চারদিকে শুধু নয় মাসের যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই। সবখানে জেঁকে বসেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কশাঘাত। প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিস্থিতি কঠিন করে রেখেছিল তারাও। এ-ই ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা। ঠিক সে মুহূর্তে অকৃত্রিম মিত্রতা নিয়ে কয়েকটি দেশ এসে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের পাশে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জাপান। বাংলাদেশকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলোর একটি জাপান। ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় দেশটি। এর পরদিনই দুই দেশ একে অন্যের রাজধানীতে দূতাবাস স্থাপন করে। স্বাধীনতার ঠিক পরপরই বাংলাদেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ৩০ লাখ ডলারের অনুদান দিয়েছিল জাপান সরকার।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও বাংলাদেশীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল জাপানের জনগণ। দেশটির শিক্ষার্থীরা সে সময় তাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের সহায়তায় অংশ নিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে অনেক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এ কারণে বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি ছিল পুরোপুরি শান্তি ও সহযোগিতাকেন্দ্রিক। এজন্য অন্যান্য দেশের প্রয়োজনের মুহূর্তে বরাবরই অনুদান-সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে টোকিও। এ কারণেই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রয়োজনের মুহূর্তে স্বীকৃতি ও সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেরি করেনি দেশটি। তবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জাপান-বাংলাদেশ মিত্রতার ভিত্তিটি গড়ে দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে টোকিও সফরে যান বঙ্গবন্ধু। সে সময় উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তা দিয়ে তাকে বরণ করে নেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা। জাতির জনকের ওই সফরের ধারাবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে অনেকগুলো উচ্চ পর্যায়ের সফর অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছর বাংলাদেশে জাপানের অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ ছিল দেড় কোটি ডলার। পরের বছরই জাপানি প্রকৌশলীরা যমুনা নদীর ওপর একটি সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালান। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানের যুবরাজ আকিহিতো (পরে সম্রাট) বাংলাদেশ সফরে আসেন। এর পর থেকে দেশের উন্নয়ন খাতে জাপানের অংশগ্রহণ ক্রমেই বেড়েছে।
আশির দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে অনুদানদাতা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে উঠে আসে জাপান। এসব অনুদান সহায়তা এসেছে মূলত জাপানের আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) কর্মসূচির মাধ্যমে। নাগোয়া ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের এক গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে, কালক্রম অনুযায়ী জাপানের বাংলাদেশকেন্দ্রিক ওডিএ কর্মসূচিকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে প্রথমটিকে হলো ‘পুনর্গঠন পর্যায়’। এ পর্যায়ে জাপানের অর্থনৈতিক সহায়তার লক্ষ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন। দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য ছিল মূলত ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। তৃতীয় পর্যায়ের লক্ষ্য ছিল অনেকটাই নীতিমালাকেন্দ্রিক। এক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পর বাংলাদেশকে এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণে সহায়তা করা।
চতুর্থ বা বর্তমান পর্যায়কে বলা চলে ‘নবযুগ’ হিসেবে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—উভয় দিক থেকেই দুই দেশের উন্নয়ন লক্ষ্য এক। বাংলাদেশে জাপানের সহযোগিতা আসে প্রধানত তিনভাবে—ঋণসহায়তা, অনুদান ও কারিগরি সহায়তা। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ অন্যান্য সহায়তার দিক থেকে মূল ভূমিকা পালন করে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। দেশের বিদ্যুৎ, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো, পরিবেশ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে জাপানি অবদানের ছাপ স্পষ্ট। বর্তমানে একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে জাপানের মোট সহযোগিতার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশটির বিতরণকৃত ঋণ ও সহায়তার পরিমাণ ছিল ৭১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। গত বছরের আগস্টে জাইকার সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হয়। এখন পর্যন্ত ওডিএ কর্মসূচির আওতায় এটিই জাপান-বাংলাদেশের বৃহত্তম ঋণচুক্তি, যার পরিমাণ প্রায় ৩২০ কোটি ডলার। অন্যান্য উন্নয়ন-সহযোগীর তুলনায় বেশ শিথিল শর্তেই বাংলাদেশকে ঋণ দেয় জাপান। বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সাম্প্রতিক স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তিগুলোয় সুদহার ধরা হয়েছে দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ বছর। এর সঙ্গে গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়েছে আরো ১০ বছর।
এছাড়া দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যেও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গঠন করা হয়েছে জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (জেবিসিসিআই)। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে সংগঠনটি। বড় অংশীদারদের মধ্যে জাপানের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ঘাটতি তুলনামূলক কম। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে ক্রমাগত বিনিয়োগ বাড়িয়ে চলেছেন জাপানি ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছরে এ বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেআইটিও) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালেও বাংলাদেশে চালু জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ছিল ৭০টি। এক দশক পর ২০১৮ সালের মধ্যে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৮-এ। বাংলাদেশে এখন জাপানি অনেক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডেরই সরব উপস্থিতি রয়েছে। দেশটির মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হোন্ডা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে। এছাড়া দেশে ইয়ামাহা মোটরসাইকেলের সংযোজন ও বিপণন করছে এসিআই।