এখন বিশ্বের অনেক দেশেই ডায়রিয়া চিকিৎসায় জিংকের ব্যবহার চলছে। জিংক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এই বিশ্বাস থেকে অনেককে করোনার মধ্যে জিংক বড়ি বা সিরাপ খেতে দেখা গেছে।
খাওয়ার স্যালাইন উদ্ভাবনের মতো জিংকের কার্যকারিতা প্রমাণের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি)। জিংকের উপকারিতা, কার্যকারিতা ও জনগোষ্ঠী পর্যায়ে জিংকের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক গবেষণাগুলো হয়েছিল বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আইসিডিডিআরবিতে। এর গবেষকেরা দেখেছেন, ডায়রিয়ার রোগীদের পরিপূরক হিসেবে জিংক দিলে বহুবিধ সুফল পাওয়া যায়।
এই গবেষণার মূল ব্যক্তি ছিলেন বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ ড. এস কে রায়। তিনি তখন আইসিডিডিআরবির ক্লিনিক্যাল সায়েন্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ড. এস কে রায়ের পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল জিংক। এরপর আইসিডিডিআরবির মহাখালী হাসপাতালে ও মতলব হাসপাতালে তার নেতৃত্বে জিংক নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়।
ড. এস কে রায় এখন নিউট্রিশন সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছিলাম ডায়রিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধে জিংক কাজে দেয়।
ডায়রিয়ায় শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। জিংক শরীরের পানি ও লবণ শোষণক্ষমতা বাড়ায়। জিংক ডায়রিয়া রোগীর আরোগ্য লাভের সময় কমিয়ে আনে। আমরা এও দেখেছি যে শিশুদের বৃদ্ধিতে জিংকের ভূমিকা আছে।’
রাসায়নিক হিসেবে শরীরে খুব সামান্য পরিমাণে জিংকের প্রয়োজন হয়। জিংক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। যেসব এলাকায় বা জনগোষ্ঠীতে খাদ্যমান যথাযথ নয়, সেখানে মানুষ বিশেষ করে শিশুরা জিংকস্বল্পতায় ভোগে।
জিংকের স্বল্পতা থাকে এমন শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া তীব্র হয়। আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণেও শরীরে জিংকের পরিমাণ কমে যায়।
নব্বইয়ের দশকে শুরুতে আইসিডিডিআরবির ঢাকা হাসপাতালে তীব্র ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় জিংক ব্যবহার করা হয়। তাতে দেখা যায়, দৈনিক ২০ মিলিগ্রাম জিংক পরিপূরক ব্যবহারে ডায়রিয়াজনিত মলের পরিমাণ কমে যায়। এতে ডায়রিয়ার স্থায়িত্ব কমে, শিশুদের ওজন বাড়ে।
ঢাকা হাসপাতালে একাধিক পরীক্ষার (ট্রায়াল) পর গ্রামীণ এলাকায় জিংকের কার্যকারিতা দেখার উদ্যোগ নেয় আইসিডিডিআরবি। চাঁদপুরের মতলবে দুই বছর ধরে আট হাজার শিশুর ওপর এই গবেষণা হয়। তাতে উল্লেখযোগ্যহারে শিশুমৃত্যু কমতে দেখা যায়।
এসব গবেষণা থেকে জিংকের কার্যকারিতা নিয়ে গ্রহণযোগ্য এবং অন্যকে প্রভাবিত করার মতো প্রমাণ হাতে আসে বিজ্ঞানীদের।
জিংক বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের গবেষণা একত্রে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জিংকের সুফল নিয়ে নিশ্চিত হয়। যার ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ২০০৪ সালে শৈশবকালীন ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার নির্দেশিকায় পরিবর্তন আনে। তারা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডায়রিয়া চিকিৎসায় জিংক ব্যবহারের সুপারিশ করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের এই পরামর্শ বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে।
আইসিডিডিআরবি এরপরও জিংক নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখে। পরে গবেষকেরা দেখেছেন, ১০ দিনের পরিবর্তে পাঁচ দিন জিংক ব্যবহার করলে একই ফল পাওয়া যায়, তাতে খরচ কমে। এ ছাড়া আয়রনের সঙ্গে জিংকের মিথস্ক্রিয়া নিয়েও তারা গবেষণা করেছেন।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা জিংকের গুণাগুণ প্রমাণের পাশাপাশি দেশি ও আন্তর্জাতিক নীতি পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে চ্যালেঞ্জ দেখা দেয় জিংককে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে।
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় স্কেলিং আপ অব জিংক ফর ইয়াং চিলড্রেন (সুজি) কর্মসূচি হাতে নেয় তারা। এই কর্মসূচির মাধ্যমে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জিংক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
আইসিডিডিআরবি ফরাসি কোম্পানি নিউট্রিসেটের কাছ থেকে জিংক বড়ির একটি পেটেন্ট কিনে নেয়। উদ্দেশ্য ছিল একটি দেশি কোম্পানি দিয়ে জিংক বড়ি তৈরি করা। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একমি ল্যাবরেটরিস জিংক বড়ি তৈরি ও বিপণনের কাজটি পায়। তারা ‘বেবি জিংক’ নামে বড়ি তৈরি শুরু করে।
পাশাপাশি জিংকের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলার জন্যে প্রচারকাজ শুরু করে। এতে উল্লেখযোগ্য সফলতা আসে। মানুষের মধ্যে জিংকের ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা বাড়ে। পাঁচ বছরের কম বয়সী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের ৪০ শতাংশ এখন জিংক পায়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জিংক নিয়ে আরও নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, জিংক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। সংক্রামক রোগের তীব্রতা কমাতেও জিংকের ভূমিকা আছে। জিংক অরুচি দূর করে, শিশুদের ক্ষুধা বাড়ায়। অন্যদিকে মানুষের পেশি গঠনেও জিংক ভূমিকা রাখে। তাই ক্রীড়াবিদদের মধ্যে এর ব্যবহার বেড়েছে।
বিশিষ্ট শিশুরোগ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অণুপুষ্টি কণা (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট)। ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া চিকিৎসায় এর ব্যবহার এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
করোনা প্রতিরোধেও এর ভূমিকা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমি মনে করি কমিউনিটি ক্লিনিকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় জিংক অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।’
সূত্র : প্রথম আলো (২৮ জুলাই ২০২১)
নতুন মন্তব্য