রোগমুক্ত ও সার্বিকভাবে ভালো থাকার জন্যে কী কী করতে পারি?
সুস্বাস্থ্যের জন্যে যত্নায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেহ-অভ্যন্তরে নানাভাবে সৃষ্ট টক্সিন বা বিষাণুকে আমরা যথাযথ যত্ন নেয়ার মাধ্যমে বের করে দিতে পারি। যত সুন্দর ও কার্যকরভাবে শরীর থেকে আমরা এসব টক্সিন বের করে দিতে পারব তত আমাদের সুস্থ থাকার পরিমাণ ও সামর্থ্য বেড়ে যাবে।
যত্নায়নের পাঁচটি ধাপের প্রথমটি হচ্ছে দম। আমরা সঠিকভাবে দম নেয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে দেহকে অক্সিজেনসমৃদ্ধ এবং ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে মুক্ত করতে পারি। তাই দম যত সঠিক হবে তত আমাদের এনার্জি লেভেল বাড়তে থাকবে। ফলে সারাদিন পরিশ্রম করেও দেহ থাকবে ক্লান্তিহীন ও কর্মক্ষম, মুক্ত থাকতে পারবেন অনেক রোগ থেকে।
দ্বিতীয় ধাপে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই খাবারের মধ্য দিয়ে যাতে দেহে টক্সিন প্রবেশ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সবসময় যথাসম্ভব রাসায়নিকমুক্ত তাজা প্রাকৃতিক খাবার খেতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে যে, স্বাস্থ্যের জন্যে যা ভালো সেটাই খাব। টক্সিনযুক্ত খাবার ও পানীয়, যেমন এলকোহল, সফট ড্রিংকস, এনার্জি ড্রিংকস, ধূমপান অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
তৃতীয় ধাপ হলো ব্যায়াম। কোয়ান্টাম ব্যায়াম শরীরের হরমোনাল, বায়ো-ইলেক্ট্রিক্যাল, নার্ভাস সিস্টেম থেকে শুরু করে দেহের সব সিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই প্রতিদিন ২০/২৫ মিনিট ব্যায়াম করা এবং হাঁটা অত্যন্ত জরুরি। এতে ঘামরূপে ত্বকের মধ্য দিয়ে টক্সিন বেরিয়ে যায়।
যত্নায়নের চতুর্থ ধাপে রয়েছে হজম। খাবার এমনভাবে খেতে হবে যাতে হজমে সুবিধা হয়। একটু ক্ষুধাভাব থাকতেই খাওয়া শেষ করলে অর্থাৎ পাকস্থলী কিছুটা ফাঁকা রাখলে এবং খাওয়ার পর আধাঘণ্টা পানি পান না করলে হজম ভালো হয়।
পঞ্চম ধাপ হলো রেচন প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে প্রস্রাব-পায়খানার সাথে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায়। শরীর থেকে নিয়মিত এসব বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে হজমে সহায়ক সহজপাচ্য খাবার খাওয়া উচিত। ভাজাপোড়া তৈলাক্ত মশলাদার খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
যত্নায়নের পাঁচটি ধাপের মাধ্যমে দেহ থেকে টক্সিন বের করে দেয়ার এ প্রক্রিয়াই হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। মানুষের দেহকে তৈরি করা হয়েছে টক্সিন বের করে দেয়ার অসাধারণ শক্তি দিয়ে। টক্সিন বের করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। নাক ও মুখ দিয়ে সর্দি কফ কাশি এবং কানে জমা ময়লা টক্সিন বের করার একটা প্রক্রিয়া। ত্বক থেকে ঘামরূপে টক্সিন বেরিয়ে যায়। মুখে অতিরিক্ত লালা জমলেও আমরা থুতু হিসেবে ফেলে দিই। রেচন প্রক্রিয়া অর্থাৎ পেশাব পায়খানার সাথে টক্সিন বেরিয়ে যায়।
টক্সিন সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু যিনি যত ভালোভাবে শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে পারে তার সুস্থ থাকার শক্তি তত বেড়ে যায়। শরীরকে ডিটক্স করার জন্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন ওজু করছেন, কী করছেন? প্রথমে হাত ধুচ্ছেন, পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করছেন, কুলি করে মুখটাকে পরিষ্কার করছেন। সমস্ত মুখমণ্ডল, হাত পা ধুচ্ছেন। কান পরিষ্কার করছেন। আবার ঘাড়ের পিছনে সাধারণত লবণ জমে। এটাও আপনি মাসেহ করে পরিষ্কার করে ফেলছেন ওজু করার সময়। এভাবে টক্সিন থেকে মুক্ত হচ্ছেন।নিয়মিত গোসল, চুল ও নখ কাটার মধ্য দিয়েও শরীরের টক্সিন দূর হয়।
রসুলুল্লাহর (স) শিক্ষার একটা বড় অংশ এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তিনি পরিচ্ছন্নতাকে বলেছেন ঈমানের অঙ্গ। যদি আপনি নিজে পরিচ্ছন্ন না থাকেন, চারপাশকে পরিচ্ছন্ন না রাখেন, তাহলে আপনার ঈমানটা রোগা দুর্বল হয়ে গেল। ঈমান বা বিশ্বাস হতে হবে সবসময় শতভাগ। ৯৯.৯৯ পার্সেন্ট হলেও হবে না। এখানে পয়েন্টের কোনো সুযোগ নেই।
অতএব সুস্থ থাকার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেহ থেকে টক্সিন বের করে দেয়া এবং টক্সিন সৃষ্টি হয় এমন কাজ বা অভ্যাস থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয়ত, ক্ষতিকর খাবার বর্জন, যেন খাবার থেকে টক্সিন ভেতরে প্রবেশ না করে। তৃতীয়ত, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকা, অপ্রয়োজনে মোবাইল ব্যবহার না করা। রাত ১১টার পরে মোবাইল একেবারে বন্ধ। মোবাইল থেকে টক্সিন আসে প্রচুর। সেইসাথে টিভি দেখার সময় কমিয়ে আনা। টিভি কতক্ষণ দেখবেন এটা আগেই ঠিক করে নেবেন। বিশেষ করে ঘুমানোর দুই ঘণ্টা আগে টিভি বন্ধ করে দেবেন। দেখবেন যে, ঘুম চমৎকার হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়েও আপনি টক্সিনমুক্ত হতে পারছেন।
টক্সিন থেকে মুক্তির জন্যে আমরা খুব সহজেই এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে পারি। আর সুস্থ থাকার জন্যে সঠিক যত্নায়নের সাথে সাথে নিরাময়ের চারটি শাশ্বত উপায় হলো ধ্যান, দোয়া, দান এবং দাওয়া। মন স্থির না হলে, মনে প্রশান্তি না এলে দেহে প্রশান্তি আসবে না, সুস্থতা আসবে না। ধ্যান বা মেডিটেশন আমাদের দেহ ও মনে এই এলকালাইন বা প্রশান্ত অবস্থা নিয়ে আসে, যা আমাদের রোগ থেকে মুক্ত রাখে। ধ্যানের পাশাপাশি নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন আন্তরিক প্রার্থনা, দোয়া বা হিলিং।
রোগ নিরাময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম দান বা সদকা। যারা নিয়মিত দান করেন তাদের জীবনে বিপদ আসে তুফানের মতো আর চলে যায় বুদবুদের মতো। কারণ সৎদানের বিনিময়ে স্রষ্টা আমাদের বিপদ থেকে মুক্ত রাখেন। তবে মনে রাখবেন, রোগ নিরাময়ে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হতে পারে সে অনুপাতে দান করা প্রয়োজন।
৭৫ ভাগ মনোদৈহিক রোগ নিরাময়ের জন্যে ধ্যান দোয়া দান—এই তিনটিই যথেষ্ট। বাকি ২৫ ভাগের জন্যে প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা ও দাওয়া বা পথ্য। নির্দিষ্ট রোগ নিরাময়ে নির্দিষ্ট পথ্য সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি প্রয়োজনে উচ্চমাত্রার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হলে এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানোর জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এতে দেহের ভেতরের টক্সিন দ্রবীভূত হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং রোগ নিরাময় হয় দ্রুততর।
সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে বিশেষ জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির। আর এজন্যে স্রষ্টা যে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়েছেন তা প্রয়োগ করাই যথেষ্ট।
