আসসালামু আলাইকুম। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
আজকের সাদাকায়নে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। জানাচ্ছি বাংলা নববর্ষের এবং মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।
আর পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি আবারো আপনাদের সামনে শুক্রবারের সাদাকায়নে আলোচনায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটি তাঁর দয়া এবং এর মধ্যেই নিশ্চিত কোনো কল্যাণ তিনি সুপ্ত রেখেছেন।
আমরা মাসিক সাদাকায়নে রমজানের রোজা রাখার যে গুরুত্ব এবং সুস্থ থাকার জন্যে রোজার যে প্রয়োজনীয়তা তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।
আসলে মাহে রমজান একদিকে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির জন্যে আত্মিক কার্যক্রমে অংশ নেয়ার সুযোগ এনে দেয়।
গত বছরের রমজানের ন্যায় এ বছরও আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টায় আরো বেশি সময় দেয়ার সুযোগ পরম করুণাময় আমাদেরকে করে দিয়েছেন। এবং আত্মশুদ্ধির জন্যে দেয়ার মতো এত অফুরন্ত সময় গত রমজানের আগে আমরা এভাবে কখনো পাই নি।
গত রমজানের কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনের মতো এ বছরও ঘরে বসে লক্ষ লক্ষ মানুষ খতমে কোরআনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
আজকের সাদাকায়নের পরে নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে ২৩তম বার্ষিক কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনে ঘরে বসে অংশ নিলেও যেহেতু সবাই একসাথে একই সময়ে অংশ নিচ্ছি এইজন্যে প্রত্যেকেই আমরা ১২৫ কোটি বছর নফল ইবাদতের সওয়াব পাব।
আসলে কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন… এই কোয়ান্টায়ন মৌনতা কেন? আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, খতমে কোরআন কোয়ান্টায়নে অর্থাৎ মৌনতার মাঝে করতে হবে কেন?
আসলে এই মৌন থাকা এটা কোরআনেরই নির্দেশ। সূরা আল আরাফের ২০৪ নাম্বার আয়াত হচ্ছে, যখন কোরআন পাঠ করা হয় তখন মৌন থাকো ও মনোযোগ দিয়ে শোনো। যাতে তোমরাও রহমত পেতে পারো।
আসলে কোরআন থেকে রহমত জ্ঞান কল্যাণ শেফা রোগমুক্তি এবং সকল কল্যাণ পাওয়ার জন্যে মৌন থাকা এবং মনোযোগ দিয়ে শোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এজন্যে যখনই কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, এর মর্মবাণী পাঠ করা হয় তখন ঘরে যতদূর সম্ভব মৌনতা অবলম্বন করুন। এবং সবাই মিলে মৌন থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। এবং যখন মনোযোগ দিয়ে শুনবেন মৌন থাকবেন মনপ্রাণ ঢেলে দেবেন তখন নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রহমতের ছায়ায় থাকবেন।
অতএব যেখানেই থাকুন সপরিবারে হোক একা হোক নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে অংশ নেয়ার আন্তরিক প্রয়াস চালান। নিয়ত করে ফেলেন যে, না আমি মৌন থেকে তেলাওয়াত এবং মর্মবাণী অন্তরে অনুধাবন করব।
কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন ছাড়াও এবারে রমজানে আমাদের বিশেষ উপহার হচ্ছে হাদীস পাঠের আসর। শোকর আলহামদুলিল্লাহ ইফতারের আগে ৫টা ৪৫ মিনিট থেকে এই হাদীস পাঠ ও দোয়ার বিশেষ আসর পয়লা রমজান থেকেই শুরু হয়েছে। ইনশাল্লাহ সারা রমজান এই আসর চলবে।
হাদীস পাঠের এই আসর করার সুযোগ আমরা পেয়েছি হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী প্রকাশিত হওয়ায়।
আসলে আমরা যদি গভীরভাবে দেখি তাহলে আমরা দেখব কোরআনের ব্যবহারিক এবং ফলিত রূপই হচ্ছে রসুলুল্লাহর (স) জীবন এবং তার বাণী। আসলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মোহাদ্দিসদের দ্বারা সংরক্ষিত ও সঞ্চারিত হয়েই নবীজীর (স) বাণী আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে হাদীস হিসেবে।
হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী গ্রন্থাকারে ছাড়াও আপনি অনলাইনে পড়তে পারেন এবং পিডিএফ বই হিসেবে ডাউনলোড করেও নিতে পারেন।
আসলে যত পড়বেন সিরাত যত শুনবেন তত আপনার হৃদয় নবীপ্রেমে আপ্লুত হবে। কারণ আপনি তখন বুঝতে পারবেন এত মানবিক এত সমমর্মী এত সুবিচারক এত দয়ালু এত আপন মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়জন আসেন নি।
হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী যত পড়বেন, সিরাত যত শুনবেন তত আপনি অনুভব করবেন তার বাণী সেকালের সেকালের ন্যায় একালেও একইভাবে প্রযোজ্য। সেকালের ন্যায় তার জীবনাচার একালেও একইভাবে অনুসরণীয়।
চারপাশের হিংসা-বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার দিকে যত তাকাবেন তত অনুভব করবেন আল্লাহর রসুলের দিক নির্দেশনা অনুসরণ তার সুন্নতকে অনুসরণ করার মধ্য দিয়েই একালের মানুষ শান্তি পেতে পারে, পরিত্রাণ পেতে পারে, মুক্তি পেতে পারে সমস্ত বালা মুসিবত সমস্ত হিংসা সহিংসতা থেকে।
হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণীর উদ্বোধনী হাদীস-ই বলে দেয় যে তিনি কী ছিলেন!
নবীজী (স) এই হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তোমার মনে কখনো কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা অমঙ্গল চিন্তা থাকবে না। এটাই আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে ভালবাসল সে আমাকে ভালবাসল। আর যে আমাকে ভালবাসল জান্নাতে সে আমার সাথে থাকবে’।
হিংসা বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতায় নিমজ্জিত মানুষের মুক্তির জন্যে এর চেয়ে ভালো বাণী আর কী হতে পারে!
আসলে তিনি শুধু বাণী দিয়ে যান নাই সেই বাণীকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে যা যা করণীয় যা যা করতে হবে তিনি তা নিজে করেছেন। এবং সেভাবেই তিনি দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
জীবনদৃষ্টি অধ্যায়ের সূচনার হাদীসটিই হচ্ছে, নবীজী (স) বলেন, প্রতিটি কাজ তুমি সবচেয়ে ভালোভাবে করবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ।
নবীজী (স)আল্লাহর এই নির্দেশ শুধু মানুষকে জানিয়েই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি তার নিজের জীবনে প্রতিটি কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করার চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজজীবন রাষ্ট্রীয়জীবন ধর্মীয়জীবন সবক্ষেত্রেই তিনি এই সবচেয়ে ভালোভাবে করা অর্থাৎ এহসানের গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নিজে তা পালন করেছেন।
এবং তার সাহাবীরা তাদের জীবনেও প্রতিটি কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এবং সেজন্যেই তারা এক আলোকোজ্জ্বল সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।
আসলে নবীজীর প্রতিটি নির্দেশ সাহাবীরা কত আন্তরিকভাবে পালন করার চেষ্টা করতেন তার অনেক বড় বড় উদাহরণ আমরা জানি। বড় বড় সাহাবীদের জীবনে তার প্রতিফলন আমরা দেখি।
কিন্তু প্রথম সারির শুধু নয় দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ সারির সাহাবীরাও একইভাবে আন্তরিক ছিলেন তাদের অঙ্গীকার রক্ষায়, ওয়াদা পালনে।
একজন সাহাবী জারির ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, আমি নবীজীর (স) কাছে বায়াত করি- নামাজ কায়েম, যাকাত আদায় এবং প্রত্যেক মুসলমানের সাথে সদাচরণের।
ইমাম তাবারানি জারিরের জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন যে, একবার জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) তার এক কর্মচারীকে তার জন্যে একটি ঘোড়া কিনতে পাঠান।
কর্মচারী ৩০০ দিরহাম মূল্যে ঘোড়া কিনে নিয়ে আসেন।
এবং ঘোড়ার মালিককেও সাথে নিয়ে আসেন যাতে জারির তাকে মূল্য পরিশোধ করতে পারেন।
জারির ঘোড়াটাকে ভালোভাবে দেখলেন। বিক্রেতাকে বললেন, তোমার এই ঘোড়ার দাম তো ৩০০ দিরহামের বেশি। তুমি কি এটা ৪০০ দিরহামে আমার কাছে বিক্রি করবে?
বিক্রেতা তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ইচ্ছা। জারির আবারো ঘোড়াটাকে দেখলেন। দেখে বললেন যে, না এটা খুবই ভালো ঘোড়া। এর মূল্য তো ৮০০ দিরহাম হওয়া উচিৎ।
বিক্রেতার এই ব্যাপারে কোনো বক্তব্য ছিল না। সে ৩০০ থেকে শুরু করে যে-কোনো মূল্যেই বিক্রি করতে রাজি ছিল। কিন্তু জারির তাকে ৮০০ দিরহাম দিলেন।
যখন তাকে প্রশ্ন করা হলো, আপনি এটা কেন করলেন? তখন জারির (রা) উত্তর দিলেন যে, আমি আল্লাহর রসুলের কাছে বায়াত করেছিলাম যে আমি প্রত্যেক মুসলমানের সাথে সদাচরণ করব। অর্থাৎ আন্তরিক সুবিচার করব।
আমার আন্তরিক সুবিচারই বলল, এই ঘোড়ার মূল্য ৮০০ দিরহাম। ৩০০ দিরহাম দিলে তাকে ঠকানো হবে। তাই আমি তাকে ৮০০ দিরহামই দিলাম।
আসলে এই ঘটনা থেকে আমরা খুব স্পষ্ট বুঝতে পারি যে, সাহাবীরা প্রত্যেককে তার প্রাপ্য প্রদানের ব্যাপারে কতটা আন্তরিক ও সচেতন ছিলেন।
হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণীর ৪৩ নম্বর হাদীস, জাবির ইবনে সুলাইম (রা) একদিন রসুলুল্লাহর (স) সাথে দেখা করতে এলেন।
জাবির অনুরোধ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমাকে উপদেশ দিন।
নবীজী (স) তখন তাকে বললেন, কাউকে কখনো গালি গালাজ বকাবকি করবে না। ভালো কোনো কাজকেই ছোট মনে করবে না। অহংকারের প্রকাশ ঘটে এমন কিছু করবে না।
জাবির ইবনে সুলাইম (রা) বলেন, এরপর আমি কখনো কোনো মানুষ বা পশুকে গালিগালাজ বা বকাবকি করি নি।
আসলে এই হচ্ছে নবীপ্রেম!
এবারের রমজানে আমাদের প্রত্যেকের নিজের জন্যে প্রার্থনা হোক- আমাদের অন্তরে নবীপ্রেম জাগ্রত হোক। আসলে বাহ্যিক লেবাস পরিবর্তন হলেই, লোক দেখানো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় মেতে থাকলেই নবীপ্রেম জাগ্রত হয় না।
সত্যিকারের নবীপ্রেম হচ্ছে তার সুন্নতকে তার নির্দেশকে নিজের জীবনে অনুসরণ করা।
আসুন আজকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে, আমার মনে কখনো কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা অমঙ্গল চিন্তা থাকবে না।
প্রতিটি কাজ সবচেয়ে ভালোভাবে করার নবীজীর এই সুন্নতকে অনুসরণ করব। এবং প্রত্যেকের ন্যায্য পাওনা ন্যায্য অধিকারকে নিশ্চিত করব। কাউকে কখনো গালিগালাজ বকাবকি করব না। ভালো কোনো কাজকেই ছোট মনে করব না। অহংকারের প্রকাশ ঘটে এমন কিছু করব না।
রমজানের প্রতিটি দিন আপনার এই প্রত্যয় জোরদার হতে থাকুক। ধীরে ধীরে আপনার এই প্রত্যয় আপনার কর্মে রূপান্তরিত হোক। হিংসা বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার বিনাশ ঘটুক নবীপ্রেমের প্লাবনে।
পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে আমাদের সবাইকে সুরক্ষিত রাখুন। তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখুন সুস্থ রাখুন। ভালো রাখুন।
খোদা হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
[১৬ এপ্রিল ২০২১ সাদাকায়নের জন্যে ১৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে গুরুজীর প্রদত্ত বক্তব্য]