আসসালামু আলাইকুম। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
প্রিয় সুহৃদ! আজকের বিশেষ সাদাকায়নে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
এবং পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে তিনি ২৩তম কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন সম্পন্ন করে আজকে আখেরি দোয়ায় একাত্ম হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এটি তাঁর দয়া এটি তাঁর করুণা এটি তাঁর মেহেরবানি।
কারণ তিনি আমাদেরকে হেদায়েতের পথ সাফল্যের সরল পথ দেখিয়েছেন বলেই আমরা কোরআন অনুধাবন ও আত্মস্থ করার জন্যে সঠিক পথে পা বাড়াতে পেরেছি।
আসলে কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা যেমন ফরজ, একইভাবে সেই জ্ঞান অনুশীলন করার চেষ্টা করাও ফরজ। আপনি ততটাই অনুসরণ করতে পারবেন যতটা আপনি চেষ্টা করবেন।
এবং যতটা আপনি একাত্ম হতে পারবেন, যত আপনি এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, কোরআন অনুসরণ করার মধ্য দিয়ে আমার কল্যাণ আমার মঙ্গল আমার ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য তত আপনি ভেতর থেকে উদ্বুদ্ধ হবেন।
তত কোরআন আপনার গভীরে আপনার ভেতরে প্রবেশ করবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগ্রহ অনুভব করবেন কোরআনের দিকনির্দেশনা অনুসরণের।
আর তখনই আপনি কোরআনের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন যখন আপনি আত্মনিমগ্ন হবেন। আর এই আত্মনিমগ্ন হওয়ার পথই হচ্ছে ধ্যানের পথ।
এবং এইজন্যে পৃথিবীতে যত ধর্ম এসছে প্রতিটি ধর্মই ধ্যানকে আত্মউপলব্ধির আত্মনিমগ্নতার পথ হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছে।
এইজন্যেই পবিত্র কোরআনে তাদাব্বুর বা গভীর ধ্যান কথাটিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সূরা সাদ সূরা নিসা সূরা মুহাম্মদ সূরা মুমিনুন এই চারটি সূরায় তাদাব্বুর বা গভীর ধ্যান কথাটি চার বার এসছে।
সূরা সাদের ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, হে নবী! আমি তোমার ওপর এই কল্যাণময় কিতাব নাজিল করেছি, যাতে মানুষ এই কোরআনের বাণী নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়! (সেইসাথে সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে) এর শিক্ষা অনুসরণ করে।
গভীর ধ্যান বোঝাতে কোরআনে তাদাব্বুর এবং তাফাক্কুর দুটি শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে।
সূরা সাবায় ৪৬ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, (হে নবী! ওদের) বলো, ‘আমি তোমাদের একটিমাত্র পরামর্শ দিচ্ছি, এককভাবে বা যৌথভাবে আল্লাহর সামনে সচেতন হয়ে দাঁড়াও। নিজের গভীরে ধ্যানে নিমগ্ন হও। (তাহলেই উপলব্ধি করতে পারবে)।
আসলে ধ্যানের পথ আত্মনিমগ্নতার পথ।
এবং এইজন্যেই আধুনিককালের একজন খুব বড় ফকিহ আল্লামা শেখ ইউসুফ আল কারযাভী ধ্যানকে উচ্চস্তরের ইবাদত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি ধ্যানের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, ধ্যানকে বলা যায় বিন্যাস বা আকারহীন ইবাদত। যা স্থান বা কাল দৃশ্যমান বা অদৃশ্য কোনোকিছু দিয়েই বাধাগ্রস্ত হয় না।
আরেকজন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক মালিক বদরী তার কনটেমপ্লেশন এন্ড ইসলামিক সাইকো-স্পিরিচুয়াল স্টাডি- এই বইতে তিনি বলেছেন, যে, একজন মুসলমান নিজেকে নিয়ে, স্রষ্টার সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে নিমগ্ন হলে আল্লাহর রহমতে অন্য ধ্যানীদের চেয়ে উচ্চতর উপলব্ধিতে উপনীত হবেন।
এবং ধ্যান উচ্চস্তরের ইবাদত বলেই নবীজী বলেছেন, একঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
প্রিয় সুহৃদ! ধ্যান এবং মৌনতা এটাই একজন মানুষকে যথার্থ জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার পথে নিয়ে যেতে পারে।
এবং এইজন্যেই নবীজী (স) বলেছেন যে, প্রজ্ঞার পথ হচ্ছে মৌনতা। মৌনতাকে অত্যন্ত ওজনদার আমল হিসেবে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যা আমরা গত সাদাকায়নে উল্লেখ করেছি।
ইমাম গাজ্জালী তার এহইয়া উলমুদ্দিনে হেকিম লোকমান প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লিখেছেন যে, হেকিম লোকমান মাঝে মাঝেই সবার থেকে আলাদা হয়ে একা মৌনতা ও ধ্যানের মাঝে ডুবে যেতেন।
তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আপনি প্রায়শই একা মৌন থাকেন। মানুষজনের সাথে মেলামেশা করে তাদের সাথে কথা বলা আপনার জন্যে কি আরো কল্যাণকর হতো না?
লোকমান হেকিম এর জবাবে বলেছিলেন যে, দীর্ঘসময় একা মৌন থাকা গভীর ধ্যানের জন্যে অত্যন্ত সহায়ক। আর দীর্ঘসময় গভীর ধ্যানে যদি নিমগ্ন থাকা যায় তাহলে তা মানুষকে জান্নাতের পথে নিয়ে যায়।
হেকিম লোকমান নবী ছিলেন না। কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন ক্রীতদাস ছিলেন। লোকমান হেকিমের বিচক্ষণতার পরিচয় পেয়ে তার মনিব তাকে আজাদ করে দেন।
প্রচলিত আছে যে, আল্লাহ তাকে নবুয়ত অথবা প্রজ্ঞা- এর মাঝে যে কোনো একটি বেছে নেয়ার প্রস্তাব দেন।
লোকমান প্রজ্ঞা বেছে নেন এবং তিনি প্রজ্ঞায় অভিষিক্ত হন।
এবং নবী না হওয়া সত্ত্বেও কোরআনের একটি সূরার নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। এ থেকেই বোঝা যায় যে, পরম করুণাময়ের কাছে তার মর্যাদা কত উঁচুতে। দীর্ঘ মৌনতা দীর্ঘ ধ্যানের পথ ধরেই তিনি প্রজ্ঞা এবং এত উঁচু মর্যাদায় অভিষিক্ত হন।
দীর্ঘসময় মৌনতা পালন করা ধর্মপরায়ণতার জন্যে যে কত গুরুত্বপূর্ণ এটাও আমরা নবীজীর (স) আরেকটি হাদীস থেকে খুব পরিষ্কার বুঝতে পারি।
আবু যর গিফারী বর্ণিত বায়হাকি শরীফের হাদীস যে, তুমি দীর্ঘ মৌনতা পালন করো। দীর্ঘ মৌনতা শয়তানকে তোমার কাছ থেকে দূরে তাড়িয়ে দেয় এবং তোমার ধর্মপরায়ণতা জোরদার করে।
ধ্যানের গুরুত্ব সম্পর্কে নবীজীর (স) একটি মন্তব্য দুদিন আগে দেখলাম এবং চমকিত হলাম।
আল্লামা উসমান নুরী তার কনটেমপ্লেশন ইন ইসলাম বইতে বায়হাকির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, আল্লাহর রসুল বলেছেন, There is no worship like contemplation.
অর্থাৎ গভীর ধ্যানের তুল্য কোনো ইবাদত নেই। আসলে আপনি যখন গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হবেন তখন আপনি আপনার আসল সত্তা আত্মার সাথে সংযুক্ত হবেন।
এবং আপনি অস্তিত্বের সেই ফ্রিকোয়েন্সিতে পৌঁছে যেতে পারবেন যেখানে প্রজ্ঞার নিবাস- যেখানে স্রষ্টার কাছ থেকে সরাসরি বাণী লাভের স্তর।
আসলে এই স্তরে পৌঁছাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দুটি মোবাইল সংযুক্ত হয় যদি নেটওয়ার্ক না থাকে দুটি মোবাইল যত ভালো থাকুক তারা কানেক্টেড হতে পারে না।
একইভাবে স্রষ্টার সাথে ভাবের আদান-প্রদান করা যায় যদি আত্মার স্তরে কানেকশন সৃষ্টি করা যায়। এবং গভীর ধ্যান সেই স্তরটাই সৃষ্টি করে।
এবং এইজন্যেই হয়তো আল্লাহর রসুল বলেছেন যে, ধ্যানের তুল্য কোনো ইবাদত নেই।
আমরা পরম করুণাময়ের কাছে সমস্ত জ্ঞানের যিনি উৎস সমস্ত প্রজ্ঞার যিনি উৎস সমস্ত শক্তির যিনি উৎস সমস্ত নিরাময়ের যিনি উৎস সমস্ত কল্যাণের যিনি উৎস তাঁর কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, গত শুক্রবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাতদিন দীর্ঘসময় মৌন থেকে তাঁর কালাম শোনা এবং সেই ভাবনার মধ্যে নিমগ্ন থাকার সুযোগ তিনি আমাদের দিয়েছেন।
যারা পুরো নির্ঘণ্ট অনুসারে পুরো সময়টা করতে পেরেছেন তারা নিঃসন্দেহে অনেক লাভবান হবেন।
যারা কিছু সময় করেছেন… আসলে কল্যাণের মাঝে রহমতের ছায়ার মাঝে ধ্যানের মাঝে মৌনতার মাঝে যত সময় থাকা যায় যতটুকু সময় থাকা যায় ততটুকুই কল্যাণ বহন করে নিয়ে আসে।
প্রিয় সুহৃদ! এবারের রমজানে আল্লাহর মহিমা উপলব্ধি করার পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য স্থির করেছিলাম নবীপ্রেমে যাতে আমরা আমাদের অন্তরকে প্লাবিত করতে পারি।
আসলে যত আমরা নবীপ্রেমে নিজেকে আপ্লুত করতে পারব তত অহিংসা ও সমমর্মিতায় আমাদের হৃদয় আপ্লুত হবে।
কারণ নবীজী (স) সকল সৃষ্টির জন্যে প্রেরিত হয়েছেন করুণা হিসেবে। অহিংসা সমমর্মিতা সার্থক রূপকার ছিলেন তিনি।
এ রমজানে প্রথম দিন থেকেই আমরা তার হাদীস অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়েছি। হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী রমজানের প্রথম দিন অনেকের হাতেই পৌঁছে গেছে।
আর হাদীস পাঠের আসর প্রত্যেকদিন তার বাণীকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করছে।
গত সাদাকায়নে আমরা তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুন্নত নিয়ে আলোচনা করেছি। এবং হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণীর উদ্বোধনী হাদীস হিসেবে এই হাদীসটিকে আমরা গ্রন্থিত করেছি।
তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, তোমার মনে কখনো কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা অমঙ্গলচিন্তা থাকবে না— এটাই আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে ভালবাসল, সে আমাকে ভালবাসল। আর যে আমাকে ভালবাসল, জান্নাতে সে আমার সাথে থাকবে।
অর্থাৎ যিনিই নবীজীর (স) সুন্নতের অনুসারী হবেন তিনি সমমর্মিতার প্রতীক হবেন। হিংসা বিদ্বেষের কোনো প্রকাশ তার জীবনে ঘটতে পারে না।
সহিংসতা হিংসা বিদ্বেষের যে-কোনো উপস্থিতি আসলে সেই জীবনে নবীপ্রেমের সুন্নতের অর্থাৎ নবীজীর সবচেয়ে বড় সুন্নতের অনুপস্থিতি নির্দেশ করবে।
গত সাদাকায়নে নবীজীর (স) আরেকটি সুন্নত বর্ণনা করেছিলাম যে, তিনি বলেছেন, প্রতিটি কাজ তুমি সবচেয়ে ভালোভাবে করবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ।
এবং নবীজীর পুরো জীবন হচ্ছে প্রতিটি কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করার উজ্জ্বল উদাহরণ।
এবং নবীজী সারাজীবনে কখনো কাউকে ঠকান নি। কখনো কারো অধিকারকে লঙ্ঘন করেন নি। কখনো কারো ওপর অন্যায় করেন নি।
এবং সবার সাথেই সদাচরণ করেছেন। এবং প্রত্যেককে তার প্রাপ্য দিয়েছেন। এবং প্রত্যেকের সাথে সুবিচার করেছেন।
কাউকে কখনো গালিগালাজ বকাবকি করেন নি। এবং ভালো কোনো কাজকে কখনোই ছোট মনে করেন নি। এবং অহংকারের প্রকাশ ঘটে এমন কিছুই করেন নি।
নবীজীর (স) সাহাবীরা তার এই সুন্নতগুলোকে তার এই কাজগুলোকে তার এই উদাহরণগুলোকে নিজেদের জীবনে পালন করার চেষ্টা করেছেন, নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেছেন। নিজেদের জীবনে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন।
এবং নবীজীকে অনুসরণ করার মধ্য দিয়েই তারাও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাদের নামও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
প্রিয় সুহৃদ! ২৩তম আখেরি দোয়ার বিশেষ সাদাকায়নে অংশ নেয়ার জন্যে আবারো আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
দেশে থাকুন দেশের বাইরে থাকুন- যেখানেই থাকুন এই মুহূর্তে আমরা সবাই সংযুক্ত সবাই একাত্ম।
এবং যেহেতু সবাই সংযুক্ত সবাই একাত্ম, এক হলের মধ্যে বা একাধিক হলে কাছাকাছি থাকলে যে অনুরণন সৃষ্টি হতো এখন যেহেতু তার চেয়েও অনেক গুণ অনেক গুণ মানুষ অনেক গুণ ধ্যানী আমরা সংযুক্ত হতে পেরেছি। আমাদের ভাইব্রেশন আমাদের অনুরণন নিঃসন্দেহে অন্য যে-কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
তো আমরা এখন আজকের বিশেষ মেডিটেশনে নিজের অন্তর্গত সত্তাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।