আইএমএফ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও)-এ সংস্থাটি বলছে, করোনার প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত—উভয় দেশই বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। এর মধ্যে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে বেশি, ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ভারতের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও আগের বছর ভারতের অর্থনীতি বেশি মাত্রায় সংকুচিত হয়েছিল। এ কারণেই আবার এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সামনে।
ঠিক এক বছর আগে আইএমএফ এবারের মতোই ডব্লিউইও প্রকাশ করে জানিয়েছিল, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ঋণাত্মক, অর্থাৎ (-) ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর ফলে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার ও ভারতের হবে ১ হাজার ৮৮৭ ডলার। সুতরাং গতবার বাংলাদেশ ছিল ঠিক এক ডলারে এগিয়ে।
আইএমএফ অবশ্য এখন এসে বলছে, ২০২০ সালে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ভারতের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক, (-) ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের হিসাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হয় ১ হাজার ৯৬১ দশমিক ৬১৪ ডলার এবং ভারতের ১ হাজার ৯২৯ দশমিক ৬৭৭ ডলার। সুতরাং আসলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হয়েছিল ৩১ দশমিক ৯৩৭ ডলার।
মূলত এবার রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার কথা বলা হলেও আগের বছরের উচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির প্রভাবেই এখনো পিছিয়ে আছে ভারত। এমনকি আগামী বছরও ভারত পিছিয়ে থাকবে বলে আইএমএফ মনে করে। চলতি বছরের পূর্বাভাসে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি বেশি হবে ২২ দশমিক ৩৫ ডলার।
মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও আকারের দিক থেকে ভারত বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অর্থনীতি ১০ গুণ বড়। একটি দেশের নাগরিকেরা আসলেই কতটুকু সম্পদশালী, সেটা বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের ক্রয়ক্ষমতা কতটুকু, তা নির্ধারণ করা। অর্থাৎ যে অর্থ আয় করেন, তা দিয়ে তিনি কী কী কিনতে পারেন। এ কারণেই বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে তুলনার জন্যে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) ভিত্তিতে জিডিপির আকার হিসাব করা হয়। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে পিপিপির ভিত্তিতে জিডিপির হিসেবে বিশ্বে ভারতের অংশ ৭ দশমিক শূন্য ৩৯ শতাংশ, আর বাংলাদেশের অংশ মাত্র শূন্য দশমিক ৬৫৯ শতাংশ।
তবে জিডিপিতে বাংলাদেশ পরপর দুই বছর ছাড়িয়ে গেলেও বেশ কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটিকে ছাড়িয়ে গেছে আরও সাত বছর আগে। যেমন ভারতের মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার হার বেশি ও নারীপ্রতি জন্মহার কম। আবার ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে নবজাতকের ও পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হারও কম।
অর্থনীতিবিদ, গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ গত বছর যখন মাথাপিছু জিডিপিতে এগিয়ে গেল, তখনো আমরা বলেছি, ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে আমরা এখনো পিছিয়ে। ভারত অনেক বড় দেশ। সেখানে বিহার ও ছত্তিশগড়ের মতো যেমন প্রদেশ আছে, তেমনি দিল্লি ও পাঞ্জাবের মতো রাজ্যও আছে। তাই গড় করলে সবার প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। আর ক্রয়ক্ষমতার সূচকে তারা এগিয়ে মানে জীবনযাত্রার মানে এগিয়ে। তবে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ভালো করছে। সুতরাং মাথাপিছু জিডিপি ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে নজর দিতে হবে।
গত বছর অক্টোবরে প্রথম যখন আইএমএফ বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া পূর্বাভাস দেয়, তখনই এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। ভারতের গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়। আলোচনা হয় বাংলাদেশেও। এমনকি পাকিস্তানেও একাধিক গবেষক এ নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনও পিছিয়ে ছিল না। ধারণা করা হয়, মোদিবিরোধী শিবির তাকে ঘায়েল করার সুযোগ হারাতে চায়নি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও এ নিয়ে একটি টুইট করেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘আইএমএফের প্রাক্কলন দেখাচ্ছে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে। যেকোনো উদীয়মান অর্থনীতির ভালো করাটা সুসংবাদ। তবে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পাঁচ বছর আগেও যে ভারত ২৫ শতাংশ বেশি এগিয়ে ছিল, সেই ভারত এখন পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন ভারতের প্রয়োজন একটি সাহসী আর্থিক ও মুদ্রানীতি তৈরি করা।’
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া মোটেই আকস্মিক কিছু নয়। তবে ২০০৪ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি অনেক বেশি দ্রুত হারে এগিয়েছে। এই এগিয়ে যাওয়া বজায় ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ২০১৭ থেকে। এর পর থেকে ভারতের অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়া শ্লথ হয়ে পড়ে, আর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে দ্রুতগতিতে। আবার গত ১৫ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর বাংলাদেশের বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এসবের প্রভাব পড়েছে মাথাপিছু আয়ে। ২০০৭ সালেও কিন্তু বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। আর ২০০৪ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।
সূত্র: প্রথম আলো (১৩ অক্টোবর, ২০২১)