ঘোর অন্ধকার। আইয়ামে জাহেলিয়াত। সর্বত্র অসহিষ্ণুতা ঘৃণা বিদ্বেষ হিংসা প্রতিহিংসা ও পাশবিকতার জয়জয়কার। ধর্মের নামে অভিজাতদের সুরক্ষা দেয়াই ছিল পুরোহিতদের কাজ। তাই না ছিল সম্পদের নিরাপত্তা, না ছিল সম্মানের নিরাপত্তা, না ছিল জীবনের কোনো নিরাপত্তা।
কথায় কথায় খুন। আর খুনের বদলা খুন। শিশুকন্যাকে তপ্ত মরুতে জীবন্ত কবর দেয়া ছিল গোত্রীয় গর্ব। সাধারণ মানুষের জীবন ছিল দাসের জীবন। নারী ছিল ভোগ্যপণ্য। লাঞ্ছিত মানবতার অভ্রভেদী আর্তনাদ মিশে যেত আদিগন্ত তপ্ত মরুতে।
না! কোনো সম্রাট রাজধানী হিসেবে এ শহর নির্মাণ করেন নি।
না! সমুদ্র্র বন্দর হিসেবেও এ শহর নির্মিত হয় নি।
না! নদীতীরে পানিবিধৌত শস্যসমৃদ্ধ বিশাল অঞ্চলের আয়েশি ঠিকানা হিসেবেও এ শহর গড়ে ওঠে নি।
না! কোনো বিজয়ী বাহিনীও এ শহরের পত্তন করে নি!
একটি শহর গড়ে ওঠার জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ, বিস্তৃত কৃষিজ অঞ্চল, সহজ যোগাযোগ বা অনুকূল আবহাওয়া কোনোটাই এখানে ছিল না।
দিগন্ত বিস্তৃত মরুপাহাড়, অনুর্বর ভূমি, রুক্ষ আবহাওয়া আর দুর্গম পথের কারণে রোমান, বাইজেন্টাইন বা পারস্য সম্রাটদের কেউই এ অঞ্চল জয়ের জন্যে কোনো বাহিনী কখনো পাঠায় নি।
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সমুদ্র অথবা রোমান বা পারস্য সাম্রাজ্য পরিবেষ্টিত থাকলেও বিশাল আরবভূমিতে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব কখনো ছিল না।
স্বাধীনতাপ্রিয় বিবদমান যাযাবর গোত্রগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ছিল সেখানে শেষ কথা।
এমনি দুর্গম, রুক্ষ, পানি, শস্য ও ফলমূলহীন পাহাড়বেষ্টিত পাথুরে মরুপ্রান্তরে এক মশক পানি আর কিছু শুকনো খাবার দিয়ে এক নারী ও শিশুকে নির্বাসনে রেখে গেলেন একজন প্রবীণ পুরুষ।
মশকের পানি ফুরাতে আর কতইবা সময় লাগে।
খাবার পানি শেষ।
পানির তৃষ্ণায় শিশুর চিৎকারে মা বেরুলেন, এই পাহাড় ওই পাহাড় থেকে চারদিক দেখলেন কোনো ঝর্না কোথাও আছে কিনা?
কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এলেন শিশুর কাছে।
এসে অবাক! শিশুর পায়ের কাছে বালু ভেদ করে বেরিয়ে আসছে পানির ধারা। আজলা ভরে পানি নিয়ে খাওয়ালেন শিশুকে। নিজেও খেলেন।
এত সুস্বাদু পানি জীবনেও খান নি তিনি। কিছু বালু সরানোর পর এটি রূপ নিল কূপের।
যত পানিই নেয়া হোক কূপ থাকে ভরা। পানির স্বাদের কারণে আরবের মরু অঞ্চলে এর পরিচিতিও বাড়ল দ্রুত। কূপের নাম হলো জমজম।
শিশু বড় হয়ে তখন যুবক। পিতা ইব্রাহিম এসে মিলিত হলেন তাদের সাথে।
পিতাপুত্র মিলে পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে এক স্রষ্টার উপাসনার জন্যে নির্মাণ করলেন একটা সাদামাটা ঘর। এ ঘর পরিচিতি লাভ করল আল্লাহর ঘর বলে। নাম হলো কাবা।
এই কাবাঘরকে কেন্দ্র করেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠল জনবসতি। স্থায়ী ঘরবাড়ি নয়। তাঁবু।
তাঁবুতেই বসবাস শুরু করল তারা। যখন ইচ্ছা আবার যাযাবর জীবন।
দূরদূরান্তের বাণিজ্য কাফেলাগুলোও যাত্রাবিরতি শুরু করল পানি নেয়ার জন্যে। বেদুইনরা আস্তে আস্তে আসা শুরু করল এই ঘরে উপাসনা করার জন্যে।
লোক সমাগম বাড়ার সাথে সাথে পণ্যের চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠল বাজার। জীবিকার অন্বেষণে অনেকেই জড়িয়ে পড়ল ব্যবসায়।
কালস্রোতে এক স্রষ্টার সহজসরল উপাসনার স্থলে কাবায় স্থান করে নিতে শুরু করল মূর্তি।
পরস্পরবিরোধী যুদ্ধমান বেদুইন গোত্রগুলো নেমে পড়ল নিজস্ব কল্পিত দেবতার সুদৃশ্য ও ব্যয়বহুল মূর্তি নির্মাণের প্রতিযোগিতায়।
আর কল্পিত দেবতার মূর্তি মিছিল করে কাবায় সংরক্ষণের জন্যে নিয়ে আসা হয়ে গেল পালনীয় রীতি।
সারা আরব জুড়ে বিবদমান স্বাধীন তিন শতাধিক গোত্রের মিলনস্থল হয়ে উঠল মক্কা।
কাবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোত্র পুরো আরবে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠল স্বাভাবিকভাবেই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাবার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে যুরহুম গোত্র।
সে সময়ে মক্কা হয়ে গেল ইয়েমেন, সিরিয়া, হিরা, নজদ-এর বাণিজ্য পথের মিলনবিন্দু।
আর মক্কা থেকে লোহিত সাগরের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার।
যুরহুমরা ভক্তদের নেয়াজ-নজরানা হাদিয়া পেতে পেতে হয়ে উঠল দারুণ আয়েশি ও বিলাসী। যুরহুম গোত্রের সর্বশেষ অধিপতি মুবাদ স্থূল দেহধারী স্বগোত্রীয়দের কর্মে উদ্বুদ্ধ করার অনেক চেষ্টা করলেন।
কিন্তু তাদের শ্রমে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হলেন। আসলে একবার শরীরে মেদ জমে গেলে সাধারণত কেউই পরিশ্রম করতে চায় না। এদের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। আলস্য ও শ্রমবিমুখতা ধ্বংস করল যুরহুমদের সকল কর্তৃত্ব।
যুরহুম গোত্রের স্থলে খুজাহ গোত্র মক্কার অধিকার গ্রহণ করল। তারাই হলো কাবার তত্ত্বাবধায়ক।
তবে মক্কা ছাড়ার আগে দলপতি মুবাদ দুটি প্রমাণ সাইজ স্বর্ণমৃগসহ কাবায় রক্ষিত সকল ধনরত্ন, অস্ত্রশস্ত্র জমজম কূপের পাশে গর্ত করে পুঁতে পুরো কূপ পাথর ও বালি দিয়ে ভরে ফেললেন। জমজমের অবস্থান চিহ্নিত করার সকল নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে দিলেন।
লক্ষ্য ছিল খুজাহরা যাতে কোনোভাবেই জমজমের পানি ব্যবহার করতে না পারে।
কোরাইশরা কাবার তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার আগ পর্যন্ত খুজাহ গোত্রই ছিল মক্কার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
কোরাইশরা মক্কার কর্তৃত্ব পেল কুসাই ইবনে কিলাবের নেতৃত্বে। কুসাইয়ের জীবনও বেশ ঘটনাবহুল।
শিশুকালেই কুসাইর বাবা মারা গেলে তার মা কুদাহ গোত্রের রাবিয়া ইবনে হারামকে বিয়ে করলেন। রাবিয়া স্ত্রীসহ কুসাইকে নিয়ে গেলেন নিজ গোত্রে উত্তর আরবে, ফিলিস্তিন সীমান্তে।
নিজেকে রাবিয়ার সন্তান মনে করেই কুসাই সেখানে বেড়ে উঠলেন। তারুণ্যে তিনি জানতে পারলেন যে, তিনি কোরাইশ গোত্রের কিলাবের সন্তান এবং তার ভাই কোরাইশদের দলপতি।
কুসাই মক্কায় ফিরে এলেন। ভাইয়ের সাথে বসবাস শুরু করলেন। ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান, বুদ্ধি, সাহস, দূরদৃষ্টি ও উদারতার কারণে খুব অল্প সময়েই তিনি মক্কাবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলেন।
তিনি কাবার তত্ত্বাবধায়ক ও খুজাহ গোত্রপ্রধান হুলাইল ইবনে হুবশিয়ার মেয়ে হুব্বাকে বিয়ে করলেন। ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলির কারণে কুসাইকে হুলাইল নিজ পুত্রের মতো স্নেহ করতে শুরু করলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি কুসাইকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কাবার তত্ত্বাবধায়ক এবং মক্কার শাসক ঘোষণা করলেন।
খুজাহ গোত্রের অনেকেই তার প্রবল বিরোধিতা করল। কিন্তু কুসাই সকল বিরোধিতাকে নস্যাৎ করে মক্কায় নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন।
নেতৃত্ব গ্রহণ করে কুসাই মক্কার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী সংস্কার সাধন করলেন। তিনি আরবের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোরাইশদের মক্কায় নিয়ে এলেন।
যে-কোনো কাজ পরামর্শক্রমে সমবেত সিদ্ধান্তে করার জন্যে কাবার অদূরে পরামর্শ ঘর ‘দারুল নাদওয়া’ নির্মাণ করলেন। কার্যত তিনি গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের আদলে মক্কায় অভিজাত নিয়ন্ত্রিত নগর রাষ্ট্রের পত্তন করলেন।
তীর্থযাত্রীদের কাবা প্রদক্ষিণের জন্যে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে কুসাইর নেতৃত্বে আস্তে আস্তে স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ শুরু হলো। এর আগে মক্কায় সবাই তাঁবুতে বসবাস করত।
অভাবী তীর্থযাত্রীদের নিখরচায় খাবার পানি ও যত্নের স্থায়ী ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে প্রতিটি কোরাইশ পরিবারে নির্দিষ্ট চাঁদা ধার্য করলেন তিনি। তীর্থযাত্রীদের জন্যে এই সেবার ব্যবস্থা করায় আরবে কোরাইশদের বিশেষ মর্যাদা সুসংহত রূপ লাভ করল।
কুসাই-এর পৌত্র হাশিমের সময় কোরাইশদের আর্থিক সমৃদ্ধি আরো বাড়ল। তীর্থযাত্রীদের মুগ্ধ করল তার আতিথেয়তা।
ব্যবসায়ে ব্যাপক সাফল্য শুধু তার নিজেরই নয়, কোরাইশদের ভাগ্যও বদলে দিল। তিনি শীত-গ্রীষ্মের বাণিজ্যযাত্রায় কোরাইশদের প্রত্যেক পরিবারকেই সাধ্যমতো বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং বিনিয়োগ অনুসারে আনুপাতিক মুনাফা বণ্টন নিশ্চিত করলেন।
ব্যবসায়িক সাফল্যের ফলে কোরাইশদের মধ্যে ভোগবাদী বিলাসী এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটল।
হাশিমের পর তার পুত্র আবদুল মুত্তালিব কোরাইশদের সার্বিক নেতা হলেন।
আবদুল মুত্তালিব ছিলেন বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী। ‘সিকায়া’ ও ‘রিফাদা’ অর্থাৎ তীর্থযাত্রীদের পানি ও খাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করতে গিয়ে তিনি হিমশিম খেতে লাগলেন।
তার তখন একটিমাত্র পুত্র। একপুত্রকে সাথে নিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের অপর্যাপ্ত পানির কূপ থেকে মশক ভর্তি করে পানি এনে সুষ্ঠুভাবে কাবায় তীর্থযাত্রীদের পানির ব্যবস্থা করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। কীভাবে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করা যায় এই চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।
পানি নিয়ে চিন্তা করতে করতে আবদুল মুত্তালিব একরাতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
স্বপ্নে দেখলেন, কেউ তাকে বলছে, ‘খনন করো’। তিনি বুঝতে পারলেন না, কী খনন করবেন।
পর পর তিন রাত একই স্বপ্ন দেখলেন ‘খনন করো’। কিছুই বুঝলেন না তিনি।
চতুর্থ রাতে স্বপ্ন দেখলেন, কেউ তাকে বলছে, ‘জমজম খনন করো!’
জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় খনন করব? স্বপ্নেই তিনি এর খনন অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পেলেন।
জমজমের অফুরন্ত পানির কিংবদন্তি সবাই জানত। আবদুল মুত্তালিব পরদিন সকালে প্রবল উৎসাহে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝামাঝি স্বপ্নে নির্দেশিত স্থানে পুত্র হারিসকে নিয়ে খনন শুরু করলেন।
তিনি গর্ত করছেন। পুত্র বালু উঠাচ্ছে। খননের শব্দ পেয়ে কোরাইশ গোত্রের লোকজন সেখানে জড়ো হয়ে খনন বন্ধ করতে বলল।
সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, জমজম পুনঃখননের জন্যে স্বপ্ন নির্দেশিত হয়ে তিনি কাজটি করছেন। সবাইকে এই খনন কাজে অংশ নিতে আহবান জানালেন।
কিন্তু তারা এ কাজে অংশ না নিয়ে যার যার মতো হাসাহাসি করতে করতে চলে গেল।
আবদুল মুত্তালিব শুধু ছেলেকে নিয়েই খনন করে চললেন। প্রথমদিন পার হলো। দ্বিতীয় দিনও পার হলো।
একইভাবে তৃতীয় দিনও পার হতে চলল। কূপ বা ধনরত্ন কোনোকিছুরই কোনো চিহ্ন নেই।
ক্লান্ত-শ্রান্ত আবদুল মুত্তালিবের মনেও সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তাহলে স্বপ্নের যে নির্দেশনা তা কি একটা মানসিক বিভ্রম?
যখন তিনি চিন্তা করেছেন, না! আর না। আর খনন করা অর্থহীন! সবটাই পণ্ডশ্রম!
হতাশা ও বিরক্তি নিয়ে যখন ভাবছেন এবার ফিরে যাবেন—তখনই তার বেলচা আঘাত করল কোনো ধাতব দ্রব্যের ওপর।
নতুনভাবে আশান্বিত হয়ে উঠলেন আবদুল মুত্তালিব। ধাতব বস্তুর চারপাশ থেকে বালু সরানোর পর এক এক করে তিনি পেলেন দুটো প্রমাণ সাইজের স্বর্ণমৃগ, ধনরত্ন, তরবারি ও অস্ত্রশস্ত্র।
এরপর দ্বিগুণ উৎসাহে খনন শুরু করলেন। কূপের মুখ খুলে গেল। আহ! পানি! আহ! জমজম! পিতৃপুরুষের কূপ! পানির আর অভাব হবে না।
চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘আল্লাহ মহান!’
আবদুল মুত্তালিবের চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলো। ধনরত্ন আর কূপের পানির ওপর তাদের মালিকানা দাবি করে বলল, এগুলো আমাদের প্রপিতামহের উত্তরাধিকার।
আবদুল মুত্তালিব তাদের পরিষ্কারভাবে বললেন, ধনরত্ন সব কাবার। আর তোমরা কেউই যেহেতু খনন কাজে সহযোগিতা করো নি, তাই কূপের পানির অধিকার শুধুই আমার।
বাকবিতণ্ডা শুরু হলো। অন্যরা বলল, প্রয়োজনে আমরা শক্তি প্রয়োগ করে আমাদের অধিকার আদায় করব। তোমার তো মাত্র এক ছেলে।
তখন আবদুল মুত্তালিব সবাইকে হতবাক করে ঘোষণা করলেন, আল্লাহ যদি আমাকে দশ ছেলের জনক করেন এবং তারা যদি পূর্ণ যৌবন পর্যন্ত বেঁচে থাকে, তবে আমি এক ছেলেকে কাবার সামনে জমজম কূপের পাশে বলি দেবো।
তার এই ঘোষণায় সবাই নির্বাক হয়ে স্থান ত্যাগ করল।
জমজমের সুপেয় পানি আবদুল মুত্তালিবের জীবনে আনল জোয়ার।
তীর্থযাত্রীদের যেমন পানির কোনো অসুবিধা থাকল না, তেমনি পানি তাকে দিল নতুন সুনাম, নতুন মর্যাদা। এক এক করে সন্তানের আগমন ঘটতে লাগল। ছেলের সংখ্যা শুধু দশই হলো না, ছোট ছেলে আবদুল্লাহও পদার্পণ করল পূর্ণ যৌবনে।
বিচক্ষণতা, আতিথেয়তা ও জনপ্রিয়তায় আবদুল মুত্তালিব অতীতের সকল কোরাইশ নেতাকে অতিক্রম করে গেলেন।
আরবে তখন মুখের কথাই শেষ কথা। আর একজন পুরুষ যদি তার কথা অনুসারে কাজ না করে, তবে সে আর পুরুষ পদবাচ্যই থাকে না। আবদুল মুত্তালিবের এখন প্রতিজ্ঞা পূরণের পালা। ছোট ছেলের বয়স এখন পঁচিশ।
তিনি ছেলেদের সবাইকে ডাকলেন। সবাই জড়ো হলে তিনি বহু বছর আগে করা তার প্রতিজ্ঞার কথা জানালেন। সে সময় পুত্রের জন্যে পিতৃ আজ্ঞা পালনই ছিল ধর্ম। ছেলেরা সুবোধ বালকের মতোই বলল, আপনার ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা।
আবদুল মুত্তালিব তখন সমস্যায় পড়লেন, ছেলেদের মধ্যে কাকে বলি দেবেন!
কোরাইশরা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে কাবার দেবতা হুবল-এর শরণাপন্ন হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, হুবল তাদেরকে আল্লাহর ইচ্ছার কথাই জানিয়ে দেয়।পাথর তো আর কথা বলতে পারে না, তাই হুবল প্রভুর কথা জানাত নিক্ষিপ্ত তীরের মাধ্যমে।
যেমন, একটি কাজ করা ঠিক হবে কি হবে না তা জানার জন্যে কাবার পুরোহিত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তিনটি তীর নিক্ষেপ করতেন।একটিতে লেখা থাকত শুভ, আরেকটিতে অশুভ, আরেকটিতে মোটামুটি। যে তীরটি হুবল-এর দিকে মুখ করে পড়ত সেটাকেই প্রভুর ইচ্ছা মনে করা হতো।
নির্ধারিত দিনে আবদুল মুত্তালিব দশ ছেলেসহ কাবার সামনে উপস্থিত হলেন। চারপাশে কোরাইশদের ভিড়। দশ ছেলের নাম দশটা তীরে লিখে পুরোহিত তা যথারীতি নিক্ষেপ করলেন।
দেবতা হুবল-এর দিকে মুখ করে যে তীরটা পড়েছে সেটাকে এখন তোলা হবে।
ছেলেদের মধ্যে শুধু নয়, উপস্থিত সবার মধ্যেই এক উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা আর পিনপতন নীরবতা—কার নাম ওঠে!
তীর ওঠানো হলো। নাম লেখা—আবদুল্লাহ! আবদুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় ও সুদর্শন সন্তান।
পুত্রকে কাছে ডাকলেন তিনি। হাত ধরে নীরবে জমজম কূপের কাছে নিয়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ঘাড় নিচু করে বসতে বললেন।
আবদুল্লাহ সেভাবেই বসলেন। আবদুল মুত্তালিব খঞ্জর উঁচু করতেই যেন সবার সম্বিত ফিরে এলো।
কয়েকজন দৌড়ে এসে হাত ধরে তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু তিনি বললেন, আমি আমার প্রতিজ্ঞা পালনে অটল।
তারা বলল, প্রতিজ্ঞা পালনে বিকল্প কোনো পন্থা পাওয়া যায় কিনা, তা আমরা চেষ্টা করে দেখি। অন্তত সে-পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। এ-ক্ষেত্রে পথনির্দেশনা পেতে কোনো ভালো দৈবজ্ঞের শরণাপন্ন হতে তো কোনো দোষ নেই।
আরবের সবচেয়ে খ্যাতিমান দৈবজ্ঞ মহিলা তখন বাস করতেন মদিনায়। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘কাহিনা’ নামে।
সবচেয়ে দ্রুতগামী উটে আবদুল মুত্তালিবের প্রতিনিধি দল মদিনায় কাহিনার কাছে উপস্থিত হলো।
কাহিনা সব শুনে তাদেরকে পরদিন আসতে বললেন। পরদিন সবাই উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ওখানে একজন অভিজাতের ‘রক্তপণ’ কত? তারা বলল, ১০টি উট।
কাহিনা বললেন, ঠিক আছে তোমরা আবার তোমাদের দেবতার কাছে যাও। এক তীরে আবদুল্লাহ আর অপর তীরে ১০টি উট। তীর নিক্ষেপ করো।
তীরে আবদুল্লাহর নাম উঠলে আরো ১০টি উট লিখে তীর নিক্ষেপ করো। এবারও তীরে আবদুল্লাহর নাম উঠলে আরো ১০টি উট লিখে আবার তীর নিক্ষেপ করো।
যতক্ষণ পর্যন্ত তীরে উট না ওঠে ততক্ষণ পর্যন্ত উটের সংখ্যা ১০টি করে বাড়াতেই থাকবে।
মক্কায় ফিরে এলো সবাই।
আবার কাবা প্রাঙ্গণে দেবতা হুবল-এর মূর্তির সামনে তীর নিক্ষেপের পালা। এক তীরে আবদুল্লাহ। আর এক তীরে ১০ উট।
তীর ছোড়া হলো। দেখা গেল তাতে আবদুল্লাহর নাম।
আরো ১০টি উট। পরের বারও আবদুল্লাহর নাম।
আরো ১০টি উট। এবারও তীরে আবদুল্লাহর নাম।
উটের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যখন ১০০ তে পৌঁছল তখন তীরে উঠল উট। জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ল।
কিন্তু আবদুল মুত্তালিব তখনও নিশ্চিত নন, এটা ঘটনাক্রম না প্রভুর ইচ্ছা।
তিনি বললেন, এটা যদি প্রভুর ইচ্ছা হয়, তবে তিন বার তীর নিক্ষেপ করো। তিন বারই যদি তীরে উট ওঠে, তাহলেই আমি মনে করব এটা প্রভুর ইচ্ছা, ঘটনাচক্র নয়।
তিন বার তীর নিক্ষেপ করা হলো। তিন বারই তীরে উট উঠলো।
এবার সবাই উল্লাসে ফেটে পড়ল। ১০০ উট জবাই করা হলো। আর আয়োজন হলো ভোজের।
খাওয়াদাওয়ার পর মক্কার সবাই ইচ্ছেমতো নিয়ে গেল উটের মাংস।
মক্কার নারীরা আবদুল্লাহর প্রাণ রক্ষা পাওয়ায় যত না উল্লসিত হয়েছিল, হয়তো-বা তার চেয়ে বেশি উল্লসিত হয়েছিল তার রক্তপণ ১০০ উট হওয়ায়।
কারণ এর আগ পর্যন্ত অভিজাত পুরুষদের রক্তপণ ১০ উটেই সীমিত ছিল।
অবশ্য সুপুরুষ আবদুল্লাহর ব্যাপারে অভিজাত পরিবারের কোনো নারীরই আগ্রহের অভাব থাকার কথা নয়।
বনু আসাদ গোত্রের খ্রিষ্টান পণ্ডিত ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের বোন কোয়াতিলা কাবা চত্বরে আবদুল্লাহকে পেয়ে তাকে ১০০ উট উপঢৌকনসহ সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
আবদুল্লাহ বিনয়ের সাথে বললেন, আমি এখনো বাবার অভিভাবকত্বে আছি।
পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় ও পুত্রের মানসিক ধকল কাটানোর লক্ষ্যে আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আবদুল্লাহকে নিয়ে যুহরা গোত্রের গোত্রপতি ওয়াহাবের বাড়িতে গেলেন।
তার কন্যা আমিনার সাথে পুত্রের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ওয়াহাব সানন্দে রাজী হলেন।
বিয়ে করে আবদুল্লাহ আমিনাকে নিয়ে ভাই আবু তালিবের ঘরে উঠলেন।
আবদুল্লাহর বিয়ের দিন ৭৪ বছর বয়সী আবদুল মুত্তালিবও আমিনার চাচাতো বোন হালাহ-কে বিয়ে করলেন।
আবদুল্লাহ-আমিনার দাম্পত্য জীবন ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী। কয়েকদিন পরই পিতার নির্দেশে আবদুল্লাহ গ্রীষ্মকালীন বাণিজ্য কাফেলায় সিরিয়ার পথে যাত্রা করলেন।
বৈরী আবহাওয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মদিনায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
কোরাইশদের সবচেয়ে সুদর্শন ও সৎগুণাবলিতে ভূষিত যুবকের আয়ু ১০০ উট রক্তপণ দিয়েও তিন মাসের বেশি বাড়ল না।
এমনকি জেনেও যেতে পারলেন না যে, তিনি সন্তানের পিতা হতে যাচ্ছেন।
নিয়তি যেন তাকে বাঁচিয়েই রেখেছিল আমিনাকে মা হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যে।
পিতা ইব্রাহিম এক আল্লাহর উপাসনার জন্যে যে ঘর নির্মাণ করেছিলেন, সেই কাবা কালস্রোতে তিন শতাধিক কল্পিত দেবতার মূর্তির নিবাসে পরিণত হলো।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কাবার প্রতি আরবদের আকর্ষণ দিনকে দিন বাড়তেই থাকল। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তীর্থযাত্রীদের আগমনও বাড়ল সমান তালে।
কাবা ও মক্কার প্রতি সাধারণের এই আকর্ষণ ও মর্যাদা আরবের প্রান্তিক রাজ্যগুলোয় তীর্থগৃহ নির্মাণের আগ্রহ সৃষ্টি করল।
ঘাসসানীরা উত্তর আরবের হিরায় তীর্থকেন্দ্র হিসেবে সুন্দর গির্জা নির্মাণ করল।
ইয়েমেনের শাসক আবরাহা আল আশরম নির্মাণ করলেন বিশাল গির্জা। নাম দিলেন ইয়েমেনী আল-কাবা।
গির্জার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি মনে করলেন, শুধু সাধারণ আরব নয়, মক্কার মানুষরাও এখানে আসবে পুণ্যলাভের জন্যে।
কিন্তু কোনোটাই আরবদেরকে আকৃষ্ট করতে পারল না। এমনকি ইয়েমেন থেকেও তীর্থযাত্রীদের মক্কা আগমন অব্যাহত থাকল আগের মতোই।
গির্জাকে ইয়েমেনী আল-কাবা নামকরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মক্কার দক্ষিণে বসবাসকারী বনু কিনানার এক ব্যক্তি ইয়েমেনে গিয়ে গির্জার পবিত্রতা নষ্ট করল।
এই ঘটনায় আবরাহার ক্রোধ চরমে উঠল।
আবরাহা কাবা ধ্বংস করার জন্যে বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কা ও তায়েফের মাঝামাঝি এসে শিবির স্থাপন করলেন।
তিনি তার এক সেনাপতি হুনাসা আল হিসায়রীকে মক্কার চারপাশে লুটপাট চালানোর নির্দেশ দিয়ে বললেন-
মক্কার নেতাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলবে, মক্কার সাথে যুদ্ধ করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই। আমি শুধু কাবাঘর ধ্বংস করেই ফিরে যাব।
আবদুল মুত্তালিব কোনোরকম যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে হুনাসা সরাসরি আবরাহার সাথে আলাপ করার জন্যে তাকে সাথে নিয়ে আসেন।
আবদুল মুত্তালিবের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে আবরাহা তাকে নিয়ে কার্পেটে বসলেন।
আবরাহা তার দোভাষীকে বললেন, জিজ্ঞেস করো অতিথি আমার কাছে কী চায়। আবদুল মুত্তালিব বললেন, তার সেনাপতি যে ২০০ উট লুট করে এনেছে তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্যে ‘রাজাকে’ অনুরোধ জানাতে চান।
আবরাহা তার দোভাষীকে বললেন, তুমি আবদুল মুত্তালিবকে বলো, ‘আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এখন তার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি হতাশ হচ্ছি।
সে কি আমার কাছে লুট করা ২০০ উট ফেরত চাইতে এসেছে? আর তাদের কাবাঘরের কথা ভুলে গেছে—যে ঘর তার ও তার পূর্বপুরুষদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতীক, যে ঘর আমি ধ্বংস করতে এসেছি?
কাবাঘর ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই দেয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে বোঝানোর জন্যে সে-তো একটা বাক্যও ব্যবহার করল না?’
আবদুল মুত্তালিব জবাব দিলেন, ‘আমি শুধু আমার উটের মালিক। কাবাঘরের নিজস্ব মালিক রয়েছে। সেই মালিক নিশ্চয়ই তাঁর ঘর রক্ষা করবেন।’
আবরাহা বললেন, ‘আমার হাত থেকে একে রক্ষা করার কেউ নেই।’
আবদুল মুত্তালিব বললেন, ‘রাজা! আপনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’ আবদুল মুত্তালিব তার ২০০ উট নিয়ে মক্কায় ফিরে গেলেন।
আবরাহা বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উপকণ্ঠে আসার পর ‘মাহমুদ’ নামের অগ্রবর্তী হাতিটি বসে পড়ল। তার পেছনে পেছনে অন্যগুলোও।
বিশাল হাতিটিকে উঠিয়ে দাঁড় করানোর জন্যে সৈনিকদের সকল কসরত ব্যর্থ হলো।
এরপর ওদের মাথার ওপর দিয়ে পাথরের তেজস্ক্রিয় কণা ফেলতে ফেলতে উড়ে গেল আবাবিল পাখির ঝাঁক।
সমুদ্রের দিক থেকে আসা মরুঝড়ে ভেসে এলো ‘গুটিবসন্তের’ জীবাণু।
গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলো সৈন্যরা। ছড়িয়ে পড়ল তা মহামারির মতো। সৈন্যদের অধিকাংশই মারা গেল বা পালিয়ে গেল।
আহত আতঙ্কিত আবরাহা অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে ফেরত যাত্রা করলেন। তার শরীরের অঙ্গগুলো এক এক করে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল।
রাজধানী সানায় পৌঁছে মারা গেলেন তিনি।
পুরো ঘটনা এত আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল যে, আরবরা বছরটারই নামকরণ করল ‘হস্তী বছর’।
আবরাহার হস্তী বাহিনীর বিপর্যয়ে বেদুইনরা নিশ্চিত হলো কাবা পবিত্র ঘর। আর এর তত্ত্বাবধায়করা বহিঃআক্রমণ থেকে সুরক্ষিত। কোরাইশরা বিবেচিত হলো ঈশ্বরের বরপুত্ররূপে।
ধর্মীয় মিলনভূমির পাশাপাশি মক্কা পরিণত হলো আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রে, সকল বাণিজ্যপথের সংযোগস্থলে।
কোরাইশ বণিক সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল আবিসিনিয়া, ইয়েমেন, পারস্য, সিরিয়া ও মিশরের বাজার।
ব্যবসার পাশাপাশি নেপথ্যে পুঁজির নিয়ন্ত্রকও ছিল তারা। বেদুইন গোত্রগুলো কোরাইশদের সাথে মৈত্রী বন্ধনকে করে ফেলল নিজেদের মর্যাদার মানদণ্ড। তাই পুরো বাণিজ্যপথ ছিল নিরাপদ।
মক্কার উত্তরণ ঘটল পুরোপুরি বেনিয়া নির্ভর নগরজীবনে।
বেনিয়া সমাজে ধনসম্পদ হয়ে উঠল মর্যাদা নির্ধারণের একক মানদণ্ড। তাই যাযাবর জীবনের গোত্রীয় সমমর্মিতাও হারিয়ে গেল নগরজীবনের স্বার্থকেন্দ্রিকতায়।
বঞ্চিতের বঞ্চনা গেল আরো বেড়ে। দারিদ্র্য ও বঞ্চনার দিগন্তবিস্তৃত রুক্ষ মরুতে মক্কা পরিণত হলো ভোগ বিলাসিতার দ্বীপে।
ব্যবসা আর মদ ও উদ্দাম ফূর্তির ইন্দ্রিয়জ সুখে ডুবে যাওয়া। এটাই হলো অভিজাত জীবন।
আর এই ইন্দ্রিয়জ সুখের আগুনে ঘি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ক্রীতদাসীদের। মক্কাবাসীদের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল এই নিষ্ঠুর দাসব্যবসা।
কাবার চারপাশে প্রথম সারির ঘর ও বৈঠকখানাগুলো ছিল অভিজাতদের। সামাজিক মর্যাদা অনুসারে পরবর্তী সারির ঘর ও আবাসনের বণ্টন।
সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে বাস করত দাস ও সহায়সম্বলহীন মানুষেরা। একই গোত্রভুক্ত হলেও বঞ্চনার শিকার ছিল সম্বলহীন মানুষ।
মক্কার অভিজাতদের বৈঠকখানায় সন্ধ্যা থেকে বসত মদ আর উদ্দাম ফুর্তির আসর।
বয়স্করা বর্ণনা করত তাদের বাণিজ্য ভ্রমণের কাহিনী- সিরিয়া, বাইজেন্টাইন বা পারস্যের রাজাদের দরবারে তাদের ভ্রমণের ঘটনা বা গল্প।
গল্প বলা, তা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও অন্যের কাছে বলে বেড়ানোর ক্ষেত্রে আরবদের মেধা অতুলনীয়। তাই যে-কোনো ঘটনা বা গল্প মুখে মুখে দূর মরুতে ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগত না।
কারণ মক্কা তখন বহুজাতিক বাণিজ্যপথের সংযোগস্থল। আর বছরের বিভিন্ন সময়ে তীর্থমেলা তো আছেই।
কাবা চত্বরেও বসত এই মাতলামি ও ফুর্তির আসর, তিন শতাধিক মূর্তির পাথুরে দৃষ্টির সামনে।
অভিজাতরা তাদের সকল স্বার্থের পাহারাদার মনে করত এই কল্পিত দেবতাদের।
আরব মরুর যাযাবর গোত্রগুলো ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন। খাবারের অন্বেষণে তারা গবাদিপশুর পাল নিয়ে একস্থান থেকে যেত অন্যস্থানে। ‘গজওয়া’ অর্থাৎ দলবদ্ধ হয়ে দুর্বল পক্ষের ওপর আক্রমণ, মালামাল লুট আর প্রতিহিংসার মধ্যেই ডুবে থাকত তাদের জীবন।
কিন্তু কেউই কোরাইশদের সাথে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে চাইত না। তাই মক্কার অভিজাতদের জীবন ছিল নির্ভার, নিশ্চিন্ত।
আর কোনো ঐশী-কিতাব বা নৈতিক বিধিবিধান সম্বলিত ধর্মের অনুপস্থিতি তাদের মানবিক অবক্ষয়কে দিয়েছিল চূড়ান্ত রূপ।
অর্থই ছিল তাদের দেবতা। পিতৃপুরুষের সংস্কারই ছিল ধর্ম। আর অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষা করাই ছিল কাবার পুরোহিতদের কাজ।
রুক্ষ মরুবেষ্টিত মক্কা সম্পর্কে বাইজেন্টাইন বা পারস্য সাম্রাজ্যের অধিপতিদের তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলেও কোরাইশরা সেখানকার খবরাখবর রাখত ব্যবসায়িক স্বার্থেই।
পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই তখন ধর্মের অবক্ষয়। রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্য হাজার বছরব্যাপী পারস্পরিক যুদ্ধে বিপর্যস্ত ও ধ্বংসোন্মুখ।
কোনো কল্যাণশক্তি বা মানবিক চেতনা বা সত্যধর্মের অনুপস্থিতিতে দুই সাম্রাজ্যের সাধারণ মানুষও ছিল দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ।
ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন একজন নবীর, যিনি তাদের ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।
তারা আশা করছিলেন আরবে এমন নবীর জন্ম হবে তাদের গোত্রেই।
ইহুদি ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতদের এইসব কথাবার্তা মক্কার কোরাইশদের অন্তরকে সন্ত্রস্ত করত সবচেয়ে বেশি।
কারণ তেমনটা হলে, ঐশীবিধান প্রতিষ্ঠিত হলে, তিন শতাধিক দেবতা বিলুপ্ত হলে আরবভূমিতে তাদের অবিসংবাদিত নেতৃত্ব মর্যাদা সবই ভেস্তে যাবে। তাই সর্বকালের শোষকদের মতো মক্কার অভিজাতরাও ছিল সকল ঐশীধর্ম ও নৈতিক বিধিবিধান বিমুখ।
মক্কায় খৃষ্ট বা ইহুদি ধর্মের যে-কোনো ধরনের প্রচার ছিল নিষিদ্ধ। মক্কায় বসবাসকারী ইহুদি বা খ্রিষ্টানরা ছিল দাস বা শ্রমিক। আর এদের আবাসনও নির্ধারিত ছিল মক্কার প্রান্তিক এলাকায়। তাদের ধর্ম সংক্রান্ত কানাঘুষা সীমিত থাকত তাদের মাঝেই।
তবে কোরাইশদের মধ্য থেকেও হাতে-গোনা দু-চারজন মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে নীরবে এক আল্লাহর উপাসনা করতেন। তারা পরিচিত ছিলেন ‘হানিফ’ নামে।
মক্কার ভোগবাদী নগরসমাজ ছিল কার্যত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত।
বেনিয়া অভিজাত পরিবারগুলো কুক্ষিগত করে রেখেছিল সকল ধনসম্পদ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। এরা সমাজের একশতাংশ।
আর নিরানব্বই শতাংশই ছিল দারিদ্র্যপীড়িত বঞ্চিত মানুষ। জীবন, জীবিকা, সম্মান, নিরাপত্তা কোনোকিছুই ছিল না তাদের।
আবার এদের একটা বড় অংশ ছিল ক্রীতদাস। এই নারী ও পুরুষদের জীবনের পুরোটা জুড়ে ছিল শুধুই বঞ্চনা। এদের কান্না শোনারও কেউ ছিল না।
শুধু আরব নয়, ষষ্ঠ শতকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, ভারত, চীন সর্বত্র ছিল এই একই চিত্র।
কিন্তু একটা সভ্যতার একটা সমাজের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের যখন বিপর্যয় ঘটে, অর্থ যখন দেবতায় রূপান্তরিত হয়, ভোগবিলাসিতা যখন মর্যাদার মানদন্ডে পরিণত হয়, সমাজ যখন সাধারণ মানুষের সাথে সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়, সমমর্মিতা যখন শোষকের হাতে চূড়ান্তভাবে বিনাশিত হয়, তখনই ঘটে ইতিহাসের বাঁকবদল।
কখনো সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে, কখনো গণ-অভ্যুত্থানে, কখনো রক্তাক্ত বিপ্লবে, কখনো সত্যধর্মের পুনরুত্থানে।
পাপের ঘট যখন পূর্ণ হয়, তখন ইতিহাসের এই বাঁকবদল ঠেকাতে পারে না কেউই।