অনেক সময়েই মুক্তিযোদ্ধাদের দিনের পর দিন শুধু গুড়-চিড়া খেয়ে কাটাতে হতো। তাও প্রতিবেলা নয়, হয়তো এক বেলা বা বড় জোর দুইবেলা। তো কয়েক সপ্তাহ কেবল গুড় চিড়া খেয়েই তারা যুদ্ধ করতে লাগলেন।
এর মধ্যে একটি অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর তারা নিকটবর্তী এক গ্রামে আশ্রয় নেন। সে গ্রামের একজন কৃষক তার ৭/৮ বছরের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরোধ করেন, যে তিনি এক বেলা তাদেরকে রান্না করে খাওয়াতে চান। সাথে সাথে তার ছোট্ট মেয়েটিও বায়না ধরে, যে সেও মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াবে এবং এর জন্যে তার পোষা প্রিয় ছাগলটাকে সে দিয়ে দেবে।
মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন হতভম্ব হয়ে দেখেন – একটি ছোট্ট শিশুরও দেশের জন্যে মমতা ও ভালবাসা কত প্রবল হতে পারে। একটি হতদরিদ্র কৃষক পরিবারও কীভাবে তাদের সর্বস্ব অকাতরে দিয়ে দিতে পারে দেশের জন্যে।
অনেক বছর পর সেই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণ করেন, যে সেদিনের গরম ভাত, আর সাথে দু টুকরো ছাগলের মাংসের মতো সুস্বাদু খাবার তিনি জীবনে আর কখনো খান নি।
মুক্তিযুদ্ধের পরপর দেশকে গড়ে তোলা এবং সেরা জাতিতে রূপান্তর করায় আমাদের উৎসাহ উদ্যম কোনো অংশেই কম ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে বিশ্বাস উৎসাহ উদ্যম চাপা পড়ে যেতে লাগল, মুক্তিযুদ্ধের সে প্রজ্বলিত চেতনা স্তিমিত হতে লাগল।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে অল্প সময়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বাধীন হওয়া বীর জাতি – আমরা তলিয়ে যেতে লাগলাম হতাশায় এবং ব্যার্থতায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে দেশ সম্পর্কে একটু ভালো কথা বলার কেউ রইল না। আমাদের দেশের মানুষেরাই প্রতিনিয়ত বলতে লাগল – বাংলাদেশ, সে তো তলাবিহীন এক ঝুড়ি!
সেই অন্ধকার সময়ে একটি ছোট্ট সংগঠন তাদের অল্প কিছু সদস্যকে নিয়ে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন করে দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগল। তারা ঘোষণা করল একসাথে স্বপ্ন দেখার, একসাথে মনছবি করার। তারা বিশ্বাস করল- পৃথিবীর সেরা ১০ জাতির মধ্যে একটি জাতি হবে বাংলাদেশ!
সে ছোট্ট সঙ্ঘের সাথে আরও মানুষ যোগ হলো, সে স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়তে লাগল ধীরে ধীরে সারা দেশ জুড়ে।
স্বপ্ন একসাথে তা যে কত প্রবল হতে পারে তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এবং আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে বর্তমান, ২০২১ সালে, যে দেশকে নিয়ে দিকে দিকে আশার আলো জ্বলে উঠছে চারিদিকে। একে এক প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রমাগত সাফল্য অর্জন করে চলছে বাংলাদেশ। দেশের মানুষের এখন মুখে মুখে – সাবাস বাংলাদেশ!
২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করা বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
পৃথিবীজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে উন্নত রাষ্ট্রগুলো, তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ইতিবাচক।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। বৃদ্ধি পেয়েছে মাথাপিছু আয়।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই প্রাথমিক তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে মাত্র ২২টি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। তাদের মধ্যে এগিয়ে থাকা অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ প্রতিবেদন অনুসারে – বিশ্বজুড়ে বৈরী আবহাওয়া ও নানা সংকটের কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শস্য চাল, গম ও ভুট্টার উৎপাদন কমছে। কিন্তু তার উল্টো চিত্র বাংলাদেশে।
বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশে এই তিন খাদ্যশস্যের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে।
ইউএসডিএর অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বজুড়ে চালের উৎপাদন দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমেছে। এমনকি সবচেয়ে বড় চাল উৎপাদনকারী দেশ চীনেও উৎপাদন কমেছে। কিন্তু চালের উৎপাদন উল্টো বেড়েছে বাংলাদেশ, ৩ শতাংশ, যা দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ।
বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।
আগে বাংলাদেশে ৫৬ প্রজাতির ফল চাষ হতো। এখন ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে। এছাড়া কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে আছে বাংলাদেশ।
গত ১০ বছরে দেশে আমের উৎপাদন দ্বিগুণ, পেয়ারা দ্বিগুণের বেশি, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ফল ড্রাগন ও অ্যাভোকাডো এবং দেশি ফল বাতাবিলেবু, তরমুজ, খরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর মতো পুষ্টিকর ফলের উৎপাদনও ব্যাপক হারে বাড়ছে।
আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম বাংলাদেশে ফল উৎপাদনে এই সফলতা তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
বাংলাদেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক যুগে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যমতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়।
এক সময় দেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই কেবল সবজির চাষ হতো। এখন দেশের প্রায় সব এলাকায় সারা বছরই সবজির চাষ হচ্ছে। মোট ৬০ ধরণের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে।
এ ছাড়া মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম! আলু উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম।
খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কামাল মুজেরী বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণা পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের জন্যে উদাহরণ।
‘অভিবাসনের সাপেক্ষে কোভিড-১৯ সংকট’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের এক প্রতিবেদনে
বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি যেখানে চলতি বছর সংকুচিত হবে, সেখানে প্রবাসী আয়ও স্বাভাবিকভাবেই কমবে। তবে বৈশ্বিক মহামারি সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রবাসী আয় বাড়বে ৮ শতাংশ।
এদিকে আউটসোর্সিংয়ে বিশ্বের শীর্ষের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট ও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশগুলোকে ছাড়িয়ে বিশ্বে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ।
ধারণা করা হচ্ছে যে আগামীতে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ৫ শতাংশ অবদান রাখবে আউটসোর্সিং।
২০২০ সালে মার্চে যখন বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন যে মহামারির আঘাতে মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি, ২০২০ সালে ডিসেম্বর মাসে এসে বাস্তবতা দেখা গেল তার উল্টো। মুখ থুবড়ে তো দূরের কথা, উল্টো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
করোনার ভয়ে কাবু না হয়ে, প্রিয়জনদের সেবা শুশ্রূষা করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে ও করোনায় মৃতদেরকে করোনা শহিদ ঘোষণা করে বাংলাদেশ করোনাকে হার মানিয়েছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশের মানুষ। করোনা রোগীরা সেরে উঠছে নিজ ঘরে, আপনজনের মমতায়। করোনায় মৃতদের দাফন হচ্ছে সসম্মানে, এবং দাফনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ, যারা কোয়ান্টাম দাফন টিমের সদস্য।
নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া জাতি করোনায় যে ভেঙে পড়বে না, এটা বিশেষজ্ঞরা বলতে না পারলেও আমরা দেশের মানুষেরা বলেছি। এবং আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলার শক্তি দেখে এই কথা এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
২৫ বছর ধরে আমরা দেশকে নিয়ে যে মনছবি দেখে আসছি, আজকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে। এবং এই মনছবিকে বাস্তবায়িত করতে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে আমাদের সকলের। আসলে আমরা যে যেই কাজটা পারি সেটাতে আমাদের সেরাটা দেয়াই সত্যিকারের দেশপ্রেম।
এবং এর সাথে দেশের জন্যে যে দুটো কাজ আমরা এখন থেকে করতে পারি –
যখন একটি মানুষ একটি পরিবার একটি দেশ ভাবে যে সে পারে না, তখন সে কোনোভাবেই আর পেরে উঠে না। তাই আমরা যে পারি এবং পারব – এই বিশ্বাসের দায়িত্ব আমাদেরই।
তাই আসুন, আজ থেকে আমরা সচেতন হই, যে দেশের নামে কখনো কোনো নেতিবাচক কথা বলব না। যদি আশেপাশে কেউ বলেও, আমরা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নিব, অথবা বলব, যে আসুন আমরা প্রার্থনা করি, নিশ্চয়ই এটা ঠিক হয়ে যাবে।
শুদ্ধাচারী হিসেবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সুনাম ছিল বিশ্বজুড়ে। কিন্তু ইংরেজ শোষণের ফলে আমাদের সেই পরিচয় আমরা ভুলতে বসেছি।
তাই আসুন, আমরা শুদ্ধাচার চর্চা শুরু করি এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ করি। কারণ শুদ্ধাচার চর্চা যদি আমাদের মধ্যে না থেকে, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল ভোগ করবে অল্প কিছু মানুষ। আর যদি আমরা ঘরে ঘরে শুদ্ধাচার চর্চা করতে পারি, তাহলে দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভালো থাকবে, প্রত্যেকে এই সুফল লাভ করবে।
শুদ্ধাচার দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে শুরু করুন নিজেকে দিয়ে। শুদ্ধাচার বই সবসময় সাথে রাখুন। যখনই সময় পান, চোখ বুলিয়ে নিন। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদেরও শুদ্ধাচার বই বা অ্যাপ পড়তে উদ্বুদ্ধ করুন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই যে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন, তা নয়। কিন্তু সবাই তাদের সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এমনকি কৃষকের সেই ছোট্ট মেয়েটিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার সবচেয়ে মমতার, ভালবাসার এবং তার একমাত্র সম্বল – পোষা ছাগলটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ত্যাগ করে।
স্বাধীনতার এই সুবর্ণ জয়ন্তীতে আসুন আমরাও সেই শিশুটির মতো নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ি এবং একসাথে গড়ে তুলি আমাদের স্বপ্নের এই দেশকে।