নামাজ: এ শব্দটি ফারসি ভাষা হতে আগত। যার শাব্দিক অর্থ দোয়া, ক্ষম্ প্রার্থনা, রহমত ইত্যাদি। নামাজের আরবী হল সালাত। পারিভাষিক ভাবে ইসলামী শরীয়ত নির্দেশিত নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে একান্ত বিশ্বাসের সহিত বিশেষ প্রার্থনা বা ইবাদত।
ইহা ইসলামের ২য় স্তম্ভ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়াক্তে নামাজ পড়া হলেও মিরাজের পর থেকে নামাজের বর্তমান রীতি চালু হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হিসাবে নামাযই একমত্র মাধ্যম। আল্লাহ বলেন “নিশ্চয়ই নামায পাপ ও অশ্লীল কাজ হইতে বিরত রাখে”। ১। মুসলমান ২। বয়স কমপক্ষে ৭ বছর হওয়া ৩। এবং সুস্থ মস্তিষ্কের সকল প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তির উপর নামাজ ফরজ বা আবশ্যক।
নামাজ হচ্ছে বিশ্বাসীর সাথে শরিককারী ও সত্য অস্বীকারকারীর মধ্যে বিভাজন রেখা।
—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); মুসলিম
একজন বিশ্বাসী ও মুনাফেকের মধ্যেও বিভাজন রেখা হচ্ছে নামাজ। যে নামাজ ত্যাগ করল, সে কুফরী করল।
—বুরাইদা (রা); তিরমিজী
নবীজী (স) বললেন : তোমরা একটু ভেবে বলো, তোমাদের ঘরের পাশ দিয়ে প্রবহমান ঝর্নাধারায় যদি দিনে পাঁচ বার গোসল করো, তবে তোমাদের শরীরে কি কোনো ময়লা থাকবে? সাহাবীরা বললেন, না, ময়লা থাকবে না। নবীজী (স) তখন বললেন, দিনে পাঁচ বার ফরজ নামাজের বৈশিষ্ট্যও এই একইরকম। আল্লাহ এই নামাজের মাধ্যমে একইভাবে নামাজীকে গুনাহমুক্ত করেন।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
দেহ-মনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, একাগ্রচিত্তের নামাজ এবং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর ইবাদত—আল্লাহর পথে জেহাদ করার মতোই সওয়াবের কাজ।
—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম
অন্যায় ও দুষ্কর্ম থেকে নিজেকে বিরত না রাখলে আল্লাহর সাথে নামাজীর দূরত্ব বাড়তে থাকে।
—আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা); ইবনে মাজাহ
নামাজ জান্নাতের চাবি।
—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); আহমদ, মেশকাত
একাগ্রচিত্ততা (হুদরিল ক্বালব) ছাড়া নামাজ আল্লাহ গ্রহণ করেন না।
—আল ফজল ইবনে আব্বাস (রা); তিরমিজী
ইহসান (সবচেয়ে ভালোভাবে নামাজ পড়া) হলো, তুমি এমনভাবে নামাজ পড়ো (ইবাদত করো), যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। কারণ তুমি যদি দেখতে না-ও পাও, নিশ্চিতই তিনি তোমাকে দেখছেন।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী
মহাবিচার দিবসে প্রথমেই হিসাব নেয়া হবে নামাজের। নামাজ ঠিক থাকলে সে সফলকাম বলে গণ্য হবে। এখানে হিসাব না মিললে সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ হবে। ফরজ নামাজে যদি কোনো ঘাটতি থাকে, তবে খোঁজ নেয়া হবে নফল নামাজ আছে কিনা। নফল থাকলে তা দিয়ে ফরজের হিসাব মেলানোর সুযোগ দয়াময় দেবেন।
—আবু হুরায়রা (রা); তিরমিজী
আল্লাহর নিকট প্রিয় কাজ হচ্ছে—১. যথাসময়ে নামাজ আদায় করা। ২. পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। ৩. আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা (অর্থাৎ সত্য অনুসরণে সর্বাত্মক প্রয়াস চালানো)।
—আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা); বোখারী, মুসলিম
লোক-দেখানোর জন্যে নামাজ পড়া শিরক। লোক-দেখানোর জন্যে রোজা রাখা শিরক। লোক-দেখানোর জন্যে দান করা শিরক।
—শাদ্দাদ ইবনে আওস (রা); আহমদ
নামাজের জন্যে যখন আজান দেয়া হয়, তখন আজানের শব্দ শোনার সাথে সাথে শয়তান পালাতে থাকে। আজান শেষ হলে সে ফিরে আসে। নামাজের একামত দেয়ার সময় সে আবার পালিয়ে যায়। একামত শেষে সে ফিরে আসে এবং মনে চিন্তার বেড়াজাল সৃষ্টি করে। যা নিয়ে (এতক্ষণ) নামাজী ভাবে নি—এমন জিনিসের ভাবনাও মুহূর্তে মুহূর্তে নিয়ে আসে। আর এই ভাবনার আবর্তে ডুবে গিয়ে একসময় সে ভুলেই যায় যে, সে কত রাকাত নামাজ পড়েছে।
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী, মুসলিম
প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল অবস্থায় নামাজ আদায় করো। ঝিমুনি বা ক্লান্তি এলে সতেজ অনুভূতি না আসা পর্যন্ত ঘুমাও। কারণ ঝিমানো বা ক্লান্ত অবস্থায় নামাজ কখনো প্রয়োজনীয় মনোযোগ পায় না। ঝিমাতে ঝিমাতে সে হয়তো আল্লাহর ক্ষমাপ্রার্থনার পরিবর্তে বিরক্তিতে নিজেকেই অভিশাপ দিয়ে ফেলে!
—আয়েশা (রা), আনাস ইবনে মালেক (রা); বোখারী, মুসলিম
মসজিদে ফরজ নামাজ পড়ে ঘরের জন্যে কিছু নফল (ও সুন্নত) নামাজ রেখে দাও। ঘরে এই নফল ও সুন্নত নামাজ পড়লে তোমার ঘরের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে।
—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); মুসলিম
তোমরা তোমাদের নফল (ও সুন্নত) নামাজ ঘরে পড়ো। ফরজ নামাজ ছাড়া সকল নামাজ ঘরে পড়াই উত্তম।
—জায়েদ ইবনে সাবিত (রা); বোখারী, মুসলিম
নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকবে, তোমার ওজু না ভাঙা পর্যন্ত ফেরেশতারা তোমার জন্যে দোয়া করতে থাকবে : ‘হে আল্লাহ! ওকে ক্ষমা করো। ওর ওপর রহমত বর্ষণ করো।’
—আবু হুরায়রা (রা); বোখারী
সবচেয়ে উত্তম নামাজ হচ্ছে, যে নামাজে নামাজী কিয়াম দীর্ঘায়িত করে। (অর্থাৎ দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে সূরায় মনোযোগ দেয়)।
—জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা); মুসলিম
দীর্ঘ নামাজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষণ একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা প্রকাশ করে। তাই একক নামাজকে দীর্ঘায়িত করো আর ভাষণকে সংক্ষিপ্ত করো।
—আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা); মুসলিম
তোমরা নামাজে রুকুতে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ বলে প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর সেজদায় আল্লাহর কাছে আন্তরিক প্রার্থনায় ডুবে যাও। তোমার দোয়া কবুল হবে।
—আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা); মুসলিম
সেজদার সময় বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। তাই সেজদায় তোমার প্রার্থনায় ডুবে যাও।
—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম
নবীজী (স) আমার হাত ধরে বলেন, প্রত্যেক নামাজের পর প্রার্থনা করতে ভুলো না—‘হে আল্লাহ! সুন্দরভাবে তোমার জিকির করতে, তোমার শোকরগোজার হতে, তোমার ইবাদত করতে তুমি আমাকে সাহায্য করো।’
—মুয়াজ ইবনে জাবল (রা); আবু দাউদ, নাসাঈ
সন্তানের বয়স সাত হলেই তাকে নামাজে উদ্বুদ্ধ করো। (ধীরে ধীরে দৃঢ়তার সাথে উদ্বুদ্ধ করে তার মধ্যে নামাজের অভ্যাস গড়ে তোলো।) ১০ বছর বয়সে নামাজে গাফেলতি করলে শাস্তির ব্যবস্থা করো।
—আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা); আবু দাউদ
তহবন্দ (পাজামা, প্যান্ট) টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে নামাজে দাঁড়াবে না। আল্লাহ এমন লোকের নামাজ কবুল করেন না।
—আবু হুরায়রা (রা); আবু দাউদ
খাবার পরিবেশন করা হয়েছে আর অন্যদিকে নামাজের একামত দেয়া হচ্ছে—এমন হলে আগে খেয়ে নেবে।
—আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা); আহমদ
পেশাব-পায়খানার বেগ চেপে রেখে কখনো নামাজ পড়বে না। মলমূত্র ত্যাগ করে হালকা হয়ে নামাজ পড়বে।
—সাওবান (রা); ইবনে মাজাহ
নামাজের মধ্যে ওপরে, ডানে-বামে এদিক-সেদিক তাকাবে না। নামাজের মধ্যে এদিক-সেদিক তাকানো গুরুতর অনিয়ম।
—আনাস ইবনে মালেক (রা); বোখারী, তিরমিজী
সবচেয়ে বড় চোর হচ্ছে যারা নামাজ থেকে চুরি করে। নবীজী (স) ব্যাখ্যা করে বললেন, ঠিকমতো রুকু সেজদা না দেয়াই হচ্ছে নামাজ থেকে চুরি করা।
—আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফল (রা); তাবারানী
কবিরা গুনাহ (মহাপাপ) থেকে নিজেকে মুক্ত রাখলে এবং নিয়মিত যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে আল্লাহ বান্দার সকল সগিরা গুনাহ (ছোট ছোট পাপ) মাফ করে দেবেন।
—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম
একাগ্রচিত্তে সঠিক সময়ে নিয়মিত ফজরের নামাজ পড়ো। আল্লাহ তোমার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। অতএব, হে মানুষ! সচেতন হও।
—জুন্দুব ইবনে আবদুল্লাহ (রা); মুসলিম
যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে নিয়মিত ফজর ও আসরের নামাজ আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
—আবু মুসা আশয়ারী (রা); বোখারী, মুসলিম
নবীজী (স) আমাকে তিনটি অসিয়ত করেছেন—১. রমজান মাস ছাড়া প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোজা রাখা। ২. সূর্যোদয়ের পর দুই রাকাত চাশতের নামাজ পড়া। ৩. বিতর নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাওয়া।
—আবু দারদা (রা); মুসলিম