– শেখ শাহাদাৎ হোসেন
জলজ উদ্ভিদের স্তুপে তৈরি পথটা যেন মখমলে মোড়ানো। কারণ,চলার কোন শব্দ নেই, পথের রুক্ষতা নেই; মাঝে মাঝে কিছুটা জায়গা দেবে যাচ্ছে শুধু। পথের দু’ধারে স্বচ্ছ পানি থির হয়ে আছে; ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা ধানগাছ মৃদু বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। হঠাৎ দেখি কয়েকটা পানকৌড়ি টুপ করে ডুব দিয়ে কিছু দুর গিয়ে ভেসে উঠছে; তারপর আবার আমার কাছাকাছি ফিরে আসছে। দেখে মনে পড়ল বগী প্রাইমারী স্কুলের আইয়ুব আলী ( সবাই বলত আয়েব আলী) স্যারের কথা। তিনি স্কুল ছুটির পর আমাদের বাসায় এসে তিন ভাইকে পড়াতেন। বাবা-ই তাঁকে অফিসের ঘাটে থাকা ডিঙি নৌকোয় পারাপার করতেন। তাঁর সম্পর্কে সুন্দরবনের স্মৃতিকথায় লিখব আশা করি। স্যার কিছুটা ছন্দে ছন্দে বলতেন, “ পানকৌড়ি, পানকৌড়ি/ জলে করো দৌড়োদৌড়ি/ দুইটা মাছ যদি পাও/একটা তবে আমায় দাও”। তারপর বলতেন চমৎকার কথামালা; মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম সে সব।
কাকচক্ষু পানিতে অনেক ছোট বড় মাছের সমারোহ; এ এক অন্যরকম দৃশ্য। সুন্দরবনে থাকতে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকতাম; বিশেষ করে জোয়ারের সময়। দেখা যেত, নদীর কিনারা ঘেঁষে পানির নিচ থেকে জেগে উঠছে মাছের শূঁড়। হাত বাড়িয়ে তা ধরে টান দিলেই উঠে আসত; হয় চিংড়ি, নয়তো তোপসে মাছ। এবার ডানদিকে তাকিয়ে দেখি সাদা সাদা বক উড়ছে আকাশে। কয়েকটা নেমে এসে বসছে কলমি দামের ওপর; অন্যগুলো জলাশয়ের ধার ঘেঁষে শুকনো ডাঙায়। আমার পথের পাশে মাঝে মাঝে দেখছি, কলমি লতার ডগায় নানা রঙের ফড়িং উড়ছে আর বসছে। তাদের পাখায় বিচিত্র রং; সকালের রোদ্দুরে ঝলমল করছে। এ সব দেখতে দেখতে একসময় উঠে এলাম গ্রাম্য পথের ওপর।
গ্রামের পায়ে চলা পথ; এক ফুটও উঁচু করা হয়নি। বর্ষার পানি নেমে গেলেও তখনো কিছুটা ভেজা ভেজা। ডাঙায় আটকে পড়া জলজ গুল্মলতা অনেকটা শুকিয়ে গেছে। পুব দিক থেকে গ্রামের প্রথম বাড়িটার সামনে আমি। সেটাকে ঠিক বাড়ি বলা চলে না, একটা ভিটা মাত্র। একসময় হয়তো লোকের বসতি ছিল, এখন নেই। সেখানে বড় বড় গাছ আর বেতবাগান ঘিরে কেমন ঝুপসি আঁধার জমাট বেঁধে আছে। সুন্দরবনের সাথে আশৈশব পরিচিত আমি; সে জন্যে মনের ভেতর কোন ভীতির সঞ্চার হল না। এর পাশেই গাছপালা ঘেরা বড়সড় বাড়ি; তার সামনে পানিতে পরিপূর্ণ একটা পুকুর। আমি বাড়িটায় ওঠার পথের ওপর দাঁড়িয়ে যে ঘরটি চোখে পড়ল, তার রাস্তার দিকের জানালার রংটা দেখার জন্য যখন ইতিউতি তাকাচ্ছি;তখন আচমকা বাড়ির ভেতর থেকে মোটামুটি দীর্ঘাকৃতির এক চাচী বেরিয়ে এলেন।
( চলবে )