শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা আর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে সেই খবর কি আমরা রাখি? আমরা শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গঠন নিয়ে চিন্তিত, চিন্তিত শিশুদের সুস্থ বিনোদনের চর্চা নিয়ে। অথচ বই পড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আমরা যে প্রজন্মটি বেড়ে উঠেছিলাম, সেই প্রজন্মটি বই পড়া ভুলতে বসেছি প্রায়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন আনাতোল ফ্রাঁসের কথা। আনাতোল ফ্রাঁস বলেছিলেন, ‘মনের চোখ বাড়ানো-কমানো তো সম্পূর্ণ আমার হাতে। নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই এক-একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।’ অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টি বাড়াবার পন্থা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন বই পড়ার কথা।
যে বয়সে শিশু–কিশোরেরা মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়ায়, সেই বয়সে আরবের রিতাজ আলহাজমি নামের একটি কিশোরী মাত্র ১২ বছর বয়সেই দুটি বেস্টসেলার উপন্যাস লিখে গিনেস ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডসে নাম লিখিয়েছে ২০২১ সালে। রিতাজ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী বেস্টসেলার লেখক। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হলো? ছোটবেলা থেকেই গল্প-উপন্যাস পড়তে পড়তে বড় হয়েছে রিতাজ। ছোটবেলা থেকেই তার বাবা তাকে বিভিন্ন ধরনের বই কিনে দিতেন, আর আগ্রহ নিয়ে সেসব বই পড়ে ফেলত রিতাজ। একদিন রিতাজের বাবা একটি বুকসপের বুকশেল্ফের দিকে তাকিয়ে বললেন, রিতাজ তুমি স্বপ্ন দেখো, একদিন তোমার লেখা বই এখানে থাকবে আর তাতে জ্বলজ্বল করছে তোমার নাম। স্বপ্ন পূরণে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি রিতাজকে। ট্রেজার অব দ্য লস্ট সি নামে ২০১৮ সালে প্রকাশিত রিতাজের প্রথম বইটি বেস্টসেলার হলো। তার দ্বিতীয় বেস্টসেলার বইটি পোর্টাল অব দ্য হিডেন ওয়ার্ল্ড প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। আর এখন রিতাজের একটাই স্বপ্ন, লিটরেচারে নোবেল প্রাইজ পাওয়া। ভাগ্যিস রিতাজের বাবা স্মার্ট ফোনের বদলে তার হাতে বই তুলে দিয়েছিলেন, তাকে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন!
বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করলে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পেতেও সাহায্য করে। ২০১৫ সেপ্টেম্বরে বিবিসি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়, ইরানের একটি আদালতের বিচারক কাশেম নাকিজাদেহ একজন আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করেন বই কেনা ও বই পড়ায়। বিচারকের ভাষ্য মতে নিয়মিত বই পড়া আসামীকে ধীরে ধীরে একজন ভালো মানুষে রূপান্তর করতে পারবে। কারণ সঠিকভাবে বই পড়া একজন মানুষ সহজে মন্দ কাজ করতে পারেন না। তাই একজন ভালো মানুষ হতে হলেও বই পড়তে হবে। বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্য ও সুন্দরের বার্তা, জাগ্রত হয় মমত্ববোধ, সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির ভাবনা।
পাঠ্যবইয়ের ভেতর গল্পের বই লুকিয়ে রাখা, টর্চের আলোয় রাত জেগে বুঁদ হয়ে পড়তে পড়তে মায়ের বকুনি খাওয়া কিংবা ক্লাসে শিক্ষকের চোখের আড়ালে পছন্দের বই পড়ে কানমলা খাওয়া প্রজন্ম এখনো কিন্তু অতীত নয় ! আইফোন, আইপ্যাড, ওয়াইফাই, ব্লুটুথের ভিড়ে বই পড়াটা যেন হারিয়ে না-যায়। সভ্যতার গতিময় রিলে-রেসের কাঠিটা আমরা এক যুগ থেকে আরেক যুগে কি আবলিলায় আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আর এই কাঠিটা হলো বই।
কথায় বলে, একজন বইপ্রেমী কখনো একা ঘুমোতে যান না। তার বুকের উপর একটা বই থাকে, বইয়ের ভেতরে অসংখ্য চরিত্র থাকে, আর তাতে থাকে নতুন একটি জগত। তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক বইপড়া। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ না রেখে আসুন না, প্রিয় বইয়ের পাতাটি ছুঁয়ে আগামী দিনের সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রিয় বইটি বুকে জড়িয়ে গভীর আনন্দে অবগাহন করতে করতে ঘুমিয়ে পরি, আরেকটি নতুন দিনের প্রত্যাশায়।