মৃত্যু-ই বলে দেয়- জীবন কতটা তৃপ্ত বা অতৃপ্ত!
একজন মানুষ সফল না ব্যর্থ এটা বোঝা যায় তার মৃত্যু থেকে যে, সে চমৎকারভাবে হাসতে হাসতে মারা যেতে পারে, না কানতে কানতে কাতরাতে কাতরাতে মারা যাচ্ছে! এটা থেকে বোঝা যাবে যে, তার জীবন আসলে কতটা তৃপ্ত বা অতৃপ্ত।
এপিজে আব্দুল কালাম ছোটবেলাতে তিনি কী করেছেন? তিনি তার লক্ষ্যটাকে স্থির করেছেন। যে কারণে তার জীবনটা খুব সহজ ছিল। আসলে যে-কোনো মানুষ যদি তার জীবনের লক্ষ্যস্থির করতে পারে তাহলে তার জীবন চলাটা খুব সহজ হয়ে যায়। কারণ লক্ষ্যটা তখন তার বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় এবং একজন বিশ্বাসীর জীবন খুব সহজ।
তো আসলে তিনি কী করেছেন? তিনি তার জ্ঞান নিয়েছেন বই থেকে, গ্রন্থ থেকে। আসলে সাধনার ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলতি রয়েছে যে, ভক্ত যখন তৈরি হয়, গুরু তখন নিজে ধরা দেন। কখনো সেই গুরু ব্যক্তি হতে পারেন, সেই গুরু গ্রন্থ হতে পারে, সেই গুরু কোনো বাণী হতে পারে।
তো এপিজে আব্দুল কালাম তিনি চারটা বইয়ের কথা তার দ্য ইগনাইটেড মাইন্ড বইতে উল্লেখ করেছেন যে, এই চারটা বই সবসময় আমার অন্তরে ছিল। এই চারটা বইয়ের যে আলো, এই আলো আমাকে সবসময় এগিয়ে নিয়ে গেছে।
তার মধ্যে একটা বইয়ের কথা- ম্যান দ্য আননোন। ডক্টর এলেকসিস ক্যারল তার লেখা। তিনি ডাক্তার ছিলেন, দার্শনিক ছিলেন।
এবং এলেকসিস ক্যারল খুব চমৎকারভাবে বলেছেন যে, রোগ হলে, অসুখ হলে শুধু দেহের চিকিৎসা করলে হবে না। আমাদের তো আসলে এখন শুধু সিম্পটমসগুলো চিকিৎসা করা হয়। দেহমনের সমন্বয় চিকিৎসা হতে হবে।
কারণ মানুষের শরীর কোনো মেকানিক্যাল সিস্টেম না, এটা কোনো যন্ত্র না, এটা হচ্ছে একটা খুব ইনটেলিজেন্ট অর্গান। যার ফিডব্যাক সিস্টেমটা খুব চমৎকার। এটা একটা ইনটেলিজেন্ট অর্গান। মনের যে-রকম নিজস্ব বুদ্ধি রয়েছে, শরীরেরও নিজস্ব বুদ্ধি রয়েছে। কারণ শরীরের অনেককিছু চলে অটোমেশনে, অটোমেটিক হিসেবে।
তার দুই নম্বর গ্রন্থ- থিরুক্কুরাল। তো থিরুক্কুরাল এটা হচ্ছে তামিল জ্ঞানগ্রন্থ। ধর্মগ্রন্থ বলতে পারেন, জ্ঞানগ্রন্থ বলতে পারেন। আগে ধর্মগ্রন্থগুলোর বাণীও ছিল ছোট ছোট। বেদ দেখেন, গীতা দেখেন, ধম্মপদ দেখেন, সব ছোট ছোট বাণী। এই ছোট ছোট বাণীর সমন্বয়ে এটাকে আপনি তামিল গীতা বলতে পারেন।
এবং তিনি লিখেছেন যে, তিন নম্বর বই যা ৫০ বছর আমাকে জীবনযাপনের যে প্রবাহ প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেছে সেটা হচ্ছে- লাইট ফ্রম মিনি ল্যাম্পস, লিলিয়ান ওয়াটসনের।
এবং তারপরে উপসংহার টেনেছেন এন্ড দ্য হলি কোরআন ইজ অফকোর্স কনস্ট্যান্ট কমপেনিয়ান। তিনি যেখানেই যেতেন কোরআন সাথে নিয়ে যেতেন।
আমাদের দেশে যদি কেউ বিজ্ঞানী হন, তিনি যে গীতা পাঠ করেন এটা বলতে সংকোচবোধ করেন। তিনি যে কোরআন পাঠ করেন এটা বলতে সংকোচবোধ করেন, যে তাতে তার বৈজ্ঞানিকতার জাত যাবে, বৈজ্ঞানিকতার জাত যাতে না যায় আরকি!
কিন্তু এপিজে আব্দুল কালাম কোনো সংকোচবোধ করেন নাই। আসলে তিনি সমস্ত সংকোচবোধের ঊর্ধ্বে ছিলেন। কারণ তিনি সবসময় যা সত্য, নিঃসংকোচে তিনি বলতেন।
আসলে তিনি এত উচ্চতায় যাওয়ার পরেও এত বিনয়ী কেন রাখতে পেরেছিলেন? রাখতে পারার কারণ ছিল তার স্বপ্ন, তার ভাবনা এটা তিনি বিশ্বাসে রূপান্তরিত করেছিলেন। তার স্বপ্ন, তার ভাবনা শুধু স্বপ্ন, ভাবনা থাকে নাই, এটা তার বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছিল। যার ফলে তিনি খুব সহজ স্বতঃস্ফূর্তায় বিকশিত হয়েছেন।
আসলে যাদেরই স্বপ্ন, যাদেরই ভাবনা বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় তাদের সাকসেস কেউ আটকে রাখতে পারে না।
ধরুন, পাবলো পিকাসোর গুয়ের্নিকা নাজি বা ফ্যাসিস্ট যুদ্ধ বিরোধী বিখ্যাত দেয়াল চিত্রটা আঁকা হয়- স্পেনিশ গৃহযুদ্ধকে নিয়ে যখন স্পেনিশ রিপাবলিকানদের সাথে ফ্রাঙ্কো যিনি স্পেনের ডিক্টেটর ছিলেন ৪০ বছর, তাদের যুদ্ধ হয়। এবং সেই যুদ্ধে ফ্রাঙ্কোর পক্ষে হিটলারের বিমানবাহিনী এবং সেনাবাহিনীও সহায়তা করে সেইসময়।
পাবলো পিকাসো, তার ব্যক্তি জীবন কিন্তু অনেক টালমাটাল, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা, অনেককিছু। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি সবসময় ছিলেন আপসহীন। গুয়ের্নিকা নিয়ে কথা আছে যে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্স এক একটা অংশ এবং প্যারিস, জার্মান নাজি বাহিনীর দখলাধীন ছিল।
তো পিকাসো তখন ফ্রান্সে ছিলেন। তো একদিন এক জার্মান নাজি অফিসার তার স্টুডিওতে এসেছেন। তো গুয়ের্নিকার ছবি ছিল তার স্টুডিওতে। তো দেখে জিজ্ঞেস করছেন, ইউ হ্যাভ ডান ইট? তুমি এটা করেছ? তো পিকাসো মানে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে যে, না। ইউ হ্যাভ ডান ইট! তোমরা যুদ্ধের যে বিভীষিকা করেছ সেটারই চিত্র হচ্ছে এটা। আমি এটা করি নাই, তুমি এটা করেছ।
তো এই যে একজন জার্মান নাজি অফিসারের সামনে এই যে কথা বলতে পারার যে সাহস এই সাহস যদি স্বপ্নটা বিশ্বাসে রূপান্তরিত না হয় এটা কখনো হয় না। একজন মানুষ ভাবনার জন্যে নয় সে তার বিশ্বাসের জন্যে জীবন দিতে কুণ্ঠিত হয় না। ভাবনাটাকে সবসময় বিশ্বাসে রূপান্তরিত করতে হবে। এটা হচ্ছে ইম্পর্টেন্ট।
[প্রজ্ঞা জালালি, ০৫ অক্টোবর ২০২৪]