যখন আমি প্রথম কোয়ান্টামে আসি, তখন বাংলা ভাষা বলা তো দূরের কথা বুঝতেও পারতাম না। কিন্তু সে-সময়ে যারা আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন, তারা খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের আপন করে নিয়েছেন। কিছুদিনের মধ্যে বাংলা ভাষায় লিখতে, পড়তে এবং সাবলীলভাবে কথা বলতে পেরেছিলাম। যত সময় যেতে লাগল আমার কাছে কোয়ান্টাম তত আপন হতে লাগল। একসময় মনে হতে লাগল—কোয়ান্টাম আমার নিজের পরিবার। আর কোয়ান্টামম আমার নিজের বাড়ি। কোয়ান্টামমের স্থাপনার বিশেষত্ব হচ্ছে—বেশিরভাগ ছাদের টিনের রং লাল।
দূর থেকে কোয়ান্টামমের লাল টিনগুলো যখন চোখে পড়ে, তখনই আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। মনে হয়—এই তো আমি আমার বাড়িতে চলে এসেছি। এভাবে আমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে পিইসি পরীক্ষায় ৪.৬৭, জেএসসি—তে ৫.০০ নিয়ে, এসএসসি পরীক্ষায় ৪.৭২ এবং এইচএসসি—তে ৫.০০ নিয়ে উত্তীর্ণ হলাম।
আমি শুধু লেখাপড়ায় নয় খেলাধুলাতেও নিজেকে বেশ এগিয়ে নিয়েছিলাম। টেবিল টেনিসে স্কুল ন্যাশনাল খেলায় আমি এবং আমার আপন চাচাতো ভাই রামহিম বম—দুজনে মিলে টানা চার বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। আর আমাদের সাফল্য দেখে আমাদের ছোট ভাইয়েরা এই সাফল্য এখনো ধরে রেখেছে। কোয়ান্টাম কসমো স্কুল আমাদের সুশৃঙ্খল জীবনের মধ্যে রেখেছিল। সেখানে আমাদের শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক ফিটনেসকে সুগঠিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই আমার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। কিন্তু এসব কিছু আমাদের সফলতাকে থামিয়ে রাখতে পারে নি। কোয়ান্টামে কাটানো প্রতিটি বছর আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রথমদিকে কোয়ান্টামে খেলার মতো কোনো ভালো মাঠ ছিল না, ছিল না ভালো ক্লাস রুম। ধীরে ধীরে সব গড়ে উঠল। আজ কোয়ান্টারা ভালো ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বুয়েট, চুয়েট এবং বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে। এ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে কঠিন পরিশ্রম আর বিশ্বাসে। আমাদের সিনিয়ররা যখন কলেজ পাশ করে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাচ্ছিল, তখন থেকে আমার স্বপ্ন ছিল যে, আমিও পারব।
তাই আমি যত উপরের ক্লাসে উঠতে লাগলাম তত বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। অবশেষে আমি কঠিন পরিশ্রম ও বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি।
আজও আমি খুব মিস করি সেই জীবনটা। প্রতি বৃহস্পতিবার রাত জেগে থেকে বন্ধুরা মিলে বসে গল্প করা, গান করা, হাসি-মজা করা। এই স্কুলের স্যারেরা আসলে এত আন্তরিক যে, তারা প্রতিটি কোয়ান্টাকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখেন, উৎসাহিত করেন, যা আমাদের সাফল্যের পথে অন্যতম কারক। কয়েকজন স্যারের নাম উল্লেখ না করে পারছি না, তারা হলেন—ছালেহ আহমেদ স্যার, মাহফুজ স্যার, ইমতিয়াজ স্যার, কলেজের আসাদ স্যার, জাহিদ স্যার এবং খ্রিষ্টফার স্যার।
তাদের মধ্যে জাহিদ স্যার এবং খ্রিষ্টফার স্যার আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার। খেলাধুলার জগতে জাহিদ স্যারের হাত ধরেই আমি প্রথম সফলতা পেয়েছিলাম। তার কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে ধৈর্যধারণ করতে হয় এবং মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।
খ্রিষ্টফার স্যার, যাকে আমি নিজের বাবার মতো সম্মান করি, তিনি আমার সাফল্যের পথে একজন সক্রিয় যোদ্ধা। তার প্রতি আমার হৃদয়ের গভীর থেকে সবসময়ের জন্যে ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা। স্যারেরা আমাদের সব চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও তাদের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না।
সবারই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকে, আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম না। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে নিজের পরিবারের পাশে, নিজের আত্মীয়দের পাশে এবং সমাজ ও দেশের পাশে দাঁড়াতে চাই।
আমার ইচ্ছা আছে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত, পথভ্রষ্ট তরুণ-তরুণীদের জন্যে কিছু করার। তাদেরকে আমি এই গাইডলাইন দিতে চাই যে, কীভাবে প্রতিবন্ধকতাকে এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। না বোঝার কারণে অনেক উদীয়মান তরুণ-তরুণীর উজ্জ্বল জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই আমার এলাকায় আমার মতো আরো অনেকে জেগে উঠুক, তারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করুক। তাদের চেষ্টা যখন বাস্তবে রূপ নেবে, সমাজের জন্যে তখন তা আশীর্বাদ বয়ে আনবে।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]