জীবনে সফলতার জন্যেই শুধু নয়, বরং সুস্থতার জন্যেও বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রচলিত ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ কথাটা মূলত এই বিশ্বাসেরই আধুনিক পরিভাষা। রোগমুক্তির বেলায় রোগীর বিশ্বাসটাই এখানে মূল ভূমিকা পালন করে।
প্লাসিবো ইফেক্ট কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট ওষুধের চেয়েও ভালো কাজ করে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক টেড কেপচাক্ আইবিএস রোগীদের নিয়ে একটি গবেষণা চালান, যেখানে ওষুধ হিসেবে তাদেরকে খাওয়ানো হয় সাধারণ কিছু সুগার-পিল-আইবিএস সারানোর ক্ষেত্রে যার আসলে কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এসব রোগীরা তাদের রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান, কারণ তাদেরকে জানানো হয়েছিলো যে, আইবিএস-এর সঠিক ও কার্যকরী ওষুধটিই তারা সেবন করছেন।
ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হল-এর গবেষক আর্ভিং কির্স বলেন, একটি ওষুধ শরীরে কোন প্রক্রিয়ায় কাজ করে তা আমরা রোগীদের বুঝিয়ে দিই, যা প্লাসিবো ইফেক্টকে আরো ফলপ্রসূ করে তোলে। তার মতে, মাথাব্যথা ও ত্বকের সমস্যা দূর, ব্যথা উপশম, হৃদযন্ত্রের গতি ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সংহত করা-প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমরা বিশ্বাসের এ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারি।
‘থ্রি ইডিয়ট্স’ সিনেমার সেই দুরন্ত নায়কের কথা মনে আছে? সবরকম বিপদ-আপদে, জটিল পরিস্থিতিতে বুকে হাত রেখে নিজেকে সে প্রবোধ দেয়-‘অল ইজ ওয়েল, অল ইজ ওয়েল’। আর মুহূর্তেই সব ঠিকও হয়ে যায়, পরিস্থিতি যেমনই হোক সেটি চলে আসে তার অনুকূলে। এবার কিন্তু সিনেমায় নয় বরং বিস্তর গবেষণা আর অনুসন্ধানের পর বিজ্ঞানীরাও বলছেন সেই একই কথা-সবসময় নিজেকে বলুন, সবকিছু ভালোই চলছে। দৃঢ় প্রত্যয়ে নিজেকে শোনান ইতিবাচক শব্দমালা। সত্যি সত্যি তা-ই ঘটতে থাকবে তাহলে।
দৈনন্দিন জীবনের নানা স্ট্রেস শরীরের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উস্কে দিয়ে আমাদের মধ্যে ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’ সৃষ্টি করে। ক্রমাগত এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে ডায়াবেটিস ও স্মৃতিভ্রষ্টতার মতো রোগগুলো অনিবার্য। নেতিবাচকতা ও দুশ্চিন্তা এভাবেই আমাদেরকে অসুস্থ করে তোলে। অন্যদিকে বিশ্বাস আর ইতিবাচকতা শুধু যে স্ট্রেস কমায় তা নয়, এটি ভেতরে একটি নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করে এবং সবকিছু যে শেষপর্যন্ত ভালোই হবে-এমন একটি অনুভূতিরও জন্ম দেয়।
বিজ্ঞানীরা বলেন, আশাবাদী মানুষেরা দ্রুত নিরাময় লাভ করেন। বড় ধরনের অপারেশন থেকে সেরে ওঠা, কার্যকর রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রোগমুক্ত দীর্ঘজীবন লাভ-এসব ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলক এগিয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং কিডনি অকার্যকারিতায় ভুগছেন যারা, তাদের মধ্যেও আশাবাদী ও বিশ্বাসী মানুষেরা অপেক্ষাকৃত সুস্থ জীবনযাপন করেন। তাই গবেষকদের পরামর্শ-আশাবাদী হোন।
মুনী-ঋষি-সাধকরা নির্বাণ লাভের জন্যে ধ্যানমগ্ন হলেও, বিজ্ঞানের এ বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে এসে বিজ্ঞানীদের অভিমত-স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যেও ধ্যানের প্রয়োজন আছে বৈকি। বেশ কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ক্যান্সার রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, গুরুতর বিষণ্নতা দূর, ত্বক সুরক্ষা ও নানাবিধ রোগ এমনকি এইডসের বিরুদ্ধে লড়তেও মেডিটেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মেডিটেশন বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে। আমাদের প্রতিটি দেহকোষে ‘টেলোমেয়ার’ নামক একটি উপাদান থাকে। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এই টেলোমেয়ার ক্রমাগত আকারে ছোট হতে থাকে। আর এতেই বার্ধক্য প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় বলে গবেষকদের ধারণা। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর মাইন্ড এন্ড ব্রেন’-এ ক্লিফোর্ড শ্যারনের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রমাণ করেন এক অভূতপূর্ব তত্ত্ব। সেটি হলো, নিয়মিত যারা মেডিটেশন করেন, অন্তত টানা তিন মাস তাদের শরীরে একটি এনজাইমের পরিমাণ বাড়ে, যা টেলোমেয়ারের আকার বৃদ্ধিতে সহায়ক। ফলে নিরন্তর কোষ বিভাজনের পরও টেলোমেয়ারের আকার অপরিবর্তিত থাকে এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়া ঘটে তুলনামূলক ধীরে।
স্ট্রেসমুক্তির জন্যে মেডিটেশনের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত মেডিটেশন করেন তাদের ব্রেনের এমিগডালা-তে কিছু গঠনগত পরিবর্তন ঘটে। উল্লেখ্য, ব্রেনের এ অংশটি ভয় এবং অন্যান্য নেতিবাচক আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও মেডিটেশন কর্টিসোল নিঃসরণ কমায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রিস্ট এলিসা এপিলের মতে, শরীরের হরমোন নিঃসরণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে মেডিটেশন অত্যন্ত চমৎকারভাবে স্বাস্থ্য-সুরক্ষার কাজটি করে থাকে। তাই বিজ্ঞানীদের পরামর্শ-নিয়মিত মেডিটেশন করুন। আত্মনিমগ্নতার এ সময়টুকু আপনার জীবনকে সার্বিক দিকে সমৃদ্ধ করে তুলবে।
একাকিত্ববোধ আপনার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। এর ফলে বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রষ্টতা থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। সামাজিক একাকিত্বের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জন ক্যাসিয়োপো বলেন, সুস্বাস্থ্যের জন্যে একাকিত্বের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা ধূমপান বর্জনের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চার্লস রেইজন বলেন, যেসব মানুষ সামাজিক জীবনযাপন করেন এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধপূর্ণ সম্পর্কের উষ্ণতায় সজীব থাকেন তারা সহজে অসুস্থ হন না এবং বাঁচেনও দীর্ঘদিন। অন্যদিকে একাকী মানুষেরা সহজেই স্ট্রেস-আক্রান্ত হন। তিনি বলেন, এসব মানুষের শরীরে কর্টিসোল নিঃসরণের হার ও প্রদাহের ঝুঁকি বেশি এবং তাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও তুলনামূলক দুর্বল। ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াজনিত অসুস্থতায় তারা বেশি আক্রান্ত হন। তাই এসব সমস্যা এড়াতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও সঙ্ঘবদ্ধতার মাধ্যমে একাকিত্ববোধ থেকে বেরিয়ে আসাটা জরুরি।
পাশ্চাত্যে হাজারেরও বেশি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা নিয়মিত প্রার্থনা করেন তাদের স্বাস্থ্য অপেক্ষাকৃত ভালো। হৃদরোগ, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুস্থতার হার তাদের কম। এইডস কিংবা মেনিনজাইটিসের মতো রোগের বিরুদ্ধে তাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অধিকতর কার্যকরী। উপরন্তু তাদের ক্যান্সারের ঝুঁকি কম। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারের বিজ্ঞানী রিচার্ড সেলন বলেন, ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষের জীবনযাপন সাধারণত কম০১১) ঝুঁকিপূর্ণ হয়। আর ধর্ম ও আত্মিক চেতনা তো নিজেই একটি আশ্রয়স্বরূপ।
রোগমুক্তি ও সুস্থতার জন্যে ধর্মপালনকে এখন চিকিৎসা ও ওষুধের মতোই একটি সহায়ক-শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, ধর্মের নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ এবং প্রার্থনা প্লাসিবো-ইফেক্টের মতোই সুস্থতার একটি নির্ভরযোগ্য অনুষঙ্গ। ইতালির সান-ডিয়াগো হাসপাতালের গবেষক পাওলো লিসেনি বলেন, ক্যান্সার-আক্রান্তদের নিয়ে পরিচালিত গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, যারা ধর্মীয় ও আত্মিক চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন তাদের ক্ষেত্রে নিরাময়ের শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া অধিকতর জোরদার হয়েছে।
আত্মিক চেতনা নির্ভর জীবনাচরণ মানুষকে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সহজ হয়। জীবনযাপনে স্ট্রেস কমে। মেডিটেশনের বহুমুখী উপকারের বিষয়টি তুলে ধরেছেন যিনি, সেই বিজ্ঞানী শ্যারনের ভাষায়-‘এভাবেই একটি সুন্দর ও অর্থবহ জীবনে পরিপূর্ণভাবে বাঁচার সুযোগ পাই আমরা’।
তথ্যসূত্র : নিউসায়েন্টিস্ট (২৭ আগস্ট ২০১১)