এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যখন আরোহণ করলাম, তখন আমাদের এ অর্জনকে আমরা বাংলাদেশের সকল তরুণ-তরুণীর জন্যে উৎসর্গ করেছি। তরুণ-তরুণীদের বলি, আমরা যদি এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করতে পারি, তাহলে আপনারাও প্রত্যেকে নিজ নিজ এভারেস্ট জয় করতে পারবেন। প্রতীকী অর্থে এভারেস্ট আসলে প্রতিটি মানুষের অন্তরের স্বপ্ন। তবে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, সাফল্যের কোনো শর্টকাট নেই। ধৈর্য ধরে লেগে থাকলে সাফল্য আসবেই।
২২ জানুয়ারি ২০২২ মুক্ত আলোচনার ১০৩ তম পর্বে এ কথাগুলো বলেন, দু’বারের এভারেস্টজয়ী অভিযাত্রী জনাব এম এ মুহিত। এ পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল আত্মজয়ের অভিযাত্রা। সভাপতিত্ব করেন বরেণ্য অভিযাত্রী, পাখি-গবেষক, লেখক ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইনাম আল হক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব এম এ মুহিত বলেন, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে এভারেস্ট জয় করেছি। তুষার ঝড়, রোদের প্রখর তাপ, তুষার ধ্বস, শত শত ফুট গভীর খাদের ওপর দিয়ে মই বেয়ে যাওয়া, অক্সিজেন স্বল্পতাসহ নানারকম বিপদের মধ্যেও মনোবল চাঙ্গা রেখে এগোতে হয়েছে একটু একটু করে। প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চয়তা এবং বিপদের ঝুঁকি। এমন বিরূপ পরিবেশেও সবসময় আমাদের মনোবল চাঙ্গা ছিল। আমি মনে করি, এই মনোবলটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মনোবল ঠিক থাকলে সব সম্ভব।
পর্বত অভিযানে দলীয় সমঝোতা ও বোঝাপড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে-কোনো অভিযানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টিম স্পিরিট অর্থাৎ দলের মধ্যকার সমন্বয়, সৌহার্দ্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক, সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রত্যেকের শারীরিক-মানসিক সক্ষমতা। একেবারে ছোটবেলা থেকেই ননীর পুতুলের মতো নয়, বরং অনেক দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা, গাছে চড়া, সাঁতার কাটাসহ রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বড় হয়েছি। এর পাশাপাশি বড় হয়ে পরিকল্পিতভাবে ব্যায়াম করেও ফিটনেস বাড়িয়েছি, যেন যে-কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারি।
মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যখন কোনো কঠিন কাজ উপভোগ করা যায়, তখন সেটা সহজ মনে হয়। এজন্যে কাজের প্রতি প্যাশন থাকতে হবে। যার যে কাজ, সেটা যদি সে সততার সঙ্গে পালন করে তা-ই দেশপ্রেম। আমি পর্বতারোহী। পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় গিয়ে আমি দেশের পতাকা উড়িয়েছি। নিজের জায়গা থেকে কাজের মাধ্যমে দেশের পতাকার সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে জনাব ইনাম আল হক বলেন, কোনো মানুষকে অন্য কারো উদাহরণ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা যায় না। আমরা যখন অন্য একজনকে ছাড়িয়ে যেতে চাই, তার ফল কখনো ভালো হয় না। কারণ ছাড়িয়ে যেতে না পারলে কষ্ট লাগে আর ছাড়িয়ে গেলে পরে আর কোনো লক্ষ্য থাকে না। তাই প্রত্যেক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত নিজের সাথে। গতকালের চেয়ে আজকের আমি আরেকটু ভালো হবো—এটাই হওয়া উচিত সঠিক প্রত্যয়।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠান শেষে অংশগ্রহণকারীরা বিশেষ মূল্যছাড়ে সংগ্রহ করেন ইনাম আল হক রচিত বই ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’। তাতে লেখকের অটোগ্রাফ নেয়ারও সুযোগ পান তারা। গত কয়েক দশক ধরে বিচিত্র প্রজাতির পাখি বিষয়ে গবেষণা ও গবেষণাকালীন ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত হয়েছে এ বই। ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত মেহের কবীর বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে বইটি।
ইনাম আল হক :
পাখি-বিশারদ, আলোকচিত্রী, প্রকৃতিবিষয়ক লেখক, দুঃসাহসিক অভিযাত্রী ইত্যাদি নানা পরিচয় তার সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়ে থাকলেও সব ছাপিয়ে ইনাম আল হক একজন নিসর্গপ্রেমী মানুষ। জীবনপাত্র উছলে-পড়া কৌতূহল তার। ৭৮ বছর বয়সেও এই তরুণ অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন অনুজ অভিযাত্রীদের এবং নিজেও কর্মব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রকৃতির নানা রহস্য ও সৌন্দর্যের খোঁজে।
২০০০ সাল থেকে তিনি জলচর পাখি শুমারি কার্যক্রমের জাতীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। সারা পৃথিবীতেই পাখিপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হলো পাখির ফিল্ডগাইড। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম পাখির ফিল্ডগাইড রচনা করেন ইনাম আল হক। এ-ছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ৭০০ প্রজাতির পাখির প্রমিত বাংলা নামের তালিকা প্রস্তুত করেছেন, যা জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। ‘বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ’-এর ২৬ তম খণ্ডে তিনি বাংলাদেশের ৬৫০ প্রজাতির পাখির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরেছেন। যারা জীবনকে ভালবাসেন তাদের জন্যে ইনাম আল হকের লেখা ‘পাখিদেরও আছে নাকি মন’ বইটি অবশ্যপাঠ্য।
ইনাম আল হক বাংলাদেশ সরকারের ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তিনি এই ট্রাস্টের সহ-সভাপতি। তিনি একজন দুঃসাহসিক অভিযাত্রীও বটে, যিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অ্যান্টার্কটিকা ও সুমেরু ভ্রমণ করেছেন।
নিভৃতচারী এই মানুষটির সবচেয়ে বড় অবদান হলো, প্রচারের অলক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃতির প্রতি উৎসাহিত করে তুলতে। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’ ও ‘বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব’।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের মাধ্যমে এদেশে পাখি পর্যবেক্ষণ, গবেষণা ও সংরক্ষণের বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। আর বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কারণ স্পষ্ট হবে তার সাম্প্রতিক একটি লেখা থেকে—
‘আমার মনে হয়, চ্যালেঞ্জ না থাকলে মানুষের জীবন চলে ঠিকই; তবে চলে গড়িয়ে গড়িয়ে। গড্ডালিকার জীবনে উদ্দীপনার বিরাট ঘাটতি থাকে। থিতিয়ে পড়া জীবনকে নাড়া দিতে মাঝে মাঝে তাই চ্যালেঞ্জ চাই। কারণে-অকারণে এমন কিছু করা চাই, যা করা প্রায় অসম্ভব। অন্তহীন সমুদ্র, চির-তুষারের মেরু, উত্তূঙ্গ পর্বত ইত্যাদি অগম্য স্থানগুলো জয় করা চাই। আটপৌরে আকাঙ্ক্ষা দিয়ে সত্যিকারের শক্তিশালী মানুষের জীবন চলে না। তাদের জীবনে চ্যালেঞ্জ চাই।’
ইনাম আল হকের এই রোমাঞ্চযজ্ঞ ইতোমধ্যেই সফলতার আলো দেখতে শুরু করেছে। এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত ও নিশাত মজুমদার এই ক্লাবেরই সদস্য।
এম এ মুহিত :
এম এ মুহিতের জন্ম ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বীপ জেলা ভোলার গঙ্গাপুর গ্রামে। পুরনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে তিনি ১৯৮৫ সালে এস.এস.সি, ১৯৮৭ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং ১৯৮৯ সালে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে বি.কম. সম্পন্ন করেন। গতানুগতিক জীবনের চেয়ে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে আশৈশব তিনি আনন্দ পেতেন। প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে বেড়াতেন তার স্বপ্ন।
১৯৯৭ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে এম এ মুহিত বন্ধুদের সাথে এক আনন্দভ্রমণে মৌলভীবাজারস্থ মাধবকুণ্ডে ২০০ ফুট উঁচু একটি ঝর্ণার চূড়ায় ওঠেন। সেখান থেকেই উচ্চতার প্রতি তার আকর্ষণ। সেবছরই সদ্য অ্যান্টার্কটিকা ফেরত অভিযাত্রী ইনাম আল হকের সঙ্গে তার পরিচয়। শ্রদ্ধেয় ইনাম আল হককে নিয়ে এম এ মুহিত বলেন, ‘তার সংস্পর্শে এসে আমার জীবন সম্পর্কে ধারণা বদলে যায়। তিনি ধৈর্য নিয়ে পাখি, প্রকৃতি, অ্যাডভেঞ্চার, ফটোগ্রাফি ছাড়াও সততা, ভদ্রতা, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার—জীবনের নানা বিষয় শিখিয়েছেন। আমি বুঝতে পারতাম, আমার মধ্যে একটা শক্তি আছে। কিন্তু কীভাবে তা কাজে লাগাতে হবে তা জানতাম না। তিনি আমার মধ্যে দেখতে পান বড় কিছু করার ক্ষমতা এবং তিনিই তা বের করে আনতে সক্ষম হন।’ সুমেরু অভিযাত্রী ইনাম আল হক তাকে দেখান এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন। মেন্টর ইনাম আল হকের পাশাপাশি তার মা আনোয়ারা বেগম এবং বোন সাংবাদিক রাবেয়া বেবি ছিলেন তার এই ব্যতিক্রমী স্বপ্ন পূরণের অনুপ্রেরণা।
২০০০ সালে একটি পর্বত অভিযানে গিয়ে এম এ মুহিত অনুভব করেন, এই কঠিন কাজটিই তিনি যেন উপভোগ করছেন। তার মতে, ‘যখন কোনো কঠিন কাজ উপভোগ করা যায়, তখন সেটা সহজ মনে হয়।’ এরপর ২০০৩ সালে ইনাম আল হকের কাছ থেকে তিনি ট্রেকিংয়ে হাতেখড়ি নেন। পর্বতারোহণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানের জন্যে চাই কঠোর অনুশীলন। ভারতের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে পর্বতারোহণে ২০০৪ সালে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং ২০০৫ সালে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এম এ মুহিত।
এভারেস্ট জয়ের আগে এ অভিযাত্রী বেশ কিছু সফল পর্বত অভিযান সম্পন্ন করেন। তন্মধ্যে ২০০৭ সালে নেপালের চুলু ওয়েস্ট, মেরা পর্বতশৃঙ্গ; ২০০৮ সালে সিংগুলি পর্বতচূড়া; ২০০৯ সালে লবুজে পর্বতচূড়া ও নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী শিখর জয় উল্লেখযোগ্য। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো বাংলাদেশি ২৬ হাজার ৯০৬ ফুট বা ৮ হাজার ২০১ মিটার পর্বতারোহীদের সম্মানজনক এলিট ক্লাবে প্রবেশ করেন। হিমালয়ের একটি চূড়ার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের নামে। তার নেতৃত্বে একটি পর্বতারোহী টিম প্রথমবারের মতো সেই চূড়াটি জয়ের গৌবর অর্জন করে।
কিন্তু তার চোখে ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন। অবশেষে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশ ও প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হাতছানি উপেক্ষা করে পাহাড়সম দুঃসাহসিকতা ও অদম্য মনোবল পুঁজি করে ২০১১ সালের ২১ মে এভারেস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। একবছরের ব্যবধানে ২০১২ সালের ১৯ মে তিনি দ্বিতীয় বার এভারেস্ট জয় করেন।
এম এ মুহিত পৃথিবীর একমাত্র বাঙালি, যিনি হিমালয়ের উত্তর ও দক্ষিণ দুদিক থেকেই এভারেস্ট জয় করেছেন এবং চার বার জয় করেছেন ৮,০০০ মিটারের চেয়ে উঁচু তিনটি পর্বতশৃঙ্গ—এভারেস্ট, বিশ্বের ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বতশৃঙ্খ চো-ইয়ো, বিশ্বের অষ্টম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মানাসলু। এটা সম্ভব হয়েছে তার দৃঢ় সংকল্প ও অদমিত স্বপ্নের কারণে।