আজ মা বেঁচে আছেন বলে তার সেবাযত্ন আপনি করতে পারছেন। যখন তিনি থাকবেন না তখন মাথাকুটে মরলেও তাকে আর কাছে পাবেন না। আপনার এখনকার বিরক্তি-ই তখন আপনাকে অনুশোচনায় দগ্ধ করবে।
এটা নিয়ে একটা ঘটনা- বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন। তেমন ভালো চলাফেরা করতে পারেন না। থাকেন ছেলের সাথে। ছেলে তার কাছে সবচেয়ে আদরের।
তো, একদিন পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে বাবা খেতে বসেছেন। খেতে খেতে তার হঠাৎ মনে হলো যে, আজকে কি বার!
ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন; ছেলে বলল- সোমবার।
একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করছেন যে আজকে কী বার? ছেলে আবারো বললো, সোমবার!
খানিক পরেই ভুলে গেছেন! আবার জিজ্ঞেস করছে আজকে না কী বার! ছেলে বিরক্ত হয়ে জোরে বললো, সোমবার!
কিন্তু বাবার স্মৃতিশক্তি তো খুব দুর্বল হয়ে গেছে। দ্রুত সবকিছু ভুলে যান। কিছুক্ষণ পরে আবারো জিজ্ঞেস করছে- কী বার যেন বললি?
এইবার ছেলে গেছে ক্ষেপে।
বললাম না- সোমবার! কতবার বললাম, তোমার মনে থাকে না? তোমার বার দিয়ে দরকারটা কি? তুমি কি বাইরে যাবা? তুমি কাজ করতে পারো?
আসলে ছেলে যে বাবাকে ভালবাসত না- তা নয়। কিন্তু অফিসের কাজের যে চাপ সেখানে হয়তো বিরক্তি প্রকাশ করতে পারে নাই। বিরক্তিটা এসে পড়েছে বাবার ওপরে।
তো ছেলের কথা শুনে বাবা একেবারে চুপ! যতক্ষণ খাওয়া-দাওয়া করেছে আর কোনো কথা বলে নি।
এর দু-তিন দিন পরে বাবা মারা গেলেন। তাকে হাসপাতালে নেয়ারও সময় পাওয়া যায় নি। এবং এর মধ্যে ছেলের সাথে বাবার আর কোনো কথা হয় নি।
দাফন কাফন শেষ। একটু অবসরে বাবার জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ছেলে পেল বাবার অনেক পুরনো একটা ডায়েরি। সেখানে ৪০ বছর আগের একটা ঘটনা।
খোকার বয়স আজকে দুই বছর পুরো হলো। আজ ভারী মজার একটা ঘটনা ঘটেছে।
খোকা আমার সাথে হাঁটছে; হঠাৎ দূরে দেয়ালের ওপারে গাছে একটা কাক এসে বসল। খোকা আমাকে জিজ্ঞেস করল- বাবা, ওটা কী? আমি বললাম কাক। খোকাও উচ্চারণ করল- ‘কাক’!
একটু পরে খোকা আবার জিজ্ঞেস করছে- বাবা ওটা কী? আমি বললাম কাক। খোকাও বললো- কাক! আর আমাকে জড়িয়ে ধরলো; কাক!
এভাবে ৩০ বার খোকাকে আমি কাক বলেছি এবং প্রত্যেকবারই সে কাক বলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি আমার জীবনে এত আনন্দ এর আগে কখনো পাই নি।
ছেলেটা বাবার লেখা পড়ছে, আর দরদর দরদর করে পানি ঝরছে তার চোখ দিয়ে।
বাবা এতবার কাক বলার পরও তার কোনো বিরক্তি ছিল না। আর আমি চতুর্থবার ‘সোমবার’ বলতে গিয়ে তাকে ধমক দিয়েছি!
তার উপলব্ধি- বাবাকে যে এত ভালবাসি আমার এই ভালবাসার স্মৃতি নিয়ে তো বাবা আমার কাছ থেকে যান নি! বাবা তো স্মৃতি নিয়ে গেলেন আমার বিরক্তির।
তো, এখন কেঁদে বুক ভাসালেও তো কিছু হবে না। বাবাকে তো আর পাওয়া যাবে না, যে তার কাছে ক্ষমা চাইবে।
আসলে আমরা বুঝি না, যে একটা বয়সে এসে মা-বাবা দ্বিতীয় শৈশবে পৌঁছে যান। একটা ছোট্ট শিশু যেরকম বার বার একটা কথা জিজ্ঞেস করে, অল্পতেই রেগে যায়, অভিমান করে- তেমনটা হয় তাদের ক্ষেত্রেও।
এখন আপনার সন্তান যদি বার বার একটা কথা জিজ্ঞেস করে আপনি কি বিরক্ত হন? হন না তো! তাহলে আপনার মা যদি জিজ্ঞেস করে কেন বিরক্ত হবেন আপনি?
এই বিরক্ত হওয়াটা কখনোই জাস্টিফাইড না।
কারণ, আজকে যে আপনি জ্ঞানী হয়েছেন, এত কিছু পারেন- তার পিছনে ছিল আপনার বাবা-মায়ের বিরক্তিহীন ভালবাসা-মমতা। বাবা-মা শুধু ‘কাক’ শেখান নাই। যা-কিছু আমরা জানি সবকিছুর শিক্ষার শুরুটাই হচ্ছে মা এবং বাবা।
আর, জীবনে মা-বাবার দোয়া হচ্ছে খুব বড় জিনিস। কোনো পিতামাতাই হয়তো সচেতনভাবে সন্তানকে বদদোয়া দেন না। কিন্তু তাদের অন্তরনিঃসৃত স্বতস্ফূর্ত দোয়া সন্তান তখনই পায় যখন তার আন্তরিক সেবা-যত্ন-মমতায় তারা খুশি হন।
এখন, আপনি আপনার মা-বাবার দোয়া থেকে যদি বঞ্চিত হন, আপনার সন্তানকে আপনি দোয়া করেও কোনো লাভ হবে না।
কারণ আপনি আপনার মা-বাবাকে যা দেবেন, আপনার সন্তানও আপনাকে তা-ই দেবে।
সন্তান যদি দেখে, যে আপনি আপনার মাকে ভালবাসছেন, আপনি তার প্রতি বিরক্ত হন না, তার সাথে সবসময় সদাচরণ করেছেন- আপনার সন্তান এটাকেই উদাহরণ হিসেবে নেবে। এবং সে এটা ফলো করবে।
আমি এক বাবার কথা জানি। তার মা মারা গেছেন। মায়ের অসিয়ত ছিল, যে তার বাবার সাথে কবরের পাশেই যেন তাকে কবর দেয়া হয়।
তো মা মারা গেছে সকালবেলা। তার মৃতদেহ নিয়ে লোকটি গ্রামের বাড়ি রওয়ানা হলো। নদী পথে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার পথ। নৌকা যখন বুড়িগঙ্গায় গেছে, মাঝি বলল যে, সে আর বাইতে পারবে না। ভদ্রলোক তখন বললো, ঠিক আছে তুমি বসে থেকো; আমি নৌকা বাইবো।
ভাবতে পারেন- একজন কর্মজীবী মানুষ, যার নৌকা বাওয়ার অভ্যাস নাই, সে তার মায়ের লাশ ঘণ্টার পর ঘন্টা নৌকা বেয়ে নিয়ে গেছে কেবল মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্যে!
ভদ্রলোকের ছেলে সেটা মনে রেখেছে। সে তার মা-বাবাকে সেভাবেই সম্মান করেছে। এবং শেষ বয়সেও তাদের সেইভাবে দেখেছে যেভাবে তার বাবা তার মা-কে দেখেছিল।
তাই সচেতন থাকবেন, যেন মায়ের কোনো ব্যাপারে আপনার মনে বিরক্তি না আসে। ‘আমার মা-বাবা’ মেডিটেশনটি করবেন। তাহলে মায়ের কোনো ব্যাপারে আপনার মনে অসন্তোষ জমতে পারবে না।
আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যাদের মা-বাবা এখনো জীবিত আছেন তাদের দোয়া নিয়ে যেন আমরা পৃথিবী থেকে যেতে পারি।