ের গল্পের রাজ্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে। যখন কোনো শিল্পীর ছবি অথবা ভাস্কর্য দেখতাম, তখন সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার কল্পনাতে কাহিনী তৈরি হয়ে যেত। এভাবেই শিল্প ও নান্দনিকতার সাথে পথ চলা শুরু। তাই ছোটবেলার স্বপ্নটা এখনো জেগে আছে—পৃথিবীর বিখ্যাত একজন ভাস্কর হবো। আমার কাজের জন্যে মানুষ আমাকে মনে রাখবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মানুষের হৃদয়ে উষ্ণ আলো হিসেবে বেঁচে থাকব আমি। সেই লক্ষ্যেই অটল আছি।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]