কীভাবে পেরোতে হয় স্বপ্নের সীমানা—তা জেনেছি
জিয়াবুল হক
লোক-প্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আমার বাড়ি লামার লম্বাখোলা মসজিদের পাশে। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের খুব কাছে। ২০০১ সালে কোয়ান্টাম শিশুকানন যখন শুরু হয় তখন এ অঞ্চলে একটি ছোট পাঠশালা ছিল। সেখানে তেমন কোনো পড়াশোনা হতো না বললেই চলে। আমি সেই স্কুলেই ভর্তি হয়েছিলাম শিশুকালে। কোয়ান্টামের শিক্ষকেরা আমার বাবাকে বলতেন যেন আমাকে কোয়ান্টামে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু যখন এই এলাকায় কোয়ান্টাম প্রথম এসেছিল, স্থানীয় মানুষদের মনে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ছিল। একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, এই স্কুলে পড়লে ছাত্ররা তাদের ধর্ম ভুলে যাবে। এই জন্যে আমাকে বাবা শিশুকাননের অনাবাসিক শাখায় ভর্তি করালেন। আমি বাসা থেকেই যাওয়া-আসা করতাম।
আসলে স্থানীয় ছাত্রদের জন্যে কোয়ান্টাম সর্বপ্রথমে আমাদের এই সুযোগটি দিয়েছিল, হোস্টেলে না থেকেও ছাত্ররা যেন পড়তে পারে। পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এখন পুরোপুরি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর স্থানীয় ছেলেমেয়েদের জন্যে কোয়ান্টাম একটি অনাবাসিক স্কুল (বোধিছড়া পাব্ললিক স্কুল) চালু করেছে। সেখানেও রয়েছে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ।
২০০৪ সালে আমি কোয়ান্টাম শিশুকাননে ভর্তি হই। আমি শুরুতে পায়ে হেঁটে লম্বাখোলা থেকে স্কুলে আসতাম। একটা সময় বাবা সাইকেল কিনে দিলেন। আহ! আমি কী খুশি! তখন একটি সাইকেল মানে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছি। ছোটবেলার আনন্দগুলো আসলে এমনই হয়।
কিন্তু তখন আবাসিক ও অনাবাসিক ছাত্রদের মধ্যে অনেক পার্থক্য ছিল। বিশেষভাবে আবাসিকের ছাত্রদের বই, খাতা, পোশাক, খাবার সবকিছুই ফ্রি ছিল। আবার তারা পড়ালেখার পাশাপাশি প্যারেড ও ডিসপ্লে করত। আমাকে বই ছাড়া সবকিছুই বাড়ি থেকে আনতে হতো। আমি স্কুল শেষে মাঠে চলে যেতাম আবাসিক ছাত্রদের প্যারেড ও ডিসপ্লে দেখার জন্যে। কী সুন্দর সুসজ্জিত প্রদর্শনী! এগুলো দেখে আমার ঈর্ষা হতো। মনে হতো, আমিও যদি হোস্টেলে থেকে কোয়ান্টামে পড়ালেখা করতে পারতাম!
পঞ্চম শ্রেণিতে আমাদের ভালো ও খারাপ রেজাল্টের ভিত্তিতে গ্রুপে ভাগ করা হলো। আমি শেষ গ্রুপে ছিলাম। কারণ আমি একদমই ভালো ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু একটা সুখবর শুনি যে, যারা পঞ্চম শ্রেণিতে ভালো ফলাফল করবে তাদের ষষ্ঠ শ্রেণিতে আবাসিক ছাত্র হিসেবে পড়ালেখার সুযোগ দেয়া হবে। আমি তখন ভালোমতো পড়ালেখা শুরু করি। আমার অবস্থান শেষ থেকে প্রথমে চলে আসে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্যে প্রাণান্ত চেষ্টা করি এবং তা অর্জন করি।
ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমি পুরোপুরি আবাসিক ছাত্র হয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাই। খুশিতে আমি আত্মহারা। অন্যদের মতো আমিও প্যারেড-ডিসপ্লেতে অংশ নিতে পারব। বাবা আমার খুশি দেখে আর আপত্তি করেন নি। আবাসিক ছাত্র হওয়ার পর আমার লেখাপড়া আরো ভালো হতে থাকে। আমি জেএসসি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে লামা থানায় দ্বিতীয় হলাম। এরপর থেকেই বাবা-মায়ের ধারণা হলো যে, তাদের ছেলে সবসময় ভালো রেজাল্ট করবে।
কোয়ান্টামের শিক্ষকেরা এত যত্ন নিয়ে আমাদের সবকিছুর দেখাশোনা করতেন যেন তারাই আমাদের অভিভাবক। প্রয়াত আবাসিক দায়িত্বশীল শোভন স্যারের কথা না বললেই নয়। তিনি সহজেই সকল স্তরের মানুষের মাঝে মিশে যেতে পারতেন। নিজের সুখ-দুঃখের কথা তার সাথে শেয়ার করতাম আমরা। আসলে এরকম স্যার পাওয়াটা দুর্লভ। একবার রাতে ঘুমানোর সময় এক শিশু কোয়ান্টা বিছানায় টয়লেট করে দেয়। তখন তিনি নিজেই বালতি নিয়ে পানি এনে বিছানা, কম্বল পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। তিনি সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। কোনো কোয়ান্টা কোনো ভুল করলে তাকে আলাদা করে ডেকে বোঝাতেন।
যখন কোয়ান্টাম কসমো স্কুল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বড় ভাই বীর বাহাদুর ত্রিপুরা প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল, তখন জানতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় বলতে কিছু আছে। তার আগে জানতাম স্কুলের পর শুধু কলেজ। এরপর যখন আরো কয়েকজন কোয়ান্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, তখন আমাদের বিশ্বাস দৃঢ় হতে শুরু করে যে, আমরাও পারব। কেননা তাদের আমরা সরাসরি দেখেছি।
কলেজে উঠে আমাদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি চলতে থাকে। আমার প্রস্তুতির পুরোটাই ছিল বিবিএ কেন্দ্রিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি অংশের পারফরমেন্স খারাপ হওয়াতে আমার আর ভর্তির সুযোগ হলো না। ক্ষণিকের জন্যে হতাশ হলাম। আর একসপ্তাহ পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা। হতাশা ভুলে দিনরাত প্রায় ২০ ঘণ্টা প্রস্তুতি নিলাম।
সে-সময় আমার একটাই লক্ষ্য—আমাকে পড়তে হবে এবং চান্স পেতে হবে। চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে বি এবং ডি ইউনিটে মেধাতালিকায় সুযোগ পেলাম। এই খবর মা-বাবাকে জানালাম। তারা বললেন, আমরা জানতাম তুই চান্স পাবি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তারা সে-রকম কিছুই বোঝে না। অনেকদিন পর্যন্ত এলাকার লোকজনও তেমন বুঝত না। তারা মনে করত চট্টগ্রামে কোনো একটা কলেজে হয়তো পড়ছি।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হলো আমার বিশ্বাস। আমার সাথে আমাদের এলাকার কিছু ছাত্র এই স্কুলে পড়ত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা ঝরে পড়ে। আমিও তাদের মতো হয়ে যেতে পারতাম, দোকান করতাম, গাড়ি চালাতাম, নয়তো দিনমজুর হয়ে কাজ করতাম। বড়জোর কাজ করতে বিদেশে চলে যেতাম। আমার অঞ্চলের কালচারটাই এমন। আমাদের স্বপ্নের পরিধি ছিল সীমাবদ্ধ। কোয়ান্টাম আমাকে দেখিয়েছে কীভাবে পেরোতে হয় স্বপ্নের সীমানা।
আমার মূল পরিবর্তনটা ঘটেছে আসলে কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে অংশগ্রহণ করার পর। মেডিটেশন, মনছবি ও অটোসাজেশন এই বিষয়গুলো আমি বুঝতে পারি। আগে একটা বিষয় বহুবার পড়েও মুখস্থ করতে পারতাম না। মেডিটেশনে ভিজুয়ালাইজ করার পরে খুব দ্রুত পড়া শেষ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও যেটা আমার কাজে লেগেছে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ান্টাম মেডিটেশন সোসাইটির একজন সক্রিয় কোয়ান্টিয়ার ছিলাম। তাই ক্লাসে সবাই আমাকে কোয়ান্টাম বলেই ডাকত। বিষয়টি আমার ভালোই লাগত।
আমার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জন্যে কিছু করা। একটা বড় ইচ্ছে আছে আমার—কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের মতো একটা স্কুল তৈরি করা।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]