আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে আমি সবসময় এত আশার কথা বলি, এই আশাবাদের উৎস কী? আমি এখনো বেঁচে আছি, কাজ করতে পারছি আমি বলব এটাই আমার আশাবাদের সবচেয়ে বড় উৎস। মরতে তো একদিন হবেই। কিন্তু যে কদিন আছি, বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। মৃত্যুর আগে যেন বলতে পারি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করেছি। নিষ্ক্রিয় হয়ে থেমে যাই নি। ভীরুর মতো পেছন দিকে দৌড় দেই নি। আমি সামনে গেছি এবং এগিয়ে গেছি।
আমাদের শরীরের দিকে যদি তাকাই, কী দেখব? প্রতিটা অঙ্গ কোনদিকে যাওয়ার জন্যে তৈরি? সামনে না পেছনে? আমাদের হাত-পা সব সামনের দিকে। নাক সামনের দিকে। চোখ দেখে সামনে। অর্থাৎ আমাদের সমগ্র অস্তিত্ব সামনে যাওয়ার জন্যে তৈরি। আমরা জন্মেছি সামনে যাওয়ার জন্যে। জন্মেছি আশার জন্যে। জন্মেছি ইতিবাচকতা ও কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে এবং তারপর একটা সম্মানজনক মৃত্যুর জন্যে।
গ্রিক দার্শনিক ডায়াজোনাস। সমসাময়িক তিন জন দার্শনিকের নাম উল্লেখ করে একজন তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই দার্শনিকদের মধ্যে কে সবচেয়ে বড়? ডায়াজোনাস উত্তর দিয়েছিলেন, আমাদের মৃত্যুই সেটা বলে দেবে। আমরা কে কীভাবে মৃত্যুকে উদযাপন করি, সেটা থেকেই বোঝা যাবে আমাদের মধ্যে কে বড়।
যেমন, সক্রেটিস। তার মৃত্যু যদি এমন মহান না হতো তাহলে আমার ধারণা সক্রেটিস অর্ধেক হয়ে যেতেন। অর্থাৎ যে গৌরব-গরিমায় আমরা তাকে স্মরণ করি এখনো, সেটা হতো না।
সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। তবে শর্ত দেয়া হলো যে, তুমি যদি জ্ঞানচর্চা ছেড়ে দাও তাহলে আমরা তোমাকে ক্ষমা করে দেবো। কিন্তু সক্রেটিস বললেন, আমি জ্ঞানচর্চা ছাড়তে পারব না।
কেন তিনি জ্ঞানচর্চা ছাড়তে পারলেন না?
সক্রেটিসের কথা হলো একটা অথর্ব অশ্ব বা ঘোড়া, যে চলতে চায় না, এগোতে চায় না, তাকে জোরে ছুটিয়ে দেওয়ার জন্যে আমরা কী করি? তার গায়ে একটা ডাঁশ পোকা লাগিয়ে দেই। সেই ডাঁশ যখন কামড়াতে থাকে তখন সেই ঘোড়াটা অসহ্য যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়ায়। ক্রমাগত ছুটতে থাকে।
সক্রেটিস বলছেন, আমার চিন্তা আমার জ্ঞানচর্চা এথেন্সরূপ অথর্ব অশ্বের গায়ে সে-রকমই একটি ডাঁশ পোকা। আমি যদি এই জ্ঞানচর্চা থেকে বিরত থাকি, তাহলে এথেন্স থেমে যাবে। মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই আমি আমার জ্ঞানচর্চা বন্ধ রাখতে পারব না। এর চেয়ে বরং মৃত্যুই ভালো।
মৃত্যুর মাত্র আধঘণ্টা বাকি। তখনো সক্রেটিস শিষ্যদের সাথে অমরত্ব নিয়ে আলোচনা করছিলেন। একসময় জল্লাদ এলো। হাতে হেমলক। সাধারণত যখন কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির হাতে হেমলক তুলে দেয়া হতো, তারা সেটা নিতে চাইত না। আসন্ন যন্ত্রণাদগ্ধ মৃত্যুর কথা ভেবে ওটা ফেলে দিতে চাইত। চিৎকার করত। কিন্তু সক্রেটিস অত্যন্ত সহজভাবে সেটা নিলেন।
জল্লাদ তাকে শিখিয়ে দিল এই হেমলক কীভাবে পান করতে হবে এবং বিষ শরীরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে কীভাবে আস্তে আস্তে তিনি হাঁটবেন, তারপর শুয়ে পড়বেন। একসময় একটা সাদা চাদরে মাথাসহ তার পুরো শরীর ঢেকে দেয়া হবে। অতঃপর সব শেষ!
সমবেত শিষ্যদের সামনে ঠিক ওভাবেই সবকিছু করে সক্রেটিস শুয়ে পড়লেন। সাদা চাদরে ঢেকে দেয়া হলো তাকে। হঠাৎ চাদরটা একটু সরিয়ে এক শিষ্যকে তিনি বললেন, অমুক আমার কাছে একটা মোরগের দাম পায়। একটু দিয়ে দিও।
সবাই তো আমরা মৃত্যুর কাছ থেকে পালাতে চাই। যে মানুষ ভাবে এত পুণ্য করেছি স্বর্গলাভ নিশ্চিত, সে-ও তো মরতে চায় না। কিন্তু সেই মৃত্যুকেই কী সহজে, কী অসাধারণ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে সক্রেটিস গ্রহণ করলেন! এটা দেখে তার শিষ্য প্লেটোর তো প্রায় পাগল হওয়ার দশা। কী করে একটা মানুষ এমন ভ্রুক্ষেপহীনভাবে মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে!
উচ্চায়ত দর্শনচিন্তাসহ অনেক বড় কিছু সক্রেটিসের জীবনে ছিল। অনেক মহত্তর কথা ও কাজ আমরা তার জীবন থেকে পাই। কিন্তু আমি মনে করি, তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে তার মৃত্যু। এ থেকে আমার মনে হয় যে, মৃত্যুকে আমরা কতটা মহিমান্বিত করতে পারি, সেটাই আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হওয়া উচিত। এবং এটা সম্ভব কেবল আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে। সক্রেটিস যে এটা পেরেছিলেন, তার কারণ, তিনি জানতেন যে, তার যা করার ছিল তা তিনি করেছেন। অর্থাৎ জীবনের সর্বোচ্চ ব্যবহার তিনি করেছেন।
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা তখন পাবনায় থাকি। এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ছিলেন ওখানে। ১৯৫২ সালে কোরিয়ায় পাট রপ্তানি করে তিনি হঠাৎ এক কোটি টাকা লাভ করে ফেললেন। আজকের হিসেবে ১৫০ কোটি তো হবেই কমপক্ষে। এটা শুনে পাড়ার লোকজন গিয়েছে তাকে অভিনন্দন জানাতে কেয়া মুনাফা হো গ্যায়া, কিতনা খুশি কি বাত হ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মাড়োয়ারি ভদ্রলোক সব শুনছেন কিন্তু তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর নেই। ক্রমাগত পান চিবোচ্ছেন আর বলছেন, হাঁ হইতেছে, মুনাফা হইতেছে কুছু কুছু …।
পরের বছরই ঘটল উল্টো ব্যাপার। ব্যবসায় ৮০ লক্ষ টাকা লোকসান হয়ে গেল তার। এবার সবাই গিয়ে বলছে, কিতনা লোকসান হো গ্যায়া, আফসোস কি বাত হ্যায় …। কিন্তু দেখা গেল, তিনি ঠিক আগের মতোই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পান চিবোচ্ছেন আর বলছেন, হাঁ হইতেছে, লোকসান হইতেছে কুছু কুছু …। মোদ্দা কথা, এসব কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না।
আমারও বক্তব্য হচ্ছে তা-ই। কোথায় উঠলাম আর কোথায় নামলাম সেটা কোনো ঘটনা নয়। বরং আমি আমার কাজ নিয়ে সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি কিনা, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য। উত্থান-পতন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসল কথা হলো, আমার কাজটা আমি সর্বোচ্চ চেষ্টায় করছি কিনা। সেটা যদি করি তাহলে সক্রেটিসের মতো আমরাও পারব মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করতে, মৃত্যুকে সত্যিকার অর্থে মহিমান্বিত করে তুলতে।
[৫ এপ্রিল, ২০১৯ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের বাতিঘর প্রকাশনী চত্বরে আয়োজিত ‘বিকশিত হোক শত ভাবনা’ গ্রন্থের লেখক-পাঠক আলাপন অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ]