আমাদের এখনকার প্রধান সমস্যার যেটার আমরা মুখোমুখি হতে পারি সেটা হচ্ছে- পোস্ট কোভিড ট্রমা।
করোনা আতঙ্ক থেকে সাধারণ মানুষ এখন মুক্ত। কোভিডে আক্রান্ত হবে, আক্রান্ত হলে মারা যাবে এই ভয় এখন কর্পূরের মতোই উবে গেছে।
কোভিড আক্রান্ত রোগীদের এখন স্বজনরাই সেবা-শুশ্রূষা করেছে। এমনকি হাসপাতালের কেবিনেও স্বজনরাই আক্রান্তকে সেবা-শুশ্রূষা করছেন
কিন্তু করোনাকালে ডব্লিওএইচও’র সবচেয়ে আত্মঘাতী যে শব্দ সোশ্যাল ডিসটেন্স এই আত্মঘাতী শব্দ আর লকডাউন মানুষকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ঘরবন্দি করে রেখেছিল অসংখ্য মানুষকে।
এই ঘরবন্দি বিচ্ছিন্ন মানুষের মননে একাকিত্বের ফলে অসহায়ত্বের অনুভূতির ফলে ভয়ের ফলে বিষণ্নতা অস্থিরতা অসহিষ্ণুতা হতাশা ক্ষুব্ধতা যে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপরে যে ছাপ রেখে গেছে সেই ছাপের প্রভাব এখন আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
আসলে মহামারি বা যুদ্ধ চলে যায়। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী যে ট্রমা বিষণ্ণতা হতাশা অসহিষ্ণুতা ক্ষুব্ধতা এটা অনেক ক্ষেত্রে রাজত্ব করে বছরের পর বছর।
পাশ্চাত্যে ইতিমধ্যেই পোস্ট কোভিড ট্রমা আক্রান্তরা ক্লিনিকে ভর্তি হতে শুরু করেছে।
আসলে পোস্ট কোভিড ট্রমা, পোস্ট ওয়ার ট্রমার মতোই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
আমরা যদি সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখব যে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে আক্রমণ করল। সৈন্য পাঠাল। আফগানিস্তানকে তা-বা করে দিল।
এবং যেভাবে বোমা বর্ষণ করল- যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রামসফিল্ড যে নির্বিচার বোমা বর্ষণ করতে করতে হাসতে হাসতে সাংবাদিকদের বলছিলেন, উই আর শর্ট অফ টার্গেট। যে ওখানে বোমা ফেলার মতন আর কোনো লক্ষ্যবস্তু আমরা পাচ্ছি না।
২০০৩ সালে ইরাক, তারপরে ১১ সালে সিরিয়া লিবিয়া আক্রমণ।
২০০১-২০২০, ১৯ বছরের সব যুদ্ধে আফগানিস্তান ইরাক সিরিয়া লিবিয়া ৭০৫৭ জন মার্কিন সৈন্য নিহত হয়।
এই একই সময়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের মধ্যে ৩০,১৭৭ জন মার্কিন সৈন্য আত্মহত্যা করে।
যুদ্ধে নিহত হয় ৭০০০। আর আত্মহত্যা করে ৩০০০০। এটা হচ্ছে পোস্ট ওয়ার ট্রমা।
যে ঘটনা তো ঘটে গেল। কিন্তু যে সৈনিক যুদ্ধ করে চলে এলো ওটার স্মৃতি সেটা তো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়!
যুদ্ধে নৃশংসতা থাকে। এবং এক্ষেত্রে ব্যক্তি সৈনিককে দোষ দেয়ার কিছু নাই। কারণ He is trained to kill. তার ট্রেনিংই হচ্ছে হত্যা করার। হয় সে হত্যা করবে না হয় সে নিহত হবে।
তো অনেক নৃশংসতা থাকে। সবকিছুতো পত্রিকায় আসে না। ছবিতে আসে না। কিন্তু যে দেখে তার তো ঐ স্মৃতিটা থেকে যায়।
এবং এই স্মৃতিটাই হচ্ছে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। যুদ্ধ পরবর্তী স্ট্রেস বা বিষণ্ণতার মূল কারণ।
এই যে মার্কিন সৈন্যদের আত্মহত্যার প্রবণতা পেন্টাগনকেও দিশেহারা করে দিয়েছে যে কেন হচ্ছে এটা!
আসলে যে-কোনো মহামারি হোক যুদ্ধ হোক দুর্যোগ হোক এরপরে সামাজিক অবক্ষয়ের একটা প্লাবন সৃষ্টি হয়, হতাশা তৈরি হয় স্ট্রেস তৈরি হয়।
এবং এবার কোভিড থেকে যুক্তরাজ্যে এই অস্থিরতা অসহিষ্ণুতা হতাশা ক্ষুব্ধতা বিষণ্নতা ১৬-২৯ বছর বয়সীরাই বেশি বেশি আক্রান্ত। মহিলাদের ৪০ শতাংশ এবং পুরুষদের ২৬ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে ৬৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী তারা দুশ্চিন্তা এবং হতাশায় আক্রান্ত।
এবং ১৮-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ তারা উচ্চমাত্রার নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত।
গত মার্চ থেকে এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে যে সমীক্ষা পরিচালিত হয় তাতে দেখা যায় যে ৩৬ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত।
করোনাকালে ১৫ মাসে এই বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা হচ্ছে ১৫১ জন কমপক্ষে।
এদের মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী এবং ২৯ জন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। এবং এদের বেশিরভাগের বয়স হচ্ছে ১২-২০ বছরের মধ্যে।
আসলে গত বছরের ১৮ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয় নি।
এখন খোলা হলেও যে শিক্ষার্থীরা চলে গেছে তাদের আর কোনোদিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরা হবে না।
আসলে করোনাকালের প্রথম ১০ মাসে মার্চ থেকে শুরু করে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৫০০০ মানুষ মারা যায়। এবং একই সময়ে আত্মহত্যা করেন ১১০০০ মানুষ।
স্বাভাবিকভাবেই এই পোস্ট কোভিড ট্রমা কাটানোর উদ্যোগ যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যে ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে।
শত শত মানুষ সেখানে পোস্ট কোভিড ট্রমা ম্যানেজমেন্ট ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছেন।
এবং সেখানে ব্যায়াম যোগ ব্যায়াম প্রাণায়াম মেডিটেশন এবং কাউন্সেলিংসহ নানাভাবে তাদেরকে ট্রমামুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।