আচ্ছা আমাদের সন্তানদেরকে কি আমরা প্রশ্ন করে দেখেছি, সে যে কুরআন বা হিফজ শিখছে সেটা কেন শিখছে?
বা সে যে ওমুক ক্বারীর মত বা অন্য কোন সুরেলা তিলাওয়াত করছে বা শিখছে সেটা কেন শিখছে?
তেমনিভাবে বাংলা-ইংরেজি, বিজ্ঞান বা সাধারণ বিষয়গুলিও সে কেন শিখছে?
বা সাইন্স ও আর্টস এন্ড ক্রাফট ফেয়ারে সে যা বানাচ্ছে সেটা সে কেন বাানাচ্ছে?
চলে আসি মূল কথায়। সন্তানদের নিয়ে, একটি বই পড়ছিলাম “The Book of Manners [Darussalam Publication]”. মনে হলো ছোট থেকে ইসলামী শিষ্ঠাচারের বিষয়গুলি ওদের চিন্তা ও অন্তরে গেঁথে যাওয়া দরকার। বইটিতে প্রথমেই কুরআন তিলাওয়াতের আদব নিয়ে আসা হয়েছে যা কাঙ্খিতই বটে। কিন্তু অবাক হলাম সাব টপিক দেখে, সেখানে তারা প্রথমেই নিয়্যাতের পরিশুদ্ধতা বা ইখলাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। বইটি কিন্তু আদাব বা শিষ্ঠাচার নিয়ে। অর্থাৎ নিয়্যাতের পরিশুদ্ধতা বা ইখলাস সবচেয়ে আগে দরকার। আসলে এটা ঠিক না থাকলে পুরো প্রচেষ্টাই উল্টো দিকে যাবে।
আগে বিভিন্ন কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা দেখতাম ভিডিওতে। সেখানে ভালো তিলাওয়াতকারীদেরকে যা বলে উৎসাহ দেয়া হয়, তা কিছুটা এরকম:”তোমরা পৃথিবীতে সেরা হও, বিশ্বজয় করো, তুমিই পারবে, আল্লাহ তাকে অনেক বড় করুন…” এরকম দোয়া। কিন্তু আমরা না বলেছিলাম আমাদের কুরআন শিক্ষার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি, সেটা কিন্তু কোন আকাঙ্খায় পাওয়া যায় না খুব একটা। আবার ধরেন সন্তানকে হিফজ করানোর সময় আমাদের মনে যেসব ক্বারীর নাম থাকে তাদের সবাই হয়ত পৃথিবীতে সেলিব্রেটি বা বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব। পৃথিবীতে বিখ্যাত হওয়ার সাথেই কি আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত?
তা তো নিশ্চয়ই না। হতে পারে আল্লাহর সন্তুষ্টির মোড়কে মানুষকে সন্তুষ্ট করার বাসনা আমাদের অন্তরে গেড়ে বসেছে। আর এখানেই আসলে আমাদের কাজ করার বিষয়। মানুষের অন্তর তার খাহেশের দিকে যেতে চাইবে এটা অবাস্তব না, সে জন্যই এর বিপরীতে আমাদেরকে প্রচেষ্টাকেও চলমান রাখতে হবে। তেমনিভাবে ইলম অর্জনের আকাঙ্খায় ও লক্ষ্যে নিজের পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’ আগে নিয়ে আসতে হবে, বড় মসজিদের ইমাম হওয়া বা বিখ্যাত আলেম হওয়ার আগেও। এখানেই অনেক শহীদ, আলেম, দানবীরও আটকে যাবেন, যা সহিহ মুসলিমে এসেছে।
তাই মাঝে মাঝেই আমরা নিজেকে প্রশ্ন করতে পারি, এই কাজটা আমি কোন নিয়্যাতে করছি? কর্পোরেট জগতে “Six Sigma” ট্রেনিংয়ে একটা কথা আছে, “What problem you are solving?”- মানে হচ্ছে, কাজ করতে করতে আমরা অনেক সময় মূল উদ্দেশ্য থেকে ছিটকে পড়ি।
তাই মাঝে মাঝেই পরস্পর পরস্পরকে বা নিজে নিজেকে চ্যলেন্জ করা এই প্রশ্ন দিয়ে, যাতে করে মূল যে উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম নিখাঁদ সেটাই অর্জন করতে পারি। দ্বীনের ক্ষেত্রেও আমাদের নিয়্যাতকে বারবার সংশোধনের প্রয়োজন আছে। কারণ যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম তা সময়ের পরিক্রমায় পথ হারিয়ে ফেলতে পারে, আর শয়তান সে চেষ্টায় করে যাচ্ছে। বিশেষ করে যে আকাঙ্খাগুলোর সাথে দুনইয়ার যোগসুত্র আছে [বিখ্যাত ক্বারী হওয়া, বড় মসজিদের ইমাম হওয়া, বা বিখ্যাত দাঈ হওয়া ইত্যাদী] সে পথ পরিক্রমায় মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের নিয়্যাতটাকে শুদ্ধ করে নিতে পারি।
যেমন- তিলাওয়াত সুন্দর করারও অনেক সুন্দর সুন্দর ঘটনা আছে সেগুলো দিয়েই আমরা আমাদের উদ্দেশ্যকে অর্থবহ এবং মূল উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ করতে পারি। যেমন একজন সাহাবীর তিলাওয়াত শুনে মালাইকা নেমে এসেছিলেন, আরেকজন সাহবীর তিলাওয়াত শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) কেঁদেছিলেন, এমন তিলাওয়াত আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শিখতে পারি ও করতে পারি। রাসূল (ﷺ) এর বাণীতে আরও এসেছে,‘‘তোমাদের আওয়াজের মাধ্যমে কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি কর। অর্থাৎ তোমরা সুন্দর আওয়াজের মাধ্যমে কুরআন পড়’’।
[আবু দাউদ: ১৪৬৪, সিলসিলায়ে সহীহা: ৭৭১]
তাই আমরা মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্য না, তারাবী পড়িয়ে উপার্জনের জন্যও না, বিখ্যাত হওয়ার জন্যও না, বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিলাওয়াত, হিফজ বা ইলম শিখবো। বারংবার নিজেকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে এবং ওস্তাজগন শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেবার মাধ্যমে আমরা উৎকর্ষতার যাত্রা পথে ইখলাসটাও বারংবার ঠিক করে নিবো ইনশা-আল্লাহ।
আরেকটি হাদিসে সতর্কবানীও এসেছে- ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য কিংবা অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রতি মানুষের দৃষ্টি কাড়ার অভিপ্রায়ে ইলম শেখে, আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) অগ্নিতে প্রবেশ করাবেন।’
[তিরমিযী: ২৬৫৪, সহীহুল জামি: ১০৬]
এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা বাংলা ইংরেজি শেখার সাথে বা সাইন্স প্রোজেক্টের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয় আবার কি? এটা তো দুনইয়াবী বিষয়। এ প্রসঙ্গে অনেকদিন আগে একজন আলেমের দেয়া একটা উদাহরণ মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন- দু’জন ব্যাক্তির কথা, একজন বাড়ির দেয়াল কেটে জানালা বানালো আলো বাতাস পাওয়ার জন্য, আর একজন আযান শোনার নিয়্যাতে এবং পাশাপাশি আলো বাতাসের নিয়্যাতে জানালা কাটলো। এখানে আলো আর বাতাস দু’জনেই পাবে। কিন্তু আযান শোনার নিয়তের কারনে বাড়তি যে নেকি ২য় ব্যক্তি পাবে তা ১ম ব্যক্তি হারালো। এভাবে জীবনে প্রতিটি দুনইয়াবী কাজ আমরা দ্বীনের সাথে সুন্দর করে যুক্ত করতে পারি এবং সে গুলোতে ব্যয় করা সময় ও শ্রম ইবাদাতে রুপান্তর করতে পারি।
তাহলে হাশরের মাঠে যে ৫টি প্রশ্ন করা হবে তার মধ্যে দু’টি প্রশ্ন-“জীবন কিভাবে কাটিয়েছো?” এবং “যৌবন কিভাবে ব্যায় করেছো?” এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আমাদের সন্তানদের ছাত্র জীবনের ব্যয়কৃত এত সময় ও শ্রম তা ইবাদাতের মধ্যে শামিল করা যাবে।
যেমন- দুনইয়ার বিভিন্ন বিষয় শেখাকে অনেকভাবে আমরা দ্বীনের সাথে যুক্ত করতে পারি:
▪︎ ১. পরিবারের জন্য উপার্জনের দ্বায়িত্ব ও ফজিলত রয়েছে। সে লক্ষ্যে হালাল উপার্জনে সহায়ক জ্ঞান বা দক্ষতা শেখা যেতে পারে, ▪︎২. অনাগত সন্তানদেরকে শিক্ষা দেবার জন্য,
▪︎৩. বিজ্ঞান বা আর্টস এর বিশেষ জ্ঞানগুলো দিয়ে উম্মাহ’র কল্যান সাধনের আকাঙ্খা বা নিয়্যাতের মাধ্যমে…।
এরকম বা এর চেয়ে আরও ভালো নিয়্যাতের মাধ্যমে আমরা আমাদের সন্তানদের বা শিক্ষার্থীদের দুনইয়াবী শিক্ষার নিয়্যাতকেও পরিশুদ্ধ ও অর্থবহ করার উদ্যোগ নিতে পারি। প্রতিটি কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বীজ তাদের অন্তরে বপণ করতে পারি। তবে মনে রাখতে হবে – “এটা একদিনের কোন খেলা নয়”। একবার বলে দিলাম আর সব ঠিক হয়ে গেলো। এটি একটি অনবরত প্রচেষ্টার অংশ। তাই আমরা প্রতিনিয়তই আমাদের নিজেদের নিয়্যাতকে প্রশ্ন করবো, সন্তানদেরকে প্রশ্ন করবো এবং সবাই মিলে আমাদের ইখলাস ও নিয়্যাতটাকে ঠিক করে নিবো ইন-শা-আল্লাহ।
এই নসিহা প্রথমেই আমার নিজের জন্য, তারপর আমাদের পাঠকদের জন্য। আল্লাহ আমাদেরকে ও আমাদের সন্তানদের নিয়্যাত পরিশুদ্ধ করে দিন এবং সেটাতেই স্থির রাখুন। আমীন।