শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে দূরত্ব একটি জটিল সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যা শিক্ষার গুণগত মান ও সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা যদি দেখি যে, এখন যে সমস্যাগুলো উঠে আসছে যেমন, একটা হচ্ছে শিক্ষক এবং ছাত্রের দূরত্ব। শিক্ষকের সাথে ছাত্রদের একটা দূরত্ব, একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ। মানে এটাকে বলা যেতে পারে মূল সমস্যা। ছাত্র শিক্ষকের সাথে কমিনিকেট করতে পারছেন না অথবা ছাত্রের ভাষা শিক্ষক বোঝেন না, শিক্ষকের ভাষা ছাত্র বোঝে না।
যেভাবে তৈরি হলো এই দূরত্ব:
এবং মজা যেটা হচ্ছে, এনালাইসিসটা এভাবে হয়েছে যে- কয়েক দশক ধরে শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল এটা ছিল মানসিক, আবেগিক বা আত্মিক। আর করোনাকালের পর থেকে অনলাইনের ক্লাসের দৌরাত্ম্যে শারীরিক দূরত্ব এখন দৃশ্যমান। অর্থাৎ আগে তো তবুও কাছাকাছি দেখাদেখি ছিল। এখন দেখাদেখির মানুষটা নাই। মাঝখানে দুই বছর দেখাদেখির কোনো মানুষ ছিল না। সবটাই ভার্চুয়াল। শিক্ষকও ছাত্রকে সরাসরি দেখছেন না এবং ছাত্রও শিক্ষককে সরাসরি দেখছে না। এবং তারপরে এখন অনলাইনে আবার ক্লাস, বিভিন্ন কোর্স আছে। তো অনলাইন কোর্সের ফলে যেটা হয়েছে শিক্ষক এবং ছাত্রের সম্পর্কটা হচ্ছে ভার্চুয়াল এবং টাকার। যখনই অনলাইন হয়েছে ভার্চুয়াল হচ্ছে কে কার শিক্ষক এটা অবান্তর।
অনলাইন ক্লাস ও সরাসরি ক্লাসের পার্থক্য কী? ক্লাসগুলো সরাসরি যখন হয় তখন শিক্ষকের যে ব্যক্তিত্ব পারসোনালিটি এটা শিক্ষার্থীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এবং শিক্ষকের কাছাকাছি একজন ছাত্র যদি উদ্যোগী হয় তো শিক্ষকের কাছাকাছি সে যেতে পারে। এবং শিক্ষক যদি উদ্যোগী হন ছাত্রের কাছাকাছি যেতে পারে।
অনেক সময় অনেক ভাষা লাগে না। কাছে গিয়ে কাঁধে একটু হাত রাখা মাথায় একটু হাত রাখা একটু স্পর্শ এটাই কিন্তু অনেককিছু কমিউনিকেট করে দেয়। অনেককিছু অনেক যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয় অনেক আবেগকে হালকা করে দেয় এবং অনেক আবেগ বেরিয়ে আসে।
তো করোনাকালের এটা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এবং বাস্তব ক্লাস শুরু হয়েছে তখনও যেটা আমরা একটু আগে বললাম যে শিক্ষক এবং ছাত্র দূরত্বের যে প্রধান কারণ যে একজন আরেকজনের ভাষা না বোঝা।
একজন ভালো শিক্ষকের ভূমিকা যা হওয়া উচিৎ!
আসলে ভালো শিক্ষকরা কখনো ছাত্রের ওপরে চাপিয়ে দেন নাই। ভালো শিক্ষকরা ছাত্রের মধ্যে কৌতূহলটা জাগিয়ে দিয়েছেন। আগ্রহটা সৃষ্টি করেছেন। এই আগ্রহ এই কৌতূহলটা তাকে যাতে উদ্যমী করে উদ্যোক্তার ভূমিকা সে নেয় সে যাতে উদ্যোগী হয় উদ্যমী হয় এটুকু করেছেন। বাকি কিন্তু শিক্ষার্থী নিজেই করেছে। তো এখন আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে, আমরা এই জায়গায় বোধহয় পিছিয়ে পড়ছি। অর্থাৎ ছাত্রের মধ্যে সাবজেক্ট সম্পর্কে বা শিক্ষক সম্পর্কে মানে তার কোনো কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে না। না শিক্ষক সম্পর্কে না বিষয় সম্পর্কে।
কবি কাদের নওয়াজের একটা বহুল পঠিত কবিতায়, বাদশাহ আলমগীরের এক উদারনৈতিক মনোভঙ্গির বর্ণনা আছে। যেখানে তাঁর সন্তান ওস্তাদের অজু করার সময় শুধু পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে, হাত দিয়ে পা ধুয়ে দিচ্ছে না- দেখে তাঁকে তিরস্কার করেন সম্রাট পিতা। এমন আকাশছোঁয়া মর্যাদা একসময় সমাজে শিক্ষকদের সত্যিই ছিল। আজ আর নেই। হাতে গোনা দু-চারজন শিক্ষক ব্যক্তিগত সাধনা, পাঠদান, নীতি-আদর্শের কারণে অবশ্যই সর্বজনশ্রদ্ধেয়। কিন্তু অধিকাংশই তা হারিয়ে ফেলেছেন। সেজন্য বহু কারণ দায়ী।
এই জায়গায় আমার মনে হয়, আমাদের কাজ করার অনেককিছু আছে যে, কীভাবে আসলে তার মধ্যে কৌতূহলটা জাগানো যায় পাঠদানের বিষয় নিয়ে বা জীবন সম্পর্কে জগৎ সম্পর্কে সাবজেক্ট সম্পর্কে। সাবজেক্ট যে-কোনোকিছু হতে পারে। সেটা অ্যারো ডায়নামিক সেটা ফিজিক্স হতে পারে সেটা সাহিত্য হতে পারে।
কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের ছোট্ট চিঠি : বদলে গেল ক্লাস এইটে পড়া সৈয়দ মুজতবা আলীর লক্ষ্য!
যেরকম ধরুন সৈয়দ মুজতবা আলী সিলেটের মানুষ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যখন সিলেটে গিয়েছিলেন তো সেখানে কবিগুরুর আলোচনা শুনে সে মুগ্ধ হলো। তখন সৈয়দ মুজতবা আলী সম্ভবত সেভেন বা এইটের ছাত্র। এবং সেই সময় চিঠি লিখল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ তো ট্যুরে আছেন। ট্যুরে থাকা অবস্থায় তিনি সেই চিঠি পেলেন নোয়াখালীতে। ওখান থেকে বসে তিনি আবার জবাব লিখছেন। সেটা আবার মুজতবা আলীর হাতে গিয়ে পড়ল।
তখনকার দিনে তো ইনভেলাপ এখনকার মতো মানে টিপে দিলাম আর মেসেজ চলে গেল সেটা তো ছিল না। ইনভেলাপ গিয়ে পৌঁছল এবং মুজতবা আলীর জীবন চেঞ্জ হয়ে গেল। মুজতবা আলী যে সময় পড়াশোনা করছেন।
সে সময় সিলেটে যারা পড়াশোনা করত তাদের লক্ষ্য একটাই ছিল আমলা হওয়া। তো সৈয়দ মুজতবা আলী কবিগুরুর চিঠি পেয়ে তার জীবন চেঞ্জ। সে বলে যে শান্তি নিকেতনে সে পড়বে। সে লক্ষ্য ঠিক করে ফেলল।
ছোট্ট চিঠি কিন্তু লক্ষ্য ঠিক করে ফেললেন, তিনি যে শান্তি নিকেতনে পড়বেন। এবং শান্তি নিকেতনের একমাত্র প্রথম মুসলমান ছাত্র হচ্ছেন সৈয়দ মুজতবা আলী এবং আমরা একজন অসাধারণ রসোগ্য সাহিত্যিক পেলাম সৈয়দ মুজতবা আলী।
আমেরিকার ওয়েস্টার্ন কানেক্টিকাট স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক মনোজ মিশ্র হ্যালোকে বলেন, “সাধারণত উন্নত দেশ সমূহে ছাত্ররা শিক্ষককে একক বা সংঘবদ্ধভাবে অপমান করছে বা কেউ একজন শিক্ষককে মেরে ফেলছে এমন দেখা যায় না। ইদানিং বাংলাদেশে যা হচ্ছে তার অন্যতম কারণ পারিবারিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষাকে রাজনীতিকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও আইনের প্রয়োগ না থাকা।”
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. ফারাহ দীবার কাছে জানতে চাইলে তিনি হ্যালোকে বলেন, “আজকের শিশু পরিণত বয়সে কেমন মানুষ হবে, বড় হয়ে নিজের বা সমাজে অন্যদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে তা নির্ভর করে শৈশবে অর্জিত শিক্ষার উপর।”
গুরুজী শহিদ আল বোখারি শিক্ষক ওয়ার্কশপে বলেন ছাত্রদেরকে কেন মেডিটেশন ও টোটাল ফিটনেস প্রোগ্রামের কথা বলবেন?
তো আসলে এই যে কৌতূহল সৃষ্টি করা, এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে, তার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা, আগ্রহ সৃষ্টি করা। এবং এই আগ্রহ সৃষ্টির জন্যেই হচ্ছে মেডিটেশন।
আমাদের টোটাল ফিটনেস প্রোগ্রামের লক্ষ্য কিন্তু এটাই যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যাতে ভাবতে শেখে চিন্তা করতে শেখে এবং স্বপ্ন দেখতে শেখে। যদি সে ভাবতে পারে চিন্তা করতে পারে তাকে যদি স্বপ্ন দেয়া যায় তখন তার মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হবে। তার মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হবে, তার মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে, তার মধ্যে নিজেকে বড় করার যে প্রয়োজনীয়তা এটা সে অনুভব করবে এবং সে অনুভব করবে যে জীবনের আসলে প্রয়োজনটা কী, জীবন আসলে কী জন্যে এবং জীবনে তার করণীয় কী!
এই দূরত্বের কারণ ও প্রতিকার নিচে বিশ্লেষণ করা হলো:
কারণসমূহ:
১.প্রজন্মগত ব্যবধান (Generation Gap):শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে বয়স, চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের পার্থক্য থাকায় সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়।
২.অনুপযুক্ত যোগাযোগ:শিক্ষকরা যদি খুব কঠোর বা একপেশে যোগাযোগ রাখেন, অথবা ছাত্ররা যদি শিক্ষককে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে ভয় পায়, তাহলে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
৩.শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ:অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক শুধু পাঠদান ও ফি-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
৪.প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার:ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্মের কারণে সরাসরি যোগাযোগ কমে গিয়ে সম্পর্কে শীতলতা আসে।
৫.মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব:শিক্ষক কর্তৃত্বপরায়ণ বা ছাত্র অসহযোগী হলে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস কমে যায়।
৬.সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য: ভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমি বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কারণে মেলবন্ধন কম হতে পারে।
প্রতিকার:
১.মুক্ত ও সৌহার্দ্যপূর্ণ যোগাযোগ:শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা এবং তাদের মতামত শোনা। ক্লাসের বাইরেও আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে হবে।
২.ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলা:মেন্টর-মেন্টি প্রোগ্রাম, গ্রুপ ডিসকাশন বা এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায়।
৩.প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার: ভার্চুয়াল ক্লাসের পাশাপাশি সরাসরি ইন্টারঅ্যাকশন বা ইনফরমাল চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমে সম্পর্ক জোরদার করা।
৪.শিক্ষকের প্রশিক্ষণ:শিক্ষকদের জন্য সফট স্কিলস (যেমন: ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, কমিউনিকেশন স্কিল) প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন।
৫.ছাত্রদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি:ক্লাসে ইন্টারঅ্যাক্টিভ লার্নিং, প্রেজেন্টেশন বা ডিবেটের মাধ্যমে ছাত্রদের সম্পৃক্ত করা।
৬.শিক্ষার পরিবেশ সুন্দর করা: শ্রেণিকক্ষে আনন্দদায়ক ও সহযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে ক্রিয়েটিভ টিচিং মেথড (যেমন: স্টোরি টেলিং, রোল প্লে) প্রয়োগ করা।
৭.পারিবারিক ও সামাজিক সম্পৃক্ততা:অভিভাবক-শিক্ষক মিটিং বা কমিউনিটি ইভেন্টের মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নতি সম্ভব।
৮.মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা:প্রয়োজনে কাউন্সেলিং সেশনের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানো।
উপসংহার:
শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক শিক্ষার ভিত্তি। এই দূরত্ব কমানোর জন্য উভয় পক্ষেরই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিক্ষককে যেমন সহানুভূতিশীল হতে হবে, তেমনি ছাত্রদেরও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা বজায় রাখতে হবে।
তথ্য সূত্রঃ [শিক্ষক ওয়ার্কশপ, ২৬ মে, ২০২৩] ও গুগল।
