ছেলেবেলা থেকেই উদ্ভাবনের নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতো সুমনের মাথায়। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একবার নরসিংদী শহরে গেলেন প্যান্ট কিনতে। রেলস্টেশনে দেখলেন, একজন ফেরিওয়ালা কতগুলো সুন্দর পাখা হাতে ‘থাইল্যান্ডের পাখা’ বলে বিক্রি করছে। পাখায় নানান দৃশ্যের ছবি আঁকা। পাখাটা ভাজ করলে ছোট হয়ে যায়। সুমন আশ্চর্য হন। পাখার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিনতে চাইলেন, কিন্তু পকেটে তখন মাত্র পাঁচ টাকা। কেবল সিঙ্গারা খাওয়ার পয়সা।
পাখাটি কিনতে না পেরে সুমন চিন্তা করলেন, এই পাখা কীভাবে বানানো যায়! ফেরিওয়ালাকে বলে হাতে নিয়ে দেখলেন, সেলাইটা পরখ করলেন। বাড়ি ফিরে তালপাতা সংগ্রহ করে বানিয়ে ফেললেন সেই পাখা। স্কুলে নিয়ে যাবার পর বন্ধুদের মধ্যে এ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। একজন শিক্ষক নিতে চাইলেন, সেজন্যে নতুন করে আরো পাখা তৈরি করলেন সুমন।
সুমন সিকদার জন্মেছেন নরসিংদীর রায়পুরার গোবিন্দপুরে। বাবা বাচ্চু সিকদার ছিলেন তাঁত ব্যাবসায়ী। আশারামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার হাতেখড়ি। নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন।
সুমন যখন কলেজে ভর্তি হন, সেসময় বাবা অসুস্থ হয়ে প্রবাস থেকে একপ্রকার শূন্য হাতেই ফিরে আসেন। সংসারে অভাব দেখা দেয়। অনেক দূরে কলেজের পথ হেঁটেই যাতায়াত করতেন সুমন। কলেজ থেকে ফিরে তাঁত বোনার কাজ করতেন। এভাবে এইচএসসি শেষ করেন। অনার্সে ভর্তি হন নরসিংদী সরকারি কলেজে। কাজ নেন ভেলানগরের মেডিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। খাবার বাবদ পেতেন ৭০০ টাকা। কোনো আলাদা বেতনভাতা ছিল না। রাতে থাকার জায়গাও ছিল না। ডায়াগনস্টিকের মালিক ল্যাবের ফ্লোরে থাকার অনুমোদন দেন। সেখানে থাকেন দুই বছর। খাবার টাকা বাঁচিয়ে বাসায় বাবা-মাকে টাকা পাঠাতেন। ভাইদের নিয়ে চিন্তা করতেন। তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবতেন। ২০০৭ সালে ৩ হাজার ২ শত টাকা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন।
২০০৭ সালে ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরির অবসরে ওয়ালম্যাট বানাতেন সুমন। প্রকৃতির বিভিন্ন চিত্র, ফুল, আল্লাহ’র নাম আঁকতেন। সুতা, পুঁতি, ধান, চাল ও ডালের দানা ইত্যাদি দিয়ে বানাতেন। কখনো বিক্রির চিন্তা করেন নি। একদিন প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘শুনলাম, তুমি ওয়ালম্যাট বানাও। আমাকে একটা ওয়ালম্যাট দাও।’ সুমন তাকে আরবি ক্যালোগ্রাফির একটা ওয়ালম্যাট দেন। ম্যানেজার খুশি হয়ে ৫০ টাকা দেন। তার ভালো লাগে। এরপর নিত্য নতুন ডিজাইনের ওয়ালম্যাট বানাতে থাকেন। সেবার নরসিংদী শহরের স্টেডিয়ামে কুটির শিল্প মেলা হয়। মেলায় স্টল দেওয়া শফিক নামে এক দোকানি তার সঙ্গে দেখা করেন। সুমন বললেন, ‘উনাকে আমি ১৫টি ওয়ালম্যাট দিই। তিনি আমাকে মেলা শেষে ২ হাজার ৪ শত টাকা দেন। এরপরই আমি ওয়ালম্যাট বাজারজাত করতে শুরু করি।’
২০১৩ সালের শেষ দিকে সুমনের মেয়ে ঐশির জন্মদিন ছিল। মেয়ের জন্মদিনে বাজার থেকে ৫ টাকা দিয়ে একটি কালো রাউন্ড বেন কেনেন। রিবন পেপার দিয়ে ফুল বানিয়ে পুরো বেন জুড়ে লাগিয়ে দেন। মাঝখানে বসান একটি বড় ফুল। একদম বাজার থেকে কেনা বেনের মতই দেখতে হয় সেটি। জন্মদিনে আসা আত্মীয়স্বজনসহ অনেকেই বায়না ধরেন এধরনের বেন বানিয়ে দেয়ার জন্যে। সুমন বানাতে শুরু করেন। সবার জন্যে নানান ডিজাইনের বেন বানান। তারা একটি রাউন্ড বেন ৪০ টাকা করে দেন।
সুমন এটাকে বাজারজাত করার চিন্তা করেন। তারপর ১২টি বেন বানিয়ে নরসিংদীর ইনডেক্স প্লাজার দোকানি মামুনকে দেখান। মামুন অবাক হন। একদিনেই বিক্রি হয়ে যায় সবগুলো। দ্রুত আরো বেন বানানোর জন্যে চাপ আসে সুমনের। এরপর চকবাজার থেকে কাঁচামাল কিনে এনে ব্যাপক পরিসরে কাজ শুরু করেন তিনি। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অসংখ্য বেন তৈরি করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেছেন সুমন। দোকানিরা বিশ্বাস করত না, এটা সুমন বানিয়েছেন। অনেকেই বলতেন, ‘মিয়া আপনি মিথ্যা বলেন। এটা চায়নার প্রোডাক্ট!’
তখন ২০১৭ সাল। বাজার থেকে মাটির ফুলদানি নিয়ে আসেন সুমন। ফুলদানির ওপর আটা, ময়দা দিয়ে ডিজাইন শুরু করেন। লক্ষ করলেন, ভালোই দেখায়। ফুলদানিতে নতুনত্ব আসে। পরে ফুলদানির ওপর নানা রকম ডিজাইন দিয়ে নতুন অবয়বে ফুলদানি বানাতে শুরু করেন। নানা ফেলনা জিনিস—প্লাস্টিক বোতল, হারপিকের বোতল, শ্যাম্পুর বোতল, হোয়াইট সিমেন্ট ও রংতুলি ছিল তার ফুলদানি তৈরির উপকরণ। এরপর তৈরি করতে শুরু করেন অভিনব সব শো-পিস।
সব কাজে সুমনের স্ত্রী তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। পরিচিত একজন বললেন, সুমনের ভিন্ন এই কাজগুলো ভিডিও করে ইউটিউবে চ্যানেলে দেয়া যেতে পারে। আইডিয়াটা ভালো লাগে সুমনের। ‘কুটি বাড়ি’ নামের একটি চ্যানেল খুলে ধীরে ধীরে প্রচুর ভিউয়ার ও সাবস্ক্রাইবার পেতে শুরু করেন তিনি।
সুমনের চ্যানেলে এখন ২৩ লাখ সাবস্ক্রাইবার আছে। একটি ভিডিওতে সর্বোচ্চ ভিউ হয়েছে ২১ মিলিয়ন। প্লাস্টিকের বোতল পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নানা সামগ্রী তৈরির বিষয়টি নিয়ে অনেকেই প্রশংসা করেছেন। এর মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার বার্তাও দেন সুমন।
২০১৯ সালে ইউটিউব থেকে প্রথম সিলভার বাটন পান সুমন। দ্বিতীয়বার আরও একটি সিলভার বাটন পাওয়ার পর গোল্ড বাটনও পেয়েছেন। এজন্যে দর্শকসহ সকলের কাছে কৃতজ্ঞ তিনি। পরিবারের সহায়তা সবসময় সাথে ছিল বলেই হাতের কাজের পাশাপাশি সফল ইউটিউবার হতে পেরেছেন বলে মনে করেন তিনি।
সারা রাত জেগে কাজ করেন সুমন। সবসময় নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন। স্ত্রীও এতে উৎসাহ দেন। সুমনের ইচ্ছা, অচিরেই শো-পিস তৈরির একটি ফ্যাক্টরি গড়বেন। সেখানে অনেকের কর্মসংস্থানও করবেন। ফেলনা জিনিস তৈরির মাধ্যমে সুমনের জীবন পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। এখন তার সংসারে কোনো অভাব নেই। সুমন মনে করেন, কেবল চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারেও ভাবতে হবে। আর যেকোনো কাজে লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই।
সূত্র : ইত্তেফাক (৬ নভেম্বর, ২০২১)
নতুন মন্তব্য