জে ফগের আরেক ছাত্র ট্রিস্টান হ্যারিস। গুগলের প্রাক্তন প্রডাক্ট ম্যানেজার। ট্রিস্টান হ্যারিস অবশ্য নির ইয়ালের মতো শোষকের শোষণ প্রক্রিয়ার পুরো সহযোগী হয়ে যান নি। স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে তিনিও পড়েছেন। বিজে ফগের পারসুয়েসিভ টেকনোলজি ডিজাইন ক্লাসে তিনিও অংশ নিয়েছেন। মাস্টার্সে থাকতে থাকতেই গড়ে তোলেন নিজের একটি সফটওয়ার কোম্পানি। কিন্তু বছর চারেক পর বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান গুগল তাকে নিয়ে নেয়, দায়িত্ব দেয় প্রডাক্ট ম্যানেজারের। জিমেইলের যে ইনবক্স ডিজাইনটি এখন আমরা দেখি, তা হ্যারিসেরই করা।
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হ্যারিস হাঁপিয়ে উঠলেন। মনে হলো, এ কি করছেন তিনি! সেই গুটিকয় প্রযুক্তিবিদেরই তো একজনে পরিণত হয়েছেন তিনি, যাদের করা ডিজাইনগুলোই আজ ঠিক করছে, পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ কীভাবে সময় কাটাবে!
হ্যারিস ভেবে দেখলেন, এভাবে তো চলতে পারে না। একটা কিছু বিহিত করা দরকার! এরপর রাতদিন খেটে তিনি লিখলেন ১৪৪ পৃষ্ঠার এক বিশাল প্রেজেন্টেশন- ‘A call to minimize distraction and respect user’s attention by a concerned Product Manager & Entrepreneur’. তার এই প্রেজেন্টেশনটির মূল বিষয় ছিল, প্রযুক্তির নামে বিক্ষিপ্ততা সৃষ্টিকারী অ্যাপ এবং মেইল ডিজাইনগুলো যে আসলে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য, হৃদ্যতা- এসবকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, বারটা বাজাচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চাদের মনোযোগ ক্ষমতার- সেই বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
রিপোর্টটি গুগলের ভেতরে বেশ আলোচনা-পর্যালোচনার জন্ম দেয়। এমনকি ল্যারি পেজ, গুগলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, তিনিও বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন এটার ব্যাপারে। যদিও শেষ পর্যন্ত, কাজের কাজ কিছুই হয় নি। হ্যারিসের এই সচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা গুগলের ভেতরে কোনো সফলতারই মুখ দেখে নি।
তিন বছর কাজ করার পর গুগল ছেড়ে দেন হ্যারিস। এখন তার প্রধান কাজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে পণ্য নির্মাণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে, সেই বিষয়ে জনমত সৃষ্টি এবং শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্যে নয়, মানুষের কল্যাণচিন্তাকেও যাতে তারা গুরুত্ব দেয়, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বোঝানো।
ট্রিস্টান হ্যারিস বলেন, “স্মার্টফোন আর জুয়ার মেশিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই মানুষকে এক ধরনের আশা-নিরাশার দোলাচোলে রাখে। একজন মানুষ যখন জুয়ার মেশিনের হাতল ঘোরায়, তখন কিন্তু সে জানে না যে, তার জন্যে কী অপেক্ষা করছে! হতে পারে সবচেয়ে বড় পুরস্কারটা সে পাবে, হতে পারে সে কিছুই পেল না। আর দুরু দুরু বক্ষের এই অনিশ্চয়তার জন্যেই জুয়া মানুষের কাছে এত জনপ্রিয়! স্মার্টফোনও তাই। নোটিফিকিশেন আইকনটা যখন সে দেখছে, তখনও কিন্তু সে জানে না, এটা খুললে সে কী দেখতে পাবে। নতুন কোনো মেইল তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারে, নতুন লাইক পড়তে পারে, অথবা একেবারে কিছুই না দেখতে পারে। আর সেজন্যেই স্মার্টফোনকে ঘিরে আমাদের এত আসক্তি!
ট্রিস্টান হ্যারিস সেই গুটিকয় প্রযুক্তিবিদের একজন, যিনি প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন যে, আমাদের স্মার্টফোনের প্রোগ্রামিং করছে যে কোম্পানিগুলো, তারা তাদের সমস্ত শ্রম, মেধা, মনোযোগ ঢেলে দিচ্ছে শুধুমাত্র এটা নিশ্চিত করার জন্যে যে আমরা এ ফোনটাতে আসক্ত হয়ে থাকব।