1. [email protected] : আরএমজি বিডি নিউজ ডেস্ক :
  2. [email protected] : adminbackup :
বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ০১:৪৯ পূর্বাহ্ন

গহীন জঙ্গল থেকে আলোর পথে যাত্রা

  • সময় মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৭৭ বার দেখা হয়েছে

গহীন জঙ্গল থেকে আলোর পথে যাত্রা

রেংওয়ই ম্রো

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বান্দরবান সরকারি কলেজ
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নে, লাম্বু নামে এক নির্জন ও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে আমার জন্ম। সেখানে শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করা দূর আকাশের তারার মতো। মা-বাবা শিক্ষিত না হলেও আমার জন্মের পর বাবা চাইতেন আমি যেন পড়াশোনা করি। কিন্তু মা এমনটা চাইতেন না। কারণ ঐসব অঞ্চলে অধিকাংশ মহিলার প্রত্যাশা—সন্তানরা বড় হয়ে জুমচাষ করে নিজের মা-বাবাকে দেখাশোনা করবে।

বাবা আগ্রহের সাথে আমাদের প্রত্যেক ভাইবোনের শিক্ষা অর্জনের পথ খুলে দিলেন। গ্রামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকাতে বাবা ছিলেন আমার জীবনে প্রথম শিক্ষক ও প্রথম জ্ঞানের গুরু। বাবা বলতেন, তিনি মাত্র ছয় মাস ‘সবুজ শিশু’ নামের একটি বই পড়ে তার জীবনে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটাতে বাধ্য হন। কারণ বাবা এতিম ছিলেন। তিনি তার নিজের থেকে যতটুকু সম্ভব আমাকে শিখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন এবং আমি নিজেও শিখতে চেষ্টা করি।

বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন বাইরে কোথাও ভালো একটা স্কুলে আমাকে ভর্তি করাবেন। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি আমার চাচার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন।

এমন একটা সময় হঠাৎ করে মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। যদিও পড়ালেখার ব্যাপারে মা এত বেশি বুঝতেন না। তবুও বাবার আগ্রহ দেখে তিনি আমাকে নিয়ে আশা করতেন যে, একদিন আমি গ্রামের বাইরে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করব। আমি অনেক বড় মানুষ হবো, এই ছিল তার প্রত্যাশা। মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারালাম। বাবা তার বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে যান নি। যেভাবে হোক তিনি আমাকে লেখাপড়া করাবেনই।

একবছর পর আমার চাচা আমাকে নিতে এলেন এবং লামার একটি মিশনারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করালেন। আমি প্রথম আমাদের গ্রাম থেকে বাইরে এসে স্কুলে পড়াশোনা শুরু করলাম। কিন্তু আমাদের পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে একবছর পর আমার বাবা আর কোনো খরচ দিতে পারেন নি। তাই সেখানে আমি বেশিদিন লেখাপড়া করতে পারি নি। বাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য হই। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্ত একটাই, যেভাবে হোক লেখাপড়া করাবেনই। একবার সে-সময় ভোটার তালিকাভুক্তি চলছিল। এ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের সাথে বাবা পরিচিত হন এবং আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা ছিলেন আলীকদম আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের সাহায্যে ঐ স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু সেই হোস্টেলে কখনো কখনো খাবারের অভাবে থাকতে হতো। এভাবে প্রাইমারি স্কুল জীবন শেষ করলাম।

শুরু হলো হাই স্কুল। হাই স্কুলে এসে অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হলাম এবং সে-বছর নবম শ্রেণিতে প্রমোশনের সুযোগ হলো না। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিয়ে আবার মনোযোগ দিলাম পড়ালেখায়। মনে মনে বিশ্বাস করতাম, এই ফেল করা মানে আমার ব্যর্থতা নয় বরং আমার শিক্ষা জীবনের আরেকটা ধাপ শুরু। মনে মনে বিশ্বাস রাখলাম আমি অবশ্যই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবো।

পরবর্তী বছরে নবম শ্রেণিতে ওঠার সুযোগ হয়। কিন্তু নবম শ্রেণিতে ওঠার চার মাস পর ১ মে ২০১৭ বাবা মারা যান। আমার জীবনে নেমে আসে আরেকটা অন্ধকার সময়। মনে শুধু প্রশ্ন জাগে, কীভাবে এই পরিস্থিতিতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া যায়? তখন থেকে বড় বোন, আমি এবং আমার ছোট ভাইকে দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়ল আমার বড় ভাইয়ের ওপর। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তার স্ত্রীসহ তিন সন্তান নিয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। তবুও তিনি নিজের ছেলেমেয়ের মতো আমাদের দেখাশোনা করতেন। কাউকে কমবেশি না করে সবাইকে সমানভাবে ভালবাসতেন। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তিনি আমাকে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে পড়ালেখা বন্ধ করার প্রস্তাব দিলেন। তার অবস্থা বুঝতে পেরে সাথে সাথে সম্মতি জানালেও মনে মনে ঠিক করলাম দিনমজুরের কাজ করে হলেও আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাব। এভাবে দেখতে দেখতে চলে যায় হাই স্কুল জীবন। এবার আমি হলাম এসএসসি পরীক্ষার্থী। এসএসসি পরীক্ষা ততটা ভালো না হলেও বিশ্বাস করতাম আমি অবশ্যই পরীক্ষায় পাশ করব। ভেবে রেখেছিলাম কোনো একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হবো।

একবার মনে হলো কোয়ান্টাম কসমো কলেজে পরীক্ষা দিয়ে দেখব। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে একটা ভর্তি ফরম সংগ্রহ করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গেলাম। সেখানে আরেকটা আনন্দের বিষয় হলো, প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাশে থাকা বন্ধু নিংথাওয়াং মার্মাকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেখে খুবই খুশি হলাম। ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে কতৃর্পক্ষ আমাকে কসমো স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিলেন। বন্ধু নিংথাওয়াংও সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল।

তারপর কলেজে নতুন ক্লাস শুরু হলো। আস্তে আস্তে পরিচিত হলাম নতুন বন্ধুদের সাথে। নতুন যারা ভর্তি হয়েছে তাদের সবাইকে ব্যান্ড বাদনে দেয়া হয়। কেউ বাঁশি, কেউ ড্রাম বাজাতাম। আমি এবং আমার বন্ধু দুজন মিলে আমাদের পছন্দের বাদ্যযন্ত্র বাঁশি বেছে নেয়ার সুযোগ পেলাম। এর আগে কখনো হাতে এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র ধরে দেখারও সুযোগ হয় নি।

শুনলাম প্রতিবছর নাকি ব্যান্ডদলকে ঢাকা জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হয়। সমাবেশে অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে খুব আগ্রহের সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত করোনা মহামারির কারণে প্রোগ্রামটি হয় নি।

পড়ালেখার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব যেমন ঈদ, পূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা পালন করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন পিঠার উৎসব আয়োজন করা হয়। কখনো কখনো ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে ভ্রমণে যেতাম।

এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শেষে আমাদের ক্যাম্পাসে ‘ঘরে ফেরার আনন্দ উৎসব’ আয়োজন করা হয়। সেখানে সমস্ত প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে, ফলে অনেক বড় ভাইবোনদের সাথে দেখা হয়।

কোয়ান্টাম কসমো কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়ার পেছনে কিছু মানুষের অনেক অবদান রয়েছে, তাদের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। আমি আমার বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তকে কাজে লাগিয়ে দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্যে পরিণত করতে পেরেছি। এখানে ভর্তি হয়ে মেডিটেশন করার সুযোগ পেয়েছি। মেডিটেশনের মাধ্যমে আমার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়েছে। এখন আমি বান্দরবান সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ছি। পাশাপাশি কাজও করছি।

আমি উপলদ্ধি করি, আমাদের ম্রো নৃ—গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। আমি দেখেছি কোয়ান্টামে প্রত্যেক সম্প্রদায়কে নিজ নিজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রক্ষার জন্যে উৎসাহিত করা হয়। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্যে ম্রোদের ‘ক্রামা’ বর্ণমালা অধ্যয়ন করা উচিত এবং সেটাও কোয়ান্টামের এক বড় ভাই আমাকে উৎসাহিত করেছে। একসময় আমার মা-বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন, আজ তারা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে অনেক খুশি হতেন।

আমার একটি অণু কবিতা—

ভাগ্য সবারই সমান নয়, সত্যি

কিন্তু সিদ্ধান্ত সবারই আছে।

ভাগ্য কখনো সিদ্ধান্ত নেয় না,

কিন্তু সিদ্ধান্ত সবারই ভাগ্যে

পরিবর্তন এনে দিতে পারে।

[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]

শেয়ার করুন

এই শাখার আরো সংবাদ পড়ুন
All Rights Reserved © rmgbdnews24.com