ইয়োগা কারো কাছে জীবন বদলকারী; কারো কাছে জীবনযাপনের অনুষঙ্গ। বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি মানুষ ইয়োগা চর্চা করে।
২০১৪ সালের এক জরিপে দেখা যায়- ২ কোটি আমেরিকান যাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি, তারা নিয়মিত ইয়োগা চর্চা করছে। আমেরিকার কোনো শহরে একটি উপমহাদেশীয় রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাওয়ার চেয়ে সহজ কোনো ইয়োগা সেন্টার খুঁজে পাওয়া।
ইয়োগার ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক বাস্তবতা ও বহুমুখী মনোদৈহিক উপকারিতা বিবেচনা করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের ১৭৫টি দেশের সম্মতিক্রমে ২১ জুন-কে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন হরপ্পা সভ্যতার পোড়ামাটির একটি লিপিতে ইয়োগার সবচেয়ে সুপরিচিত ভঙ্গি পদ্মাসনের চিত্র খোদাই করা ছিল।
এরও প্রায় ২,০০০ বছর পর সাধকগণ আসন, ধ্যান ও প্রাণায়াম অনুশীলন শুরু করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে সাধক পতাঞ্জলি ইয়োগার প্রাচীন সূত্রগুলো সংকলন করেন; তৈরি করেন একটি সমন্বিত দর্শন।
শত শত বছর ধরে সাধকদের নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন আর ইয়োগার সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্তকরণে ইয়োগা আজ পরিণত হয়েছে সার্বজনীন অভ্যাসে।
দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গতিশীল করে শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখার এই প্রাচীন পদ্ধতি খুবই কার্যকর।
যে-কোনো ধর্মবিশ্বাস, জাতিগত ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির মানুষই ইয়োগা চর্চা থেকে মনোদৈহিক উপকার পরিপূর্ণভাবেই পেতে পারেন।
বিশ শতকে পাশ্চাত্যে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ইয়োগার চেয়ে উন্নততর কোনো ব্যায়াম এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
নরেশ ত্রিহান, একজন ভারতীয় কার্ডিওভাসকুলার ও কার্ডিওথোরাসিক সার্জন। তিনি বলেন- ইয়োগাই একমাত্র ব্যায়াম যাতে আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির ব্যায়াম হয়। ইয়োগার বিভিন্ন আসনে থাইরয়েড গ্রন্থি, পিটুইটারি গ্রন্থি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয়, কিডনি, অন্ত্র সবকিছুরই ব্যায়াম হয়। অন্য কোনো ব্যায়ামে এটা সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন- আমি ইয়োগার বহুবিধ গুণাবলি সম্পর্কে জানি; এটা আমাদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী উপকার সাধন করে। আমি ইয়োগাকে রোগীদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করি।
ইয়োগা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনের স্ট্রেস কমায়, দেহ-মনকে টেনশন মুক্ত করে, দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। নিয়মিত ইয়োগা তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ইয়োগা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুসফুস। নিয়মিত ইয়োগা ও প্রাণায়াম ফুসফুসকে শক্তিশালী করে। ফলে ফুসফুস করোনাভাইরাস প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সবাইকে ইয়োগা ও প্রণায়াম করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
শুরুটা ১৯৮০ তে। দেশে যোগ মেডিটেশন চর্চা এক নতুন মাত্রা লাভ করে এসময়।
কোয়ান্টামের প্রাণপুরুষ গুরুজী শহীদ আল বোখারী মহাজাতক দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক পদে ইস্তফা দিয়ে শান্তিনগরে অফিস স্থাপন করেন।
অফিসটি হয়ে ওঠে সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন তথা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র।
এখানে বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাতীয় অধ্যাপক মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, কবি আবদুস সাত্তার, সাংবাদিক ওবায়েদ-উল-হক, প্রফেসর রফিকুল ইসলাম, বেগম সুফিয়া কামাল, কবি আল মাহমুদ, কামাল লোহানী, কবি বেলাল চৌধুরীসহ বহু গুণীজন।
তখন থেকেই গুরুজীর সাথে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম নিয়ে আলোচনা ও অনুশীলনে নিয়মিত অংশ নিতেন শিল্পাচার্য কামরুল হাসান, শিল্পী-গুরু রশীদ চৌধুরী, ড. আখলাকুর রহমান, ড. কাজী মফিজুর রহমান ও ইঞ্জিনিয়ার শাফাত খৈআম প্রমুখ ব্যক্তিত্ব।
১৯৮২ সাল থেকেই মহিলাদের ইয়োগা প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন গুরুজীর সহধর্মিণী মাদাম নাহার আল বোখারী। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মহিলাদের ইয়োগা প্রশিক্ষণ শুরু করেন।
১৯৮৩ সালে ইয়োগা ও মেডিটেশনকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় যোগ মেডিটেশন কেন্দ্র।
গুরুজীকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেন প্রফেসর এম ইউ আহমেদ। যোগ মেডিটেশন কেন্দ্রে নিয়মিত ইয়োগা চর্চা করতেন ডা. ফজলুর রহমান, অভিনেতা আখতার হুসেন, ড. কাজী মফিজুর রহমান।
১৯৮৬ সালে যোগ মেডিটেশন কেন্দ্র রূপান্তরিত হয় যোগ ফাউন্ডেশনে।
ইয়োগা নিয়ে মাদাম নাহার আল বোখারীর নেতৃত্বে গবেষণা লাভ করে নতুন গতি। এরই ফলশ্রুতিতে রচিত হয় ‘রোগ নিরাময়ে কোয়ান্টাম ব্যায়াম ও সৌন্দর্য চর্চা’ বইটি। বাংলাদেশে এটিই ইয়োগার সবচেয়ে জনপ্রিয় বই।
যোগ ফাউন্ডেশনের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার আলোকে যোগব্যায়ামে আনা হয় আধুনিকায়ন। কোয়ান্টাম ইয়োগা- প্রচলিত যোগ ব্যায়ামেরই সরল ও আধুনিক সংস্করণ। যোগাসনের সাথে কোয়ান্টাম সূত্রের প্রয়োগে কোয়ান্টাম ইয়োগা হয়ে ওঠে যোগের সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ একটি প্রক্রিয়া।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইয়োগা প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে।
পরিশ্রম কম। উপকার বেশি। ফলাফল বহুমুখী। কোয়ান্টাম ইয়োগা তাই বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
দেশব্যাপী কোয়ান্টাম ইয়োগা প্রশিক্ষণে কাজ করছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একঝাঁক আন্তর্জাতিক মানের ইয়োগা প্রশিক্ষক। প্রতিমাসেই নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোয়ান্টাম ইয়োগা কোর্স।
কোর্স পরবর্তী চর্চার সুবিধার্থে রয়েছে ইয়োগার দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক কার্যক্রম। ফলোআপ প্রোগ্রাম ছাড়াও রয়েছে ইয়োগা সংক্রান্ত কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা।
ইয়োগার প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ ও প্রশিক্ষণ বিষয়বস্তুকে সমৃদ্ধকরণ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করছে কোয়ান্টাম ইয়োগা ক্লাব। সুসংগঠিত ইয়োগা প্রশিক্ষক টিম নিয়ে ইয়োগা ক্লাব সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম ও ওয়ার্কশপ পরিচালনা করে থাকে।
শুধু ইয়োগা নিয়েই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট।
বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিসিএস প্রশাসন একাডেমি, নির্বাচন কমিশন, জুডিশিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বিয়াম ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ইয়োগা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোতেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে কোয়ান্টাম ইয়োগা ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণ।
২০২০ সালে ভারতীয় হাই কমিশন, ঢাকা, বাংলাদেশের উদ্যোগে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন যে সপ্তাহব্যাপী অনলাইন কর্মশালার আয়োজন করে তাতে অংশ নেয় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
২০২১ সালেও ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে বি উইথ ইয়োগা, বি অ্যাট হোম শিরোনামে আয়োজিত অনলাইন কর্মশালা। এতে শিশু, মহিলা, বয়স্ক, পেশাজীবী ইত্যাদি বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপযোগী বিভিন্ন ইয়োগার প্রদর্শন করে কোয়ান্টাম।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন চ্যানেলের আমন্ত্রণে টেলিভিশন মিডিয়ার মাধ্যমে ইয়োগা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ইয়োগা প্রশিক্ষকগণ।
কোয়ান্টাম ইয়োগা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে ফলপ্রসু ইয়োগা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত। তাই শারীরিক সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, আবেগীয় ভারসাম্য ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্যে আমাদের প্রত্যেকেরই নিয়মিত কোয়ান্টাম ইয়োগা চর্চা করা উচিত।