শুদ্ধাচার চর্চা করতে করতে আত্মিক শুদ্ধতা বাড়তে থাকে। আর এই চর্চা যেহেতু পরিবার ও সমাজের মানুষের সাথে করা হয়, তাই সামাজিক ফিটনেসের বিষয়টিও এখানে চলে আসে। আসলে মানুষ তখনই মানুষ যখন তার মধ্যে থাকে মানবিকতা, মমতা, মনুষ্যত্ববোধ। তা না হলে দানবে পরিণত হতে তার সময় লাগে না। তার মধ্যকার দানব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেও কোনো দ্বিধা করে না।
গত ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ প্রথম আলো-তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়-ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) পরিচালিত সমীক্ষা তুলে ধরে তারা বলে, ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আগামী এক-দুই দশকে এক ট্রিলিয়ন তথা এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে এই দেশে। গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি যদি ৫ শতাংশেও নামে, তাতেও ২০৪০ সালের মধ্যেই এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মাইলফলক স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। আর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হলে ২০৩০ সালেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলাদেশ হলো এক তলাবিহীন ঝুড়ি!” সেসময় বিশ্বে পরিচিত দুই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, “ভূ-গত দিক থেকে বাংলাদেশ ‘দেশ’ হতে পারে, কিন্তু এর অর্থনীতি ঠিক নেই। এবং ‘ঠিক’ হতে ২০০ বছর সময় লাগবে (যদি আদৌ ‘ঠিক’ হয়)!” ২০০ বছর লাগে নি। ৪৫ বছরেই বাংলাদেশ হয়ে গেল পৃথিবীর ৪১ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ (২০১৫ সালে)। ২০৩২ সালে আশা করা যাচ্ছে উঠে আসবে ২৪ তম অবস্থানে। স্বাধীনতার পর দেশ যখন চরম খাদ্য সংকটে, অনেকেই বললেন, এত বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের ভার দেশ বইতে পারবে না। কিন্তু দেশ পেরেছে। আয়তনে পৃথিবীর ৯৪ তম দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন দশম। ১৯৭১-এ যে দেশটি ছিল আমাদের স্বাধীনতার শত্রু, তাদের নীতিনির্ধারকরা এখন বলছেন, দেশকে ‘সুইজারল্যান্ড’ না ‘বাংলাদেশ’ বানিয়ে দিলেই তারা সন্তুষ্ট হবেন!
কিন্তু এখন এই অর্থনৈতিক শক্তির যে জাগরণ অর্থনৈতিক যে সমৃদ্ধি এটার পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন হচ্ছে নৈতিক পুনর্জাগরণ, আত্মিক পুনর্জাগরণ। যাতে এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিটা সুন্দরভাবে বণ্টিত হতে পারে এবং প্রতিটি মানুষ এখান থেকে উপকৃত হতে পারে। সেটার জন্যে আমরা নতুন করে আমাদের দেশের জন্যে স্বপ্ন দেখতে চাই। সেটা হচ্ছে-ভালো মানুষ ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ। যে আমাদের দেশটা স্বর্গের একটা টুকরা হবে। এবং সেটার জন্যে প্রাকৃতিক যা কিছু সবটাই আছে। শুধু আমাদের আত্মিক উপকরণের জাগৃতি প্রয়োজন। শুধু মমতা প্রয়োজন যে না আমরা শুধু আমার জন্যে না আমার চারপাশের মানুষের জন্যেও। বিত্তের সাথে সাথে চিত্ত ভালো মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণার উৎসভূমি যাতে আমাদের এই দেশ হয় এজন্যে আমরা সবাই দোয়া করব। সেইসাথে ধ্যান এবং জ্ঞানকে অবলম্বন করে অগ্রসর হবো। কারণ জ্ঞানকে উপলব্ধি করতে হলে ধ্যান প্রয়োজন। যে কারণে যারা আমরা কোয়ান্টাম মেথড কোর্স করেছি, আমরা কথাগুলো যে জানতাম না তা নয়, কিন্তু আমরা উপলব্ধি করলাম কোর্সে এসে। কারণ কথাগুলো আমরা শুনেছি ধ্যানের স্তরে।
এখন আমরা চাই ভালো মানুষের দেশে পরিণত হতে-এটাই এখন আমাদের নতুন মনছবি। এ এক নৈতিক, মানবিক ও আত্মিক পুনর্জাগরণের মনছবি। জরাব্যাধি বিজয়ী, নিরাপত্তা ও সুখের চারণভূমি এক দেশ। যে দেশে মানুষ একে অন্যের প্রতি হবে সমমর্মী; একের কথা কাজ বা আচরণ হবে না অন্যের ক্ষতির কারণ। মানুষ চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারবে অন্যদের। যেখানে রাত দুপুরেও একজন নারী নির্ভয়ে চলাচল করতে পারবে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যে-কোনো স্থানে অবাধ বিচরণ করবে ভয়-ভীতি আশঙ্কা ছাড়া। তাকে একাকী ছেড়ে দিয়ে অস্বস্তি বা দুশ্চিন্তায় থাকবে না তার আপনজন। এককথায় এই মনছবির দেশ হলো ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ, স্বর্গভূমি বাংলাদেশ! কেন চাই ‘ভালো মানুষ’? দেশকে স্বর্গভূমি বানানোর মূল উপকরণই হলো ‘ভালো মানুষ’। কারণ একটি দেশ ‘ভালো দেশ’ তখনই হবে যখন দেশের মানুষ ভালো হবে। মানুষ ভালো হলে এবং ভালো মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলেই ভালো দেশ গড়া সম্ভব, দেশকে রূপান্তর করা সম্ভব স্বর্গভূমিতে। আসলে কেবল প্রাচুর্যবান হলেই মানুষ সুখী হয় না, সুখী হতে হলে নৈতিক ও আত্মিক দিক থেকেও ফিট থাকতে হয়। আর একজন ‘ভালো মানুষ’ ঠিক তা-ই!
ভালো মানুষ হতে হলে নিজের দেহ মন পরিবার ও আত্মার যথাযথ যত্ন নিতে হবে। আর আত্মযত্নায়নের জন্যে জরুরি হলো মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম। সেইসাথে যত্ন নেয়ার সার্বিক দিক-নির্দেশনা সম্বলিত একটি অনন্য বই হলো শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচারের এত খুঁটিনাটি বিষয় এ বইতে আছে, যা অন্য কোনো বইতে আছে বলে আমাদের জানা নেই। একজন শুদ্ধাচারী মানুষই প্রকৃত অর্থে ভালো মানুষ। আর শুদ্ধাচারী হতে হলে প্রয়োজন প্রাত্যহিক জীবনে শুদ্ধাচারের অনুশীলন। ‘শুদ্ধাচার’ বইয়ের পাতায় পাতায় আছে শুদ্ধাচারী জীবনের মেসেজ। বইটি যত পড়বেন ও এর শিক্ষাকে জীবনে প্রতিফলিত করবেন তত আপনি হবেন শুদ্ধাচারী, ভালো মানুষ!
তাই নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ অবশ্যই পড়ুন, জানুন, বুঝুন। পাশাপাশি প্রতিদিনের জীবনে ভালো মানুষ হওয়ার দিক-নির্দেশনা লাভের জন্যে শুদ্ধাচার বইটি নিজে পড়ুন। মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। চর্চায় চর্চায় বাড়বে মানবিকতা। ‘ভালো মানুষ ভালো দেশ স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’-জাতিগত এই মনছবি পূরণের পথেও আমরা এগিয়ে যাব দ্রুতলয়ে।