এখন সময় এসেছে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার যেটা আসলে ক্লাসে ১ম থাকতে সহয়তা করবে না, আমাদেরকে জীবনে প্রথম হবার পথে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বনশ্রী কার্যলয়ে, নতুন ভেনুতে অনুষ্ঠিত হয়, শিক্ষার্থী মাসিক কার্যক্রম। এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন-শাফিয়া নাজরীন।
প্রতিটি মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট- তার আবেগ আছে মমতা আছে। তবে এটাকে চ্যানেলাইজড করতে হবে পজিটিভ দিকে।যাদের প্রতি যতটুকু মমতা কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত।তাদের প্রতি ঠিক ততটুকু মমতা আবেগ কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে অনুভব করতে হবে। সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের আলোচ্য বিষয় “শিক্ষার্থীর ঋণ : কার কাছে কতটুকু” অর্থাৎ শিক্ষার্থী জীবনে আমাদের কার কাছে কতটুক ঋণ রয়েছে। ঋণ শব্দটা শুনলেই মনে হয় আর্থিক ব্যাপার-স্যাপার। অনার্থিক ঋণ, মানে যে ঋণের সাথে টাকা-পয়সা জড়িত না, সেটা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। এভাবেও যে ঋণ হতে পারে অনেক সময় সেটাও বুঝি না।
ধরুন, আজকে দুপুরে যে ভাত খেয়েছি, আমরা যদি দেখি এটুকুর জন্যে, কতজনের কাছে ঋণী। জমি তৈরী শুরু করা থেকে ভাত রন্না পর্যন্ত, কী বিশাল যজ্ঞ! এক প্লেট ভাতের জন্যে। এটা শুনে এখন কারো কারো মনে হতে পারে যে, এত লম্বা প্রসেসে যে ভাতটুকু রান্না হচ্ছে, কাদের কাদের পরিশ্রমের কারণে আমি এখন ভাতটুকু খাচ্ছি-এতসব প্রতিবেলা খাওয়ার সময় মনে করতে গেলে তো ভাত গলা দিয়ে নামবে না। তবে অন্তত একবার মনে করা দরকার, উপলব্ধি করা উচিত, যাতে সবসময় শোকরগোজার থাকতে পারি।
কারণ, আমরা যে আজকে এই অবস্থায় এসেছি-এটা এমনি এমনি না, অনেকের ত্যাগে, শ্রমে, ঘামে, অবদানের ফলেই আজকের আমরা হতে পেরেছি। আমরা একটু দেখি, হাতেখড়ি থেকে শুরু করে এ যাবত আমরা কার কার কাছে কতটুকু ঋণী। এই কারা কারা-র মধ্যে পরিবারের সদস্যরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আছেন।
মা-বাবা, বড় ভাই-বোন, ছোট ভাই-বোন, প্রধানত, তারপরও বাইরের অনেকে আছেন। যখন অসুস্থ হতেন, পথ্য কে রেঁধে দিতেন? ওষুধ কে খাইয়ে দিতেন, ডাক্তারের কাছে কে নিয়ে যেতেন? মাথায় কে হাত বুলিয়ে দিতেন?
শুধু অসুস্থ হয়েই তো শেষ না, এরপর যখন মানসিকভাবেই ভেঙে পড়তেন যে অনেক দিন ক্লাস মিস হয়েছে, পরীক্ষা দিতে পারেন নি, বা সামনেই পরীক্ষা, তখন যিনি সান্ত্বনা দিতেন, সাহস দিতেন তার কাছে ঋণী। যে ক্লাসমেট ফোন করে পরীক্ষার তারিখ জানায় তার কাছে আমরা ঋণী।
যে ক্লাসমেট কঠিন পড়া বুঝিয়ে দেয় তার কাছে তো আমি ঋণী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাসের মামা আমাদেরকে গাড়িতে ছুটিয়ে নিয়ে যেতেন। পুলিশ উল্টাপাল্টাভাবে থামালে মামা বলতেন ‘মামাদের পরীক্ষা আছে।’ মানে আমাদের তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। বাসের সেই মামার কাছে কি আমরা ঋণী নই? শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে আমাদের ঋণ।
আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই বলা হতো, শিক্ষক হলেন বাবা-মায়ের মতো। অনেক শিক্ষার্থীর জীবনে তার টিচারের ভূমিকা অনেক। যে ভাই বোনের এসএসসি পরীক্ষার সময় ওর ঘরটা ছেড়ে দেয়, যাতে সে নিরিবিলিতে পড়াশোনা করতে পারে, সে ভাইয়ের কাছে তো ঋণ আছে।
যে বোন ভাইকে নিজের পড়ার টেবিল দিয়ে দেয়, সে বোনের কাছেও তো ঋণ আছে। এক শিক্ষার্থী সে পড়তো তাদের বাসার কাছাকাছি একটা সরকারি স্কুলে। কিন্তু সেখানে পড়তে মন চাইছিলো না বলে ভালো আরেকটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিলো, অনেক কমপিটিশন করে চান্সও হলো। কিন্তু আগের স্কুলের টিচাররা কোনোভাবেই তাকে টিসি দেবেন না। টিসি না দিলে নতুন স্কুলে যাওয়া হবে না, মেয়ের স্বপ্নভঙ্গ হবে এই কষ্টের কথা ভেবে মা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যান নতুন স্কুলে। স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি কেঁদেই দিয়েছিলেন। হেডস্যারকে খুব অনুরোধ করে তারপর রাজি করান।
সেদিনের মায়ের ঐ চোখের পানি ভুলে যাওয়া কি এত সহজ! একজন বলছিলেন যখন রেজাল্ট খারাপ হয়, তখন কতজনের কতরকম মন্তব্য। এমনিতেই তো তার মন খারাপ, তারপর অন্যদের এমন আচরণের সময় বাবা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। মমতা দিয়ে আগলে রাখলেন।পরে এইচএসসি ভালো হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দর ফল নিয়ে বের হলেন। তার বাবার সেদিনের সাপোর্টেই আজ এতদূর। আসলে কতজনের সাপোর্টে যে আমরা আজকে এসেছি! হয়তো মনে হতে পারে যে, বাসার গৃহকর্মী তার কাছে আবার কীসের ঋণ। কিন্তু গৃহকর্মীর কাছেও অনেক ঋণ হতে পারে। এক শিক্ষার্থীর কথা বলতে পারি, তার পরীক্ষার ফি জমা দেয়ার মতো টাকা তার বাবা-মায়ের ছিলো না। তখন সেই বাসার গৃহকর্মী তার জমানো টাকা সেই শিক্ষার্থীকে দিয়েছিলো। আর ফাউন্ডেশনের কাছে ঋণের কথা তো বলে শেষ করা যাবে না। একটু মনে করে দেখুন না, কোন প্রেক্ষাপটে, কোন পরিস্থিতিতে, কী বিধ্বস্ত অবস্থায় কোর্সে এসেছিলেন। আর আজকে কী অবস্থা! তাহলেই বুঝতে পারবেন ফাউন্ডেশনের কাছে, গুরুজীর কাছে, মা-জীর কাছে আমরা কতটা ঋণী।
আমরা এই আলোচনাকে শেষ করতে পারি টমাস মানের একটি গল্প দিয়ে- এক বৃদ্ধ সমুদ্রের বেলাভূমি দিয়ে হাঁটছেন আর কিছুক্ষণ পর পর আপন মনে বালুর ওপর ঝুঁকে কিছু একটা তুলে সমুদ্রে ছুঁড়ে মারছেন। এই দেখে এক যুবক কৌতূহলী হলো। কাছে এসে সে দেখলো বৃদ্ধ আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসা স্টারফিশগুলোর একটি/দুটিকে এভাবে বালি থেকে তুলে সমুদ্রে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। দেখে সে বিস্মিত হলো। বৃদ্ধের বোকামি দেখে মজাও পেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘সমুদ্রের একেকটা ঢেউয়ের সাথে লাখ লাখ স্টারফিশ ভেসে এসে বালিতে আটকে যায়।
কিন্তু আপনি তো এভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের কয়েকটি মাত্র বাঁচাতে পারেন। বাকিদের কী হবে?’ শুনে বৃদ্ধ বললেন, ‘দেখ, সবাইকে আমি বাঁচাতে পারবো না। আমার সাধ্য এটুকুই। কিন্তু তারপরও যে কয়টিকে আমি বাঁচাতে পেরেছি তাদের কাছে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার সাহায্যটুকুই তার জীবন বাঁচাতে পারছে। অতএব এটুকুর গুরুত্ব অনেক বেশি।’’ অর্থাৎ পৃথিবীর সব লোকের সব সমস্যা সমাধান করার সাধ্য হয়তো আমাদের নেই। তারপরও যতটুকু সাধ্য আছে তা নিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে মানবতার কল্যাণে। তাহলেই সে ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক হবে। সরাসরি যদি শোধ করা যায়, সে সুযোগ অবশ্যই নিতে হবে। বাস্তবে করতে না পারলেও তাদের জন্যে তো দোয়া, প্রার্থনা করতে পারি। ঋণ নিয়ে মারা যাওয়া যাবে না।
এজন্যে যখন আমরা কিছু করার অবস্থায় পৌঁছাই তখন যেন এমন কিছু না করি যা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে। এমন কিছু যেন করি যা মানুষকে উপকৃত করে। মানুষের দোয়া নিয়ে আসে। যে যাদের যাদের কাছ থেকে যতটুকু নিয়ে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছি, দাঁড়ানোর পর যেন তারচেয়েও বেশি মানুষকে বহুগুণে দিয়ে যেতে পারি, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময় যেন বলতে পারি আর এতটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই।