এটা মোটেই ঠিক নয়। সিজারিয়ান অপারেশন শুরু হয়েছে গত শতাব্দী থেকে। এর আগে যে প্রতিভাধর, সৃজনশীল মানুষেরা জন্মেছিলেন, তারা কি সব বোকা ছিলেন? আসলে আমরা অনেক সময় প্রচারণার ফাঁদে পড়ে যাই। সিজারিয়ান সম্পর্কে যে ধারণার কথা সাধারণভাবে প্রচলিত, তা আসলে কিছু চিকিৎসাব্যবসায়ীর মুনাফা বৃদ্ধির টোপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আমেরিকায় শতকরা পাঁচটি সিজার হয় রোগীর প্রয়োজনে। বাকি ৯৫টি অপারেশনই হয় ক্লিনিকের বিল বাড়ানোর জন্যে। ডাক্তার, ক্লিনিক, ওষুধ কোম্পানি, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার এবং চিকিৎসা-সরঞ্জাম তৈরির কোম্পানিগুলো মিলে গড়ে ওঠা চিকিৎসাব্যবসায়ী চক্রের স্বার্থরক্ষার প্রয়োজনেই এ ধরনের প্রচারণা চালানো হয় যে, সিজারিয়ানের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম হলে সে ব্রিলিয়ান্ট হবে।
অথচ সিজার একটি মেজর অপারেশন এবং এর ঝুঁকিও অনেক বেশি। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে এ-সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ৪১০টি ল্যাটিন আমেরিকান হাসপাতালের ৯৭,০০০ ডেলিভারি রিপোর্ট অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, স্বাভাবিক প্রসবের তুলনায় সিজারিয়ান করা মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি তিন গুণ বেশি। স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যেখানে একজন মায়ের মৃত্যুঝুঁকি ০.১%, সেখানে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে প্রসব হলে মায়ের মৃত্যুঝুঁকি ০.৪%। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিজারিয়ানের পর মাকে রক্ত নিতে হয়। হাসপাতালে থাকতেও হয় বেশি। অতএব সিজারের ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আগ্রহের কারণ বোঝা কঠিন নয়।
এ প্রসঙ্গে পুশড : দ্যা পেইনফুল ট্রুথ অ্যাবাউট চাইল্ড বার্থ এন্ড মডার্ন মেটারনিটি বইয়ের লেখিকা জেনিফার ব্লক বলেন, হাসপাতালগুলো পরিচালিত হচ্ছে মুনাফার চিন্তায়। স্বাভাবিক প্রসব তাদের জন্যে লাভজনক নয়। ব্যাপারটাকে তারা অনেকটা এভাবে দেখে, একটা রেস্টুরেন্টে ক্রেতা এসে বসেও যদি খাবারের অর্ডার না দিয়ে চলে যায়, সেটা যে-রকম তাদের জন্যে অলাভজনক, হাসপাতালে এসে স্বাভাবিক ডেলিভারিতে বাচ্চা জন্ম দিয়ে যাওয়াটাও তাদের মুনাফা হানির কারণ।
কিন্তু যে বাচ্চাটি জন্মায় তার কী অবস্থা হয়? পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যে-সব বাচ্চার ওজন কম, সিজার হলে তাদের মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। নরমাল ডেলিভারিতে জন্মের সময় বাচ্চার ফুসফুস থেকে তরল উপাদান বেরিয়ে গিয়ে বাচ্চাটি বাইরের পরিবেশে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার যে উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে, সিজারে তা হয় না। ফলে সিজারিয়ান বাচ্চাদের ফুসফুস যে-রকম দুর্বল থাকে, হাঁপানিসহ অন্যান্য রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।
কিন্তু এতসব স্বাস্থ্যঝুঁকির পরও ব্যবসায়ীদের প্রচার-প্রচারণার ফলে আর এসব প্রচার-প্রচারণার ঢেউ এসে লেগেছে আমাদের দেশেও। গত ১০ বছরে আমাদের দেশে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারে ভূমিষ্ঠ শিশুর সংখ্যা প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে—২০১৪ থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালে এ হার শতকরা মাত্র চার ভাগ থাকলেও ২০১৪ সালে সেটি শতকরা ২৩ ভাগে উন্নীত হয়।
এতে আরো জানানো হয়, দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে শতকরা সাত শতাংশ এবং শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে শতকরা ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে মাত্র ২৩ শতাংশ সন্তান প্রসব হচ্ছে সিজারিয়ানের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে এই হার ৮০ শতাংশ। অতএব সিজারিয়ানের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না।
তবে এটা ঠিক যে, কিছু কিছু সিজার অপারেশন সত্যিই প্রয়োজন। এ সমস্ত ক্ষেত্রে একসময় হয়তো মা-ই মারা যেত বা মৃত সন্তান জন্মাত। সিজারিয়ানের কল্যাণে মা-শিশু দুজনকেই আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এর সাথে ব্রিলিয়ান্সির কোনো সম্পর্ক আছে। মেধা কিছুটা জন্মগত, তা তিনি যেভাবেই জন্মান আর বাকিটা তার চেষ্টা এবং অধ্যবসায়। তাছাড়া যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যে বাচ্চা নিজে নিজে বেরিয়ে চলে এলো পৃথিবীতে সে বেশি ব্রিলিয়ান্ট, নাকি যে বাচ্চা বেরোতে পারল না, যাকে সার্জারি করে বের করতে হলো, সে বেশি ব্রিলিয়ান্ট?