যখন মিলাদ পড়ি যখন দাঁড়াই তখন মনে হয় যে, নবীজী (স) কত আরাম আয়েশে বড় হয়ে উঠেছেন।
তিনি যে কত কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠেছেন তা আমরা অনেকে জানি না। তিনি ভ্রূণ থেকে কষ্ট পেতে শুরু করেছেন। তারপরের কষ্টগুলো তো আমরা অনেকেই জানি।
কিন্তু তিনি মানুষকে কী অধিকার দিয়ে গেছেন এটা আমরা অধিকাংশই জানি না। কোন জায়গা থেকে কোথায় তার উত্তরণ ঘটিয়েছেন এটা আমরা অধিকাংশই জানি না।
সে যুগে দাসের কোনো অধিকার ছিল না, সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার ছিল না, নারীর কোনো অধিকার ছিল না। অর্থাৎ কোনো অধিকারই ছিল না। সেই যুগের নারীকে আসলে তাকে ট্রিট করা হতো গৃহপালিত জন্তুর মতো।
এরকম এক যুগে তিনি মানুষকে কী কী অধিকার দিয়েছিলেন?
এক হচ্ছে, জীবনের অধিকার। মুক্ত থাকার অধিকার যে, কোনো স্বাধীন মানুষকে দাস বানানো যাবে না। যুদ্ধবন্দি ছাড়া কাউকে দাস বানানো যাবে না।
এবং দাসমুক্তি। দাসকে মুক্ত করে দেয়ার অধিকার। কেউ কোনো অপরাধ করে এলে ভুল করে এলে পাপ করে এলে তাকে আগে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার কোনো দাস আছে কিনা? তো দাসকে মুক্ত করে দাও। তোমার এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে, দাসকে মুক্ত করে দাও।
আচ্ছা দাস নাই, তাহলে তুমি এই দান করো। আচ্ছা দান করারও তোমার কোনো টাকা নাই, তাহলে এখন রোজা রাখো, যাও।
অর্থাৎ প্রত্যেকটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তার প্রথম চেষ্টাই ছিল দাস মুক্ত করা। যে দাসকে স্বাধীন মানুষ বানিয়ে দাও।
কারণ তখনকার সমাজে ক্রীতদাস প্রথা এত বেশি প্রচলিত ছিল যে, দাসও পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছিল। গৃহপালিত পশু যে-রকম পরিবারের অংশ। একজন চাষ কৃষকের জন্যে যে-রকম গরু তার পরিবারের অংশ, দাসও পরিবারের অংশ ছিল।
তিনি বলেন, না। কোনো মানুষকে বৈধ কারণ ছাড়া হত্যা করা যাবে না। হত্যা করার জন্যে বৈধ কারণ থাকতে হবে।
এবং তিনি প্রত্যেকটা মানুষের রক্তকে কা’বার মতো পবিত্র ঘোষণা করেছিলেন। যে কা’বা যে-রকম পবিত্র, প্রত্যেকটা মানুষের রক্ত হচ্ছে পবিত্র, সে যে ধর্মের হোক, যে বর্ণের হোক, যে গোত্রের হোক, যে ভাষার হোক।
এবং শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব কোনো ব্যক্তির নয়। শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের। এবং যে কারণে হিংসা এবং সন্ত্রাসের কোনো স্থান ইসলামে নাই। কারণ কোনো ব্যক্তি কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। এবং বৈধ কারণ ছাড়া কাউকে আটক রাখা যাবে না।
এবং নবীজী (স) যখন মদিনায় গেলেন তখন মদিনায় গিয়ে তিনি প্রথম যে রাষ্ট্রের সূচনা করলেন প্রথম যে লিখিত সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রথম লিখিত সংবিধান। যেটাকে ‘মদিনা সনদ’ বলা হয়।
তো এরপরে তিনি ওখানে পুলিশ ব্যবস্থার প্রবর্তন করলেন।
নবীজীর সময় তিনি যখন রাষ্ট্রপ্রধান, তখনও মানুষের কথা বলার অধিকার কতটা ছিল একটি ঘটনা।
একবার হচ্ছে যে, তিনি জুমার নামাজের খুতবা দিচ্ছেন। এবং আমরা জানি যে আদব ছিল যে, নবীজী (স) যখন কথা বলবেন, তখন আর কেউ কথা বলবে না।
রসুলুল্লাহ (স) খুতবা দিচ্ছেন। একজন দাঁড়িয়ে বলল যে, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমার একটি প্রশ্ন আছে– আমার প্রতিবেশীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কী কারণে সে আটক আছে, আমি জানতে চাই।
নবীজী খুতবা থেকে বসে পড়লেন। খেয়াল করবেন, রাষ্ট্রপ্রধান ধর্মীয় প্রধান।
উদ্দেশ্য একটাই যে, এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে সে জবাব দিক। অর্থাৎ পুলিশ প্রধান জবাব দিক।
তার দিকে তাকালেন। কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন। আবার উঠে দাঁড়ালেন।
সেই লোকটি আবার দাঁড়াল। বলে যে, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাই নাই।
নবীজী (স) আবার বসে পড়লেন। আবার পুলিশ প্রধানের দিকে তাকালেন। একটু চুপ থাকলেন, আবার উঠলেন।
তৃতীয়বার একই প্রশ্ন।
তৃতীয়বার যখন সে আবার প্রশ্ন করল, তখন নবীজী নির্দেশ দিলেন, যাকে আটক করা হয়েছে তাকে ছেড়ে দেয়া হোক।
তার মানে নবীজী বুঝলেন, যে আটক করেছে তার কাছে এই প্রশ্নের কোনো জবাব নাই। যে অভিযোগকারীর অভিযোগ সঠিক, সঠিক না হলে তো সে জবাব দিত। এরপর তিনি খুতবা শেষ করলেন।
অর্থাৎ একজন মানুষের অধিকার সেই যুগে, যে যুগে ধরেন রাজার সামনে কথা বলা তারপরে আবার দ্বিতীয় বার দাঁড়িয়ে কথা বলা। দ্বিতীয় বার না, প্রথমবার দাঁড়ানোর আগেই শরীরের ওপরে মাথা থাকত কিনা সন্দেহ!
আপনার সিজারের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ এই কথা জিজ্ঞেস করা অথবা পারস্য সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করা যে, আমার প্রতিবেশীকে কেন আটক করা হয়েছে? আরে ঐ পর্যন্ত তো যাওয়ারই ক্ষমতা থাকত না।
এবং সমতা কী? যে দাস এবং মালিক কোনো ভেদাভেদ নাই। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে, পাশাপাশি বসে আলোচনা শুনছে দাস এবং মালিক।
তো এই সাহস এই অধিকার একমাত্র মহামানবের পক্ষে দেয়া সম্ভব।
আজকে যারা মানবাধিকারের কথা বলছে, তারা বিচার ছাড়া কত মানুষকে তাদের জেলখানায় আটকে রেখেছে।
আমেরিকানদের কথাই ধরুন। কারণ মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা তো তারা। গুয়ান্তানামারে কত? গুয়ান্তানামা বাদ দেন, আমেরিকার জেলখানায় এত কয়েদী কেন? হোয়াই? কারণ অধিকার নাই।
তো আসলে তাদেরকে মনে করি যে, মানবাধিকারের প্রবক্তা।
আর আমরা নিজেরা ভাবি যে, আমাদের রসুল মানবাধিকার এগুলো কি সে যুগে ছিল?
কারণ আমরা জানি না। আমরা ইতিহাস পড়ি নাই।
কথা বলার অধিকার, মুক্ত থাকার অধিকার, জীবনের অধিকার, জীবিকার অধিকার তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
এবং নিজে না খেয়ে একজন রাষ্ট্রপ্রধান রাজা প্রতিবেশীদের মধ্যে খাবার বণ্টন করে দিচ্ছেন।
এবং যখন তিনি রাশিয়া বাদ দিয়ে ইউরোপের সমান ভূখণ্ডের মালিক রাজা, তখনও মেহমান এসছে, ঘরে খাবার নাই। নিজের বর্মটা পাঠিয়ে দিলেন যে, এটা বন্ধক রেখে গম নিয়ে আস। তারপরে মেহমানদারী করলেন।
মেয়ে যাঁতাতে গম ভাঙতে ভাঙতে হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি আদর করতেন, মা ফাতেমা।
তিনি আসলেন। এসে এত বন্দি আসছে এত দাস-দাসী আসছে দেখে বললেন, এখান থেকে আমাকে একজন দাস দেয়া হোক।
তিনি তাকে দোয়া শিখিয়ে দিলেন যে, তুমি ওর চেয়ে এই দোয়া পড়ো, তুমি অনেক বেশি সওয়াব পাবে। অন্যদের প্রয়োজন তোমার চেয়ে বেশি।
একজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে মেয়ের প্রয়োজনের চেয়ে প্রজার প্রয়োজন বেশি ছিল। এবং এজন্যেই আমরা তার জন্যে দরুদ এবং সালাম পাঠাই।
মেয়ের হাতে ফোসকা পড়েছে ঠিক আছে, কিন্তু প্রজার হাতে ফোসকা না পড়ুক।
এবং মদিনাতে যখন নবীজী আছেন, হযরত আয়েশা বলেন যে, এমনও দিন গিয়েছে যে, পর পর তিন রাত কোনো খাবার নাই।
তো এবং যখন তিনি ক্ষমতার তুঙ্গে, রুটি এসছে। বাড়িতে জিজ্ঞেস করছেন যে, কোনো সালুন নাই? ওখানে তখনকার সালুন তো ছিল স্যুপ জাতীয় জিনিস। সুরুয়া।
তো ঘরে কিছু নাই? বলে যে, সিরকা আছে।
তো উনি সে রুটি সিরকাতে ভিজিয়ে খাচ্ছেন খুব তৃপ্তির সাথে যে, সিরকা খুব ভালো সুরুয়া ভালো স্যুপ ভালো খাবার।
এটা হচ্ছে তার ওফাতের কিছুদিন আগের ঘটনা, যখন মদিনার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো।
আসছে সবকিছু, সব বিতরণ করে দিয়েছেন তার চেয়েও যার প্রয়োজন বেশি তার কাছে।
ক্ষমতার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সাধারণ মানুষের প্রতি এর চেয়ে বড় সমমর্মিতা আর কী হতে পারে!
সম্মানের অধিকার। তিনি প্রত্যেকটা মানুষের সম্মানকে নিশ্চিত করেছেন তার জাতপাত নির্বিশেষে।
এবং তিনি আশরাফ-আতরাফ ভেদাভেদকে শেষ করে দিয়েছেন।
আপনি দেখেন, বেলাল ক্রীতদাস ছিল। হাবসি। যখন মক্কা মুক্ত করলেন।
আমরা মক্কা বিজয় বলি। মক্কা তো বিজয় না, এটাকে লিবারেশন অব মক্কা বলা যেতে পারে। যে মক্কাকে তিনি মুক্ত করলেন জুলুম এবং শোষণের হাত থেকে।
মক্কা মুক্ত করে যখন কা’বাতে গেলেন, কা’বার ওপরে কাকে উঠিয়েছিলেন?
উনি তো আবুবকরকে বলতে পারতেন। উনি ওমরকে বলতে পারতেন যে, যাও কা’বার ওপর উঠে আজান দাও।
না, উনি আভিজাত্যের মানে আভিজাত্যকে বিনাশ করার জন্যে কী করলেন? বেলালকে বললেন, বেলাল তুমি ওঠ। কেউ বলল, কালো মানুষ।
তিনি বললেন, কালো মানুষ তুমি, তাতে কী? ওপরে ওঠ। বেলাল বলল যে, আমি?
নবীজী বললেন, হাঁ, তুমি। ওপরে ওঠ। ওখান থেকে আজান দাও।
এবং তখন কোরাইশদের এক নেতার ছেলে, যার বাবা মারা গেছে সে-ও দূরে সমবেত হয়েছে, শুনছে। এবং শুনে সে বলে যে, আমার বাবা মারা গেছে খুব ভালো হয়েছে। সে যদি এই দৃশ্য দেখত, এই দৃশ্য দেখেই মারা যেত যে, কাবার ওপরে বেলাল উঠেছে।
অর্থাৎ মানুষকে তিনি কতটা সম্মান করতেন!
ওনার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকরকেও বললেন না। বললেন বেলালকে, বেলাল, তুমি ওপরে ওঠ।
আমি এই আভিজাত্যের বিনাশ, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এই ভেদাভেদের বিনাশ করতে চাই। মানুষের অধিকারকে আমি সমুন্নত রাখতে চাই যে না, মানুষ, তার পরিচয় হচ্ছে মানুষ।
এবং প্রত্যেকটা মানুষ সমান। কালোর ওপরে সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই। সাদার ওপরে কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই।
এবং তিনি পৃথিবীতে একমাত্র ধর্মপ্রচারক এবং ধর্মপ্রতিষ্ঠাকারী, যিনি শুধু নিজের ধর্মপ্রচার করেন নাই। প্রত্যেক ধর্মের মানুষকে সমানাধিকার দিয়েছেন, ধর্মপালনের অধিকার দিয়েছেন এবং অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন।
তো মদিনা সনদ যেটা ছিল, সেখানে মূর্তিপূজারি ক্রিশ্চিয়ান ইহুদি প্রত্যেককে তার নিজ নিজ ধর্মপালনের অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
এবং তিনি মুসলমানের ধনসম্পদ এবং অমুসলমানের ধনসম্পদ সমান পবিত্রজ্ঞান করেছেন।
এবং তার একটা বিখ্যাত হাদীস আছে, কেউ যদি তার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কোনো অমুসলিমের সম্পদ নষ্ট করে দখল করে; তিনি বলেছেন, কেয়ামতের ময়দানে আমি সেই মজলুমের পক্ষে দাঁড়াব।
একজন মানুষ কত মানবিক কত মহান হলে এ কথা বলতে পারেন যে, আমি তাকে ক্ষমা করব না।
এবং এই যে ধর্মপালনের অধিকার এবং প্রত্যেক ধর্মের মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা তিনি করেছেন এজন্যেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন সমস্ত সৃষ্টির জন্যে তিনি হচ্ছেন করুণাস্বরূপ।