ঢাকার ঐতিহ্যবাহী উদ্যানগুলোর একটি ওসমানী উদ্যান। গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিপরীত পাশে এর অবস্থান। নানা জাতের গাছে ঘেরা আর সবুজে ঢাকা ছিল ওসমানী উদ্যান। ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরের নির্দেশনাও। সবুজের প্রাধান্য থাকায় এটিকে পুরান ঢাকার ফুসফুসও বলা হতো। অথচ আধুনিকায়নের নামে সেই উদ্যানের শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়। নেওয়া হয় ৫৮ কোটি টাকার প্রকল্প। এরপর মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে করেন ১১০ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়লেও তিন দফা সময় বাড়িয়ে কাজ শেষ করতে পারেনি নগর কর্তৃপক্ষ। আরও সময় বাড়াতে চায় তারা।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখনও সম্পন্ন হয়নি হাঁটার পথ তৈরি। বসেনি ল্যাম্পপোস্ট। যেখানে গাছ কেটে ফাঁকা করা হয়েছিল, সেখানে লাগানো হচ্ছে ঘাস। উদ্যানের পশ্চিম পাশে রেলওয়ে কোয়ার্টারের দিকে যে ফোয়ারা করার কথা, সেখানে কাজ চলছে। গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থাপনার কাজও চলমান। চলমান কাজ শেষ হতে আরও ৬ মাস লেগে যেতে পারে। তবে প্রকল্প পরিচালকের দাবি কাজ প্রায় শেষ। তিনি বলেন, যে কাজ রয়েছে তা দ্রুতই শেষ করে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) মো. খায়রুল বাকের বলেন, কাজ প্রায় শেষ। এখন ফিনিশিংয়েল কাজ চলছে। কিছু বিল পরিশোধ ও আনুসঙ্গিক কাজ
শেষ করতে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এজন্য নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধি হবে না।
কবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতে পারে জানতে চাইলে বাকের বলেন, এটা বলতে পারব না। তবে শিগগিরই কাজ শেষ করে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হবে। বারবার সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের মেয়র যে ঠিকাদারকে কাজ দিয়েছিলেন, তিনি কাজ ফেলে চলে যান। এরপর মামলা হয়। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় দীর্ঘ সময় লেগেছে। সময়ের পরিবর্তন ও নকশায় পরিবর্তন হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ওসমানী উদ্যানে প্রথমে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হলেও পরে নতুন পরিকল্পনা সংযোজন করে তা বাড়িয়ে ৮৬ কোটি টাকা করা হয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর আবারও পানি নিষ্কাশন, ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন প্রক্রিয়া যোগ করা হয়। ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১০ কোটি টাকার বেশি।
ওসমানী উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পটি তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত। প্রথম প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত একটি লাইব্রেরি, ফুড কোর্ট-১, ফুড কোর্ট-২, কার পার্কিং প্লেস, জিম, টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড বোর্ড, এটিএম বুথ, ওষুধের দোকান, বিনোদনকেন্দ্র ও নগর জাদুঘর।
দ্বিতীয় প্যাকেজে রয়েছে শিশুদের খেলার জায়গা, ভলিবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, লেকের পাড় উন্নয়ন, ঘাট তৈরি, মাঠ উন্নয়ন ও সাব-স্টেশন স্থাপন এবং তৃতীয় প্যাকেজে ওয়াটার পিউরিফিকেশন সিস্টেম, স্বাধীনতা চত্বর ও কফিশপ, স্পিংকেল সিস্টেম, ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন, প্যাডল বোট, বিভিন্ন ভাস্কর্য ও পুরান ঢাকার থ্রিডি স্থাপত্য নকশার মডেল। এ ছাড়া জলাধার, আলাদা আলাদা বসার জোন করার পাশাপাশি বড় স্ক্রিনে নিজের অবস্থান দেখার ব্যবস্থা রাখার এবং নিরাপত্তার জন্য ৩৫০টি সিসি ক্যামেরা ক্যামেরা ও জিম স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় সাত বছরে এসবের কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রায় ২৩ একর এলাকাজুড়ে ওসমানী উদ্যান। সচিবালয়, নগর ভবন, গুলিস্তান, পল্টন ও হাইকোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যবর্তী এ স্থানে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ বিশ্রাম নিতেন, ঢাকার বাইরে থেকে আসা অনেকেই এখানে অবসর সময় কাটাতেন। ভাসমান মানুষ ও পথশিশু থেকে সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও এখানে সময় কাটাতেন। অনেকে শরীর চর্চা করতেন। কিন্তু উন্নয়নকাজের জন্য টিনের বেড়ায় আবদ্ধ করে ফেলা হয় উদ্যানটি। এরপর থেকে সেখানে আর কেউ ঢুকতে পারছেন না।
প্রসঙ্গত, আধুনিকায়ন ও নান্দনিকতার কথা বলে ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি ওসমানী উদ্যান পার্ক সংস্কার কাজের উদ্বোধন করেন ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তখন পার্ক উন্নয়ন কাজের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫৮ কোটি টাকা। সে সময় মেয়র খোকন পার্কটির নাম দিয়েছিলেন ‘গোস্যা নিবারণী পার্ক’। উদ্বোধনকালে মেয়র ঘোষণা দিয়েছিলেন ১০ মাসের মধ্যে পার্কের উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিছু কাজ শুরুও হয়েছিল। পরবর্তীতে মেয়র পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজও থমকে যায়। তবে কাজের অগ্রগতি যাই হোক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকা তুলে নেয়। যদিও পরে তাদের চুক্তি বাতিল ও জরিমানা আদায় করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে।