ইতিবাচকতা সম্ভাবনার কথা বলে,বিশ্বাসের কথা বলে। জীবনে জয়ী হতে হলে সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক হতে হবে। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে তা অনেকসময়ই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। একই সাথে আমাদের দুঃখ দুর্দশার কারণও হলো ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিক্রিয়া। এজন্যে আমাদের জীবন, জয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হবে না পরাজয়ের গ্লানিতে পূর্ণ তা নির্ভর করবে আমাদের ইতবাচক বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্যের উপর।
“দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচকতা”। শিক্ষার্থী প্রোগ্রামের মডারেটর শাফিয়া নাজরীন আলোচনার প্রথম দিকে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেন আমরা কীভাবে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে পারি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে যে ক্রিয়া করে থাকে সেই সঠিক ক্রিয়াটি কী হতে পারে ।
যেমন-
সকালে ঘুম থেকে উঠে, ঘুমের ঘোরে দাঁত ব্রাশ করার পর বুঝতে পারলেন সেটা অন্য আরেকজনের ব্রাশ, তখন কী অনুভূতি হবে-গা গুলিয়ে উঠা/ প্রচন্ড রাগ করা/ নিজের ব্রাশ দিয়ে আরেকবার ব্রাশ করা। নিজের ব্রাশ দিয়ে আরেকবার ব্রাশ করা। যার ব্রাশ ভুল করে ব্যবহার করা হয়েছে তাকে তা জানানো। খাওয়ার সময় বুঝলেন খাবারে অতিরিক্ত লবণ দেয়া হয়েছে ফলে মুখেই দেয়া যাচ্ছে না। অথবা খাবার খেতে খেতে খাবারে চুল পেলেন, নয়তো সবজির পোকা পেলেন। তখন কী করবেন?-
প্রো-একটিকভাবে শুকরিয়ার সাথে খেয়ে নেয়া/ ওয়াক থু বলে ফেলে প্লেট ছুঁড়ে দিয়ে টেবিল ছেড়ে চলে যাবেন?
সবার স্বীকারোক্তি ছিলো-প্রো-একটিকভাবে শুকরিয়ার সাথে খেয়ে নেয়া। হতে পারে আপনি কোনো কাজ করছেন হঠাৎ কোনো টিকটিকি/ তেলাপোকা মাথায় লাফিয়ে পড়লো, কী করবেন? চুল ফেলে দেবেন/ নাকি তক্ষুণি শ্যাম্পু করতে বাথরুমে ঢুকবেন/ নাকি একটা ঝাড়া দিয়ে টিকটিকি ফেলে দিয়ে যা করছিলেন তা করবেন। সবার উত্তর ছিলো-একটা ঝাড়া দিয়ে টিকটিকি ফেলে দিয়ে যা করছিলো তা করবে। এমন হতে পারে কাঁদায় পা পিছলে পড়ে গিয়ে আপনার জামা নষ্ট হয়ে গেছে আর অপর দিকে যারা দেখছেন তারা হাসছেন। তখন কী করবেন- কাঁদবেন/ তাদের সাথে হাসিতে যোগ দেবেন/ মাথা নিচু করে সেখান থেকে দ্রুত চলে আসবেন?
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তাদের সাথেও হাসিতে যোগ দিয়ে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক মনে করা, সুযোগ থাকলে বাসায় গিয়ে পোশাক পাল্টে আবার নিজের কাজে যাওয়া। আসলে এ ধরনের অসংখ্য বিব্রতকর ঘটনা আমাদের জীবনে অহরহ ঘটে চলেছে। এসব ক্ষেত্রে সচেতন থাকলে ভালো কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার সুযোগও থাকে না। যেমন গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচেছন হঠাৎ অনুভব করলেন মাথায় তরল জাতীয় কী যেন পড়লো। হাত দিয়ে বুঝলেন পাখি টয়লেট করেছে। এখন লাজুক হাসি হাসা ছাড়া আপনার আর কিছু করারও নাই। কারণ আপনি যতই বিরক্ত হোন বা রেগে যান না কেন আপনার পক্ষে সেই পাখিটাকে ধরে বকা দেয়ার কোনো সুযোগ নাই।
আর এরকম বিব্রতকর অবস্থায় অন্যরা হাসছে কিন্তু আপনার মাথায় পড়ার পরেও আপনি হাসতে পারছেন কি না-এটাই গুরুত্বপূর্ণ। হাসতে না পারলে আপনার কাছে পরিস্থিতি জটিল মনে হবে, আর হাসতে পারলে মনে হবে এটা খুব সহজ স্বাভাবিক ব্যাপার। যখন দৃষ্টিভঙ্গিটা সঠিক হয় তখন জীবন আসলে অনেক সহজ, উপভোগ্য এবং সাফল্যমন্ডিত মনে হয়। দৈনন্দিন জীবনের অনেক ছোটখাটো বিষয় থেকে শুরু করে যেকোনো বড় সমস্যার মোড় আমরা ঘুরিয়ে দিতে পারি যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হয়। আমাদের একটি খুব চমৎকার অটোসাজেশন আছে-সুখী হতে হলে অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু ভুলে থাকতে হয়। আমি অপ্রয়োজনীয় সবকিছু ভুলে থাকবো। এক্ষেত্রে গুরুজীর স্ট্র্যাটেজি শুধু ভুলে থাকা নয়। সেটা দেখারই দরকার নেই বরং ওভারলুক করা।
যেমন-মাছি গায়ে বসতে নিলে আমরা তাড়িয়ে দেই সেভাবে তাড়িয়ে দেয়া। যতবার বসবে ততবার তাড়িয়ে দেয়া। কনফুসিয়াস-এর একটি কথা আছে-মাথার ওপর দিয়ে তো পাখি উড়ে যেতেই পারে, কিন্তু পাখি যেন মাথায় বাসা না বাঁধে। যদিও বাস্তবে পাখি মাথায় বাসা বাঁধে না। আর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলে আমরা বরং খুশি হই। বাহ্! কী সুন্দর একঝাঁক পাখি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। আর যখনই এই ঘটনাটা মুগ্ধকর মনে হয় তখন আমাদের মধ্যে একটা সুখ সুখ অনুভূতি আসে। কিন্তু এর বিপরীত যদি হয়? যদি কেউ বিরক্ত হয়? তখন মুখে কিছু না বলে শুধু যদি মুখভঙ্গি বিকৃত করে ফেলে বা ছোট্টখাট্ট বিরক্তিবোধক শব্দ উচ্চারণ করে যেমন-ই্স!, উহফ!, আহ্হা রে! তখন আবার আমাদের ভেতরে কম ভালো লাগার একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এই শব্দগুলো আরেকজনের মুখে শুনলে যেমন আমাদের কম ভালো লাগে, তেমনি নিজে বললে ভালো লাগার কথা নয়।
ইতিবাচক হওয়ার জন্যে কথার একটা প্রভাব আছে। যে কারণে, আমাদের কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ করে এমন শব্দ-ই্স!, উহফ!, আহ্হা রে! আবার অনেক সময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়া, আরে বাপুরে!, ধ্যাত, ধুত্তুরি, যত্তোসব, অসহ্য ইত্যাদির ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে। আসলে অসহ্য বলাটা সহজ, সহ্য বলাটা কঠিন। তবে একবার অভ্যস্ত হতে শুরু করলে সহ্য বলাটা সহজ, সহ্য করাটা সহজ। শর্ত শুধু একটাই মন থেকে চাওয়া। লোক দেখানোর জন্যে না, বা ভান করার জন্যেও না।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা আছে। একবার এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে কোনো এক রূপচর্চার বইতে পড়েছে যে, সবসময় একচিলতে হাসি মুখে ধরে রাখলে মেয়েদের সুন্দর লাগে। ব্যস, সে কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে পুরো একটা ঘণ্টা রিকশায় সেই হাসি ধরে রেখেছিলো। তারপর যখন বাসায় ঢুকলো, পুরো গাল ব্যথা। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললো, আর জীবনেও এতক্ষণ হাসবো না। কিন্তু এই বিরক্তি হওয়ার মূল হলো হাসিটা মন থেকে ছিলো না। আন্তরিক ছিলো না। আন্তরিকভাবে মুখে একটা হাসি ধরে রাখা সম্ভব হয় না যদি নেতিবাচকতা আপনার ওপর ভর করে। আসলে সমস্যাকে সম্ভাবনা বলে হাসিমুখে ঠান্ডা মাথায় বিশ্বাসের সাথে ফেস করতে হবে। যখন মনে করবেন এটা কোনো ব্যাপার না। এরচেয়েও খারাপ কিছু হতে পারতো। অর্থাৎ দুর্ঘটনাকে ফেনানোর দরকার নেই। না ফেনিয়ে এটাকে ফানে রূপান্তরিত করতে পারাই ইতিবাচকতা। যেমন, হয়তো শুনলেন, আপনার এক বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে। পায়ে চোট পেয়েছে, তাই পা দুটো বেডের সাথে বাঁধা। তাকে দেখতে গিয়ে যদি আহা, উহু করেন তাহলে তার ব্যথা কমবে না, বরং বাড়বে। সেসময় যদি তার রুমে ঢুকেই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে একটা সালাম দিয়ে বলেন, দোস্ত কেমন আছো। তোমাকে তো দেখতে লাগছে খুব ভালো। একটা ছবি তুলে রাখো। নাতি-নাতনিদের দেখাতে পারবে।
যে দাদুকে একবার বিছানার সাথে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিলো। বন্ধু তখন কী বলবে? অনেকদিন তো হাসে নাই। একটু দাঁত বের করবে। কিংবা কপট রাগ দেখিয়ে বলবে, এই কথা তুমি বলতে পারলে? আসলে এটা মুখের কথা, মনের কথা কী? অনেকদিন পর একটু ভালো লাগছে, তোমরা এসে কথা বলছো বলে। অর্থাৎ ঘটনা যত শোচনীয় হোক না কেন তার মধ্য থেকে ভালো দিককে খুঁজে বের করে আনতে হবে। যেমন স্বর্ণের খনি থেকে তো স্বর্ণ পাওয়া যাবেই। কিন্তু সার্থকতা হচ্ছে ছাইয়ের স্তুপ থেকে স্বর্ণ খুঁজে পাওয়া। অর্থাৎ একটি আপাত কষ্টের ঘটনারও ভালো দিককে যত গ্রহণ করতে পারবো তত আমাদের শান্তি, সুখ আসতে থাকবে, এই শান্তি-সুখের আবেশ নিয়ে অনেক কাজ করতে পারবো, আমাদের সাফল্য বাড়তে থাকবে।
আসলে আপনি যখন অন্যের আচরণে প্রভাবিত হবেন তখন তাকে আর আপনার আচরণ দ্বারা প্রভাবিত করতে পারবেন না। তাই সবসময় অন্যের সাথে সে-ই আচরণ করুন যে আচরণ আপনি আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন। জীবনযুদ্ধে প্রতিপক্ষ সবসময় আপনাকে উত্তেজিত ও আবেগপ্রবণ করার চেষ্টা করবে, আপনার লক্ষ্য থাকবে ঠান্ডা মাথায় সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করতে পারেন।
মনের প্রশান্তির জন্যে নিজের ওপর নিজের এই নিয়ন্ত্রণ আনাটা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের ভিত্তিহীন কথার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তেজনা, ক্রোধ এবং জীবন নাশের একটা ভুল সিদ্ধান্ত মানুষকে জীবনে অনেক পিছিয়ে দেয়। আর এটা সমাধানের পথ হচ্ছে মেডিটেশন।
আর স্রষ্টার রহমতে মেডিটেশন করার পর আমরা আমাদের উপর এই নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছি। এরপর সবাই ‘সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন’ অটোসাজেশনে আত্মনিমগ্ন হন।