তথাকথিত তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে রূপান্তর এখন বাস্তবতা
আসসালামু আলাইকুম, সবার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে স্বর্ণ প্রসবিনী দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় আমরা প্রবেশ করতে পেরেছি।
সিকি শতাব্দি আগে বিশ্বের প্রথম ১০ জাতির এক জাতিতে রূপান্তরিত হবার যে মনছবি আমরা করেছিলাম, সেই মনছবির ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি।
আমাদের দেশ এখন বিশ্ব দরবারে অনেকগুলো ক্ষেত্রেই অর্জনের দিক থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় অবস্থানে নিজের অবস্থান করে নিতে পেরেছে।
ইলিশ আমাদের মাছ এবং ইলিশে আমরা প্রথম।
পাট রপ্তানিতে প্রথম এবং উৎপাদনে দ্বিতীয়।
কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়।ছাগলের দুধে দ্বিতীয়। তৈরি পোশাকে দ্বিতীয়। আউটসোর্সিং-এ দ্বিতীয়।
সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। মিঠা পানির মাছে তৃতীয়। ধান উৎপাদনে চতুর্থ। আলুতে ষষ্ঠ।
প্রবাসী আয় অর্জনে অষ্টম। পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম। আম উৎপাদনে অষ্টম।
আসলে আমাদের দেশ যে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে সিক্ত দেশ তা আমরা ৩০ বছর ধরেই বলে আসছি। অর্থনৈতিক অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধির একটা পর্যায়ের দিকে যাচ্ছি।
এই সমৃদ্ধি প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতে পারে, যদি আমরা আমাদের দক্ষতা, কর্মক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক গুণাবলিকে জাগ্রত করি।
আবহমান বাংলার যে অতীত ইতিহাস তা শুধু গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছই ছিল না, এর সাথে ছিল গলাভরা গান আর হৃদয়ভরা টান। এ হৃদয়ের টানটাকে যদি আমরা আবার নতুনভাবে জাগ্রত করতে পারি।
সুস্থতা ও আত্মশুদ্ধির দায়িত্ব নেয়ার মাস রমজান
বহুক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেরকম এসেছে সেইসাথে নির্মম সত্য হচ্ছে, এক বছরে ৫২ লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে চিকিৎসা বেনিয়াদের শোষণের যাঁতাকলে পড়ে।
তাদের শোষণের কল এতটাই বিস্তৃত যে, কেউ যদি একবার সেই কলের মধ্যে আটকা পড়ে তাহলে তার নিঃস্ব হওয়া ছাড়া সেখান থেকে বেরোনোর আর কোনো পথ থাকে না।
অবশ্য চিকিৎসা বেনিয়াদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর প্রক্রিয়াটা খুব সহজ।
প্রক্রিয়াটা হচ্ছে নিজের সুস্থতার দায়িত্ব নিজে নেয়া।
আর বুদ্ধিমান মানুষ নিজের দায়িত্ব যখন নিজে নেয় তখন সেটা সবসময় সবচেয়ে ভালোভাবেই নেয়।
মাহে রমজান আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে সুস্থ থাকা এবং নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর চমৎকার সুযোগ।
রমজান আত্মশুদ্ধির মাস হিসেবেই সাধারণভাবে পরিচিত।
কিন্তু আমরা যদি খুব গভীরভাবে দেখি তাহলে আমরা দেখব যে রমজান হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মিকভাবে সুস্থ থাকা, ভাল থাকার মাস।
রসুলুল্লাহ (স) এর অমোঘ বাণী ও আধুনিক গবেষণা
আমরা হাজার বছর ধরে বুঝিনি কেন রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন যে তোমরা রোজা রাখো যাতে তোমরা সুস্থ থাকতে পারো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা দিয়ে তাবারানি তে খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন যে, “রোজা রাখো যাতে তোমরা সুস্থ থাকতে পারো”।
একসময় আমাদের কারো কারো মধ্যে ধারণা ছিল যে রোজা রাখলে সে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। এবং এই ধারণা যে কত ভ্রান্ত ছিল রসুলুল্লাহর (স) এই বাণী যে কত নির্ভুল, এই নির্দেশনা যে কত নির্ভুল তা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করলেন জাপানি গবেষক ইউশিনোরি ওশুমি।
তিনি তার গবেষণায় খুব সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন রোজা বা উপবাস কীভাবে দেহকে টক্সিনমুক্ত করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
অটোফেজি নামে এই গবেষণার জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
অটোফেজি বা রোজা বা উপবাস নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং তাতে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, ব্যথা, সংক্রমণ, ফুলে যাওয়া এটা উপবাসে কমে যায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। বার্ধক্য প্রতিরোধ করে। মস্তিষ্ক ক্ষুরধার হয়।
অটোফেজিকে জাপানি গবেষক ওশুমি যেভাবে শরীরের শুদ্ধি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেই একই বর্ণনা আমরা পাই ইবনে মাজাহ শরিফে হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত রসুলুল্লাহ’র (স) হাদীসে।
রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, সবকিছুর যাকাত রয়েছে। যাকাত অর্থ হচ্ছে শুদ্ধি প্রক্রিয়া শরীরের যাকাত হচ্ছে রোজা।
সংযমের মাসে করণীয়-বর্জনীয়
রমজান মাস সমাগত।
শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, আত্মিক সবদিক থেকেই আপনি ভাল থাকতে পারেন যদি আপনি আল্লাহ’র রসুল যেভাবে রোজা রাখতে বলেছেন সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন।
যারা রোজা রাখবেন তারা সবচেয়ে ভালোভাবে রাখবেন।
আল্লাহ’র নির্দেশ হচ্ছে প্রতিটি কাজ তুমি সবচেয়ে ভালোভাবে করবে।
রোজার পুরো উপকার পাওয়ার জন্যে খাবার-দাবার থেকে শুরু করে সব ব্যাপারেই সংযম অবলম্বন করতে হবে।
ফালতু, আজেবাজে অপ্রয়োজনীয় কথা, চেঁচামেচি করা, বকাবকি করা বা ঝগড়া-বিবাদ থেকে পুরোপুরি দূরে থাকতে হবে। পরনিন্দা, পরচর্চা, গীবত বর্জন করতে হবে।
ইফতার করবেন খেজুর দিয়ে। এটাই আল্লাহর রসুলের সুন্নত। তারপরে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যকর খাবার খাবেন। ভাজাপোড়া যত না খান তত ভালো।
আমরা রমজান মাসে চিনির শরবত এবং চিনি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করি।
এবারের রমজানে বিশেষভাবে বর্জনীয় হোক চিনি এবং চিনিজাত সকল দ্রব্য।
চিনি এমনিতেই বিষ এবং স্থূলতা, হৃদরোগ, ক্যান্সার- এর প্রধান কারণগুলোর একটি হচ্ছে চিনি। শরবত, সিরাপ, মিষ্টি অর্থাৎ চিনিজাতীয় যত খাবার রয়েছে, এবারের রমজানে পুরোপুরি বর্জন করবেন।
তাহলে আপনার সুস্থতা এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আপনি নিজেই অনুভব করবেন।
সবসময় ফল খেজুর, ডাবের পানি, টক দই, লেবুপানি, শাক-সবজি, দুধ, সয়াদুধ, মাংসের মধ্যে মুরগি, মাছের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ- ইফতার পরবর্তী এই খাবারগুলো রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
রমজানে ভ্রষ্টাচারের সাম্প্রতিক সংযোজন হচ্ছে বিলাসবহুল ইফতার পার্টি, সেহরি পার্টি এবং ইফতার, সেহরি নিয়ে ফুড ভ্লগিং- যে সোশ্যাল মিডিয়াতে ইফতার-সেহরির প্রদর্শনী প্রচার করা।
এর মাধ্যমে যে অপচয় এটা আসলে সমাজের এক শ্রেণির অসংযমী মানুষের ভ্রষ্টাচারের পরিণতি।
সেহরিতে সবচেয়ে হালকা খাবেন। অল্প সবজি, অল্প ভাত বা রুটি এবং একটু ফল।
সেহরি যত হালকা করবেন, আপনার শরীরটা তত ঝরঝরে হালকা থাকবে।
আসলে নবীজী যে এত সুস্থ ছিলেন, প্রাণবন্ত ছিলেন তার কারণ হচ্ছে-ইফতারও তিনি হালকা করতেন, সেহরিও হালকা করতেন।
অফুরন্ত সওয়াব ও দানের মাস রমজান
রমজান আমাদের সামনে অফুরন্ত নেকি অর্জনের সুযোগ এনে দিয়েছে।
রোজা রাখার যে নেকি, রোজা রাখার যে পুণ্য, রোজা রাখার যে সওয়াব- আল্লাহতায়ালা বলেছেন যে, “এই সওয়াব আমি নিজে দেব”।
হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত মুসলিম শরিফের হাদীস হচ্ছে, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন যে, “মানুষের প্রত্যেকটি সৎকর্মের নেকি আল্লাহ গুণিতক করেন। দশ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি দান করেন। আর রোজার নেকি আল্লাহ নিজে দেবেন কোনো সীমা ছাড়া তার ইচ্ছানুসারে”।
রোজা রাখার যে নেকি এটা তো রয়েছে এবং রসুলুল্লাহ (স) রোজার মাসে সবচেয়ে বেশি দান করতেন।
কারণ, দানের সওয়াব সাতশ গুণ থেকে শুরু হয় এবং রোজাতে এই সাতশ গুণের উপরে আল্লাহতায়ালা তার ইচ্ছামতো নেকি দেন।
তাই যাকাতদাতারা অবশ্যই রমজানে চেষ্টা করবেন যাকাত আদায় করতে। এখন থেকেই সে প্রস্তুতি নেন যাতে রমজান মাসে আপনি আপনার যাকাত আদায় করতে পারেন।
যাকাত আদায় এমনিতে ফরজ। আর রমজান মাসে যখন আপনি যাকাত আদায় করবেন, এর সওয়াবও অনেক অনেক অনেক অনেক গুণ আল্লাহতায়ালা বাড়িয়ে দেবেন।
কোরআনের জ্ঞান বিতরণ করুন কারণ, কোরআন বিশ্বাসীর জন্য রহমত ও শেফা
রমজান মাসে আরো একটি মহৎ কাজ, ভালো কাজ আপনার নেকির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
তা হচ্ছে কোরআনের জ্ঞান। কোরআন রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। যে কারণে রমজান মাসের বরকত এত।
কোরআন হচ্ছে বিশ্বাসীর জন্যে রহমত এবং শেফা, নিরাময়।
এই নিরাময় শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, আত্মিক সব ক্ষেত্রেই। তাই কোরআনের ধ্যানে ডুবে যান।
২৩ তম বার্ষিক কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন এবার শুরু হবে ১৬ই এপ্রিল থেকে এবং চলবে ২২শে এপ্রিল পর্যন্ত। আখেরি দোয়া হবে ২৩শে এপ্রিল।
ধ্যানের স্তরে কোরআন খতম, তেলওয়াত এবং এর মর্মবাণী শ্রবণের মধ্য দিয়ে আপনি ১২৫ কোটি বছর নফল ইবাদত করলে যে সওয়াব পেতেন সেই সওয়াবের সমান সওয়াবের অধিকারী হতে পারেন।
সওয়াবের চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে কোরআন আসলে রহমত এবং শেফা, নিরাময়।
শারীরিক, মানসিক, আত্মিক নিরাময়ের মধ্য দিয়ে আপনার সুস্থতা এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার একটা তুঙ্গ অবস্থায় আপনি পৌঁছতে পারেন।
এই রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ইনশাল্লাহ আপনাকে বহু রোগব্যাধি থেকে, ভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করবে। কারণ কোরআন রহমত এবং শেফা।
অতএব, রমজানের এই পুরো সময়টাই যখনই সময় পান তখনই ব্যয় করুন তখনই কোরআনের গভীরে।
শুধু এই সাত দিন খতমে কোরআন ছাড়াও যখনই সময় পান, কোরআনের গভীরে, দোয়ার গভীরে, প্রার্থনার গভীরে ডুবে যান এবং সুস্থ, প্রাণবন্ত, দুর্ভেদ্য রোগ-প্রতিরোধ বর্মে সুরক্ষিত এক নতুন জীবন শুরু করুন এই রমজানের মধ্য দিয়ে।
মেনে চলুন কিছু পয়েন্টস এবং ভালো থাকুন
রমজান আপনার জন্য যথার্থ সংযমের মাস হোক, যথার্থ রমজান হোক।
এবারের রমজান আপনার জীবনে সুস্থতা এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করুক। এটাই আমাদের কামনা।
পরম করুণাময় আমাদের সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখুন।
এই রমজান আমাদের সুস্থতা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং নৈতিক পুনর্জাগরণের কারক হোক।
প্রিয় সুহৃদ,
কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনে শুধু নিজেই অংশ নেবেন না, পরিচিত আত্মীয়-বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করুন সপরিবারে কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনে অংশ নিতে।
রমজানে আপনি যতগুলো সৎকর্ম করতে পারেন তার মধ্যে কোরআনের জ্ঞান বিতরণ করা সবচেয়ে বড় সৎকর্ম।
আসলে রমজানে নিজে কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়া এবং অন্যকে কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী করার চেয়ে পুণ্যময় কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
সুযোগ পেলেই আল কোরআনের মর্মবাণী পড়ুন।
বন্ধু-বান্ধবদের, শুভানুধ্যায়ীদের কোরআনের মর্মবাণী পৌঁছে দিন। এ মর্মবাণী গ্রন্থাকারে হতে পারে, অডিওরূপে হতে পারে।
পরম করুণাময়ের কাছে আমাদের প্রার্থনা রমজানে আমাদের সবাইকে সুস্থ এবং ভাল রাখুন, তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখুন এবং আগামী রমজান পর্যন্ত এই রহমতের ছায়া আমাদের উপর বিস্তার করে দিন।
আমরা যেন সবাই সুস্থ থাকতে পারি।
দৈহিক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, আত্মিকভাবে ভালো থাকতে পারি, প্রাণভরে দান করতে পারি, সৎকর্ম করতে পারি, সেবা করতে পারি, নিজের কল্যাণে এবং মানুষের কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারি এবং প্রতিটি কাজ যেন সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারি- পরম করুণাময় এই রমজানে আমাদের সবাইকে এই তৌফিক দান করুন।
[০২ এপ্রিল ২০২১ সাদাকায়নের জন্যে ২৯ মার্চ ২০২১ তারিখে গুরুজীর প্রদত্ত বক্তব্য]