পবিত্র রমজানে আপনার জীবনে রহমত ও বরকতের স্রোত প্রবাহিত হোক।
আপনি জানেন, রমজান কোরআন নাজিলের মাস, দোয়ার মাস, দানের মাস, সেবার মাস জৈবিকতার শৃঙ্খল মুক্তির মাস। নিজের যত্ন নেয়ার মাস এবং দেহ মন ও আত্মার পুরোপুরি যত্ন নেয়ার সুযোগ এ মাসেই সবচেয়ে বেশি।
এই যত্ন নিয়ে আলোচনা করার আগে আখেরি দোয়ায় অংশ নিতে পারার জন্যে পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আমরা আমাদের গভীর গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আসলে ২৫ তম বার্ষিক কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন ও আখেরি দোয়ার কল্যাণ তরঙ্গ ছিল পুরোপুরি ভিন্নমাত্রার। এবার কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআন একস্থান থেকে দেশের সর্বত্র সরাসরি প্রচার করা হয়েছে ডিজিটাল মিডিয়ায়।
দেশের বিভিন্ন সেন্টার/শাখা/সেলে শত শত গ্রাজুয়েট ও প্রো-মাস্টার কোরআনের জ্ঞান অনুধাবনের সামষ্টিক প্রচেষ্টায় নিমগ্ন হন। আসলে ধ্যানের স্তরে সামষ্টিকভাবে জ্ঞান অন্বেষণ সবসময়ই বেশি ফলপ্রসূ হয়। যারা এতে অংশ নিয়েছেন তারা ১২৪ কোটি বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব বা পুণ্য অর্জন করেছেন।
প্রিয় সুহৃদ! এবারের আখেরি দোয়ার পুরোটাই ছিল ভিন্নমাত্রার। এই প্রথমবারের মতো মূল ভেন্যুতে কয়েক হাজার ধ্যানীর সাথে দেশের সর্বত্র সেন্টার/শাখা/সেল ছাড়াও এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া- ছয় মহাদেশের দেশে দেশে শহরে শহরে অবস্থানরত হাজার হাজার গ্রাজুয়েট মাস্টার ও এসোসিয়েটসহ লাখো নারী-পুরুষ সরাসরি দোয়ায় অংশ নিয়ে এক আবেগঘন অনুরণন সৃষ্টি করেন।
দোয়ার আবেশে অনেকেই ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে একাধিকবার দোয়ায় ডুবে যান। ফলে এবারের দোয়ার ভাইব্রেশন ও রেশ আমরা অনুভব করেছি পরদিন পর্যন্ত।
আল্লাহর রহমতের ছায়ায় প্রকৃতিতেও একটা সিক্ত স্নিগ্ধ শীতল আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এক অনাবিল প্রশান্তি লাভ করেন দোয়ায় নিমগ্ন ধ্যানীরা। পরম করুণাময়ের এই করুণার জন্যে আবারও তার প্রতি গভীর গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমরা বলছিলাম রমজান কোরআন নাজিলের মাস দোয়ার মাস।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, আসলে কোরআন কী? বিশেষজ্ঞরা নানানভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
রমজান যেহেতু নিজের যত্ন নেয়ার মাস, এই আলোকে সূরা বনি ইসরাইলের ৮২ নম্বর আয়াত উল্লেখ করে আমরা বলতে পারি, বিশ্বাসীদের জন্যে কোরআন শেফা ও রহমতস্বরূপ।
প্রশ্ন করতে পারেন, শেফা কী? এর উত্তর একটু ব্যাপক।
‘শেফা’ শুধু দেহের রোগ নিরাময় নয়, শেফা হচ্ছে সবধরনের মনোদৈহিক মনোজাগতিক মনোসামাজিক ও আত্মিক ব্যাধি বিকার বিভ্রান্তি ও বিকৃতি থেকে মুক্তি। ‘মনোজাগতিক’ শব্দটিকে আমরা একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিগত ধ্যান-ধারণাগত বিভ্রান্তি বিকার ও বিকৃতি বলতে পারি।
‘শেফা’ শব্দের অর্থটি আপনি এভাবেও করতে পারেন যে, কোরআন ইজ এ কিওর ফর অল সর্টস অব সাইকোসোম্যাটিক সাইকো-ইন্টালেকচুয়াল সাইকো-সোশ্যাল সাইকো-স্পিরিচুয়াল এলিমেন্ট এন্ড পারভার্শন।
অর্থাৎ এক অর্থে কোরআন হচ্ছে, দেহ মন আত্মার পরিপূর্ণ যত্ন নেয়ার দিক-নির্দেশক ম্যানুয়াল।
এবং কোরআনের এই ম্যানুয়াল অনুসরণ করলেই অর্থাৎ কোরআন অনুসরণ করলেই আপনি পাবেন ‘টোটাল ফিটনেস’।
আবার প্রশ্ন করতে পারেন ‘রহমত’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
রহমত হচ্ছে শান্তি নিরাপত্তা ও কল্যাণের অনন্ত আশ্রয়। যা ইহকাল ও পরকাল দুইকালেই। অর্থাৎ কোরআনে জীবনযাপনের যে ম্যানুয়াল দেয়া আছে তা অনুসরণ করলে ইহকাল এবং পরকাল দুইকালেই সুস্থতা শান্তি নিরাপত্তা ও অনন্ত কল্যাণ লাভ করতে পারবেন।
আমরা বলছিলাম রমজান দোয়ার মাস। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, দোয়া কী? উত্তরটা খুব সহজ!
দোয়া হচ্ছে আপনার যত ইবাদত, সকল ইবাদতের নির্যাস। তাই যত ইবাদত উপাসনা আরাধনা যা-ই করেন উপসংহার টানবেন দোয়া বা প্রার্থনা দিয়ে।
রমজানের সারা মাস যখন সময় পান পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আন্তরিকতার সাথে দোয়া করুন। দোয়া করার সময় সবসময় আল্লাহকে খুব কাছে ভাববেন। খুব কাছে খুব কাছে ভাববেন। অনুভব করবেন তিনি আপনার কথা শুনছেন।
বিনয় ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে তাঁর কাছে নিজের আকুতি পেশ করবেন। নির্দ্বিধায় বলবেন, ব্যক্তিগত কোনো অক্ষমতা প্রকাশে দ্বিধা করবেন না, কোনো সংকোচ করবেন না। কারণ তিনি সব জানেন তারপরও তিনি চান আপনি মুখ ফুটে আপনার সব কথা আপনি বলুন।
তিনি যেহেতু সর্বশক্তিমান মহামহান, তিনি সব পারেন। আপনার যে-কোনো যৌক্তিক ইচ্ছাপূরণ করা তাঁর জন্যে মোটেই বড় কিছু নয়। তাই কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেতিবাচকতার প্রশ্রয় দেবেন না। তিনি দোয়া কবুল করবেন এই পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে তাঁর কাছে চাইবেন।
কারণ আল্লাহ বান্দা যে রূপে তাকে ভাবে, তিনি সে রূপেই তার জীবনে প্রতিভাত হন। তাই সবসময় ভাববেন, আপনি তাঁর রহমতের ছায়ায় আছেন সবসময় বলবেন, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ!’ ইনশাআল্লাহ আপনি সবসময় তাঁর রহমতের ছায়ায় থাকবেন।
আপনারা অনেকে জানতে চেয়েছেন ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে একা একা বা কয়েকজন মিলে আখেরি দোয়া রিপিট করা যাবে কিনা?
আপনাদের প্রশ্ন থেকে বোঝা যাচ্ছে, আপনারা দোয়ায় ডুবে গিয়েছিলেন। একটা অন্যরকম অনুরণন অনুভব করেছেন। তাই মন চাইলে এই দোয়া বার বার রিপিট করতে পারেন। এতে দোয়ার আরো গভীরে ডুবে যাওয়ার সক্ষমতা বাড়বে।
আমরা বলছিলাম রমজান দানের মাস। আসলে সবধরনের ভালো ব্যবহার ভালো আচরণ ভালো কথা ভালো পরামর্শ সবই হচ্ছে দান। অন্যের কল্যাণে করা প্রতিটি কাজ হচ্ছে দান। দান বলেন সেবা বলেন সাদাকা বলেন একই জিনিস।
আর রমজানে যে-কোনো দান বা সেবার নেকি শুরু হয় সাতশ গুণ ৭০। আর যখন সঙ্ঘবদ্ধভাবে কোনো দান সেবা বা সাদাকা করা হয় তখন সাতশ গুণ ৭০ এর ওপর আবার গুণ হয় ৭০। অতএব সঙ্ঘবদ্ধ ভালো কাজ ভালো দানের গুরুত্ব এবং নেকির পরিমাণ আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন।
দানের মধ্যে যাকাত হচ্ছে ফরজ দান। তাই রমজানে যাকাত আদায় আরো সওয়াবের।
প্রিয় সুহৃদ! মনে রাখবেন যাকাত কিন্তু ঐচ্ছিক দান নয়। ফরজ দান। এটি ঈমান ও নামাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাকাত আদায় না করলে আপনার নামাজ নিষ্ফল। তাই প্রথম সুযোগেই যাকাত আদায় করুন। আল্লাহর কাছে দাতার তালিকায় নাম লেখান।
যাকাত না দেয়ার জন্যে হিসাবের ফাঁক-ফোকর বের করবেন না। আপনার সব খরচের পরে ৫৫ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকলেই আনন্দিতচিত্তে আড়াই শতাংশ হারে যাকাত আদায় করুন।
আর আপনার যাকাতের টাকা শরিয়ত সম্মতভাবে কাজে লাগানোর দায়িত্ব কোয়ান্টাম যাকাত ব্যবস্থাপনার ওপর অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারেন। ইনশাআল্লাহ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আপনার যাকাত সর্বোত্তম কাজে লাগাবে।
নবীজী (স) রমজান মাসে সবধরনের দান বাড়িয়ে দিতেন। তাই নবীজীর (স) সুন্নত হিসেবে এমাসে সবধরনের দানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। এতিম দুস্থ বিধবা প্রবীণের সেবার জন্যে প্রয়োজনীয় দান সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ুন। নবীজী (স) দুর্গত মানুষের কল্যাণে বেরিয়ে পড়াকে একমাস এতেকাফের চেয়েও উত্তম মনে করতেন।
এই প্রসঙ্গে তার বিখ্যাত হাদীস, তাবারানী শরীফে উদ্ধৃত ইবনে ওমর (রা) বর্ণিত হাদীস হচ্ছে-
একজন নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কী?
নবীজী জবাব দিলেন যার দ্বারা মানুষ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় সেই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়। আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে কোনো দুর্দশাগ্রস্তের দুর্দশা দূর করা। ঋণগ্রস্তকে ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করা ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবারণ করা।
এরপর নবীজী (স) বলেন, আর আমার কাছে কাউকে সাহায্য করার জন্যে তার সাথে হেঁটে যাওয়া মদিনার মসজিদে একমাস এতেকাফ করার চেয়েও বেশি কাঙ্ক্ষিত।
নবীজী (স)-এর এই কাঙ্ক্ষিত কাজটি সম্পন্ন করার জন্যে অর্থাৎ দুর্দশাগ্রস্তের দুর্দশা মোচনের কাজে দুর্গতদের সাহায্যে রমজানের বাকি কয়টি দিন যখনই সময় পান ঝাঁপিয়ে পড়ুন। দুর্দশা মোচনে কাজ করুন। এবং এটা নিঃসন্দেহে রমজানের সর্বোত্তম কাজের একটি এবং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সৎসঙ্ঘ গঠিত হওয়ায় আমরা এই কাজের সুযোগ অনায়াসে লাভ করেছি। এজন্যে আমরা পরম করুণাময়ের কাছে আবারও আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমরা জানি, রমজান জৈবিকতার আসক্তির শৃঙ্খলমুক্তির মাস, নিজের যত্ন নেয়ার মাস।
রমজানে করণীয়-বর্জনীয় নিয়ে আমরা ২৫ বছর ধরে আলোচনা করছি। আমাদের এই ব্যাপারে প্রচুর অডিও-ভিডিও রয়েছে। আমরা অনেক খারাপ জিনিস বর্জন করতে ও ভালো অভ্যাস অর্জন করতে শুরু করেছি।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এবারের রমজানে আমরা কোন আসক্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করব? আমাদের উত্তর খুব সহজ। বিষয়টি আমরা কোয়ান্টায়নে খতমে কোরআনের আখেরি দোয়ার যে আয়োজন সেই আয়োজনে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, এবারের রমজানে আমরা সাদা চিনির আসক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই।
কারণ গবেষকদের গবেষণা বলছে আর আমরাও এখন জানি, সাদা চিনি ক্যান্সার হৃদরোগ মেদস্থূলতা হার্ট এটাক স্ট্রোক ডায়াবেটিস তথা সকল অসংক্রামক ব্যাধির একটি প্রধান অনুঘটক। সাদা চিনি বা হোয়াইট সুগারের অপর নাম হচ্ছে হোয়াইট পয়জন। তাই আমরা আর জেনেশুনে বিষ পান করতে চাই না।
এ কারণে খাবারের ম্যানু থেকে সাদা চিনি এবং সাদা চিনি ব্যবহৃত খাবারগুলো পুরোপুরি বর্জন করুন। অসংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়ার এটি হবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
আমরা জানি, রমজানের কোন কাজে কত নেকি। নেকি সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু একটি ব্যাপারে সচেতনতার অভাবের কারণে আমাদের অনেকের রোজা নামাজ যে পুরোপুরি নষ্ট নিষ্ফল হয়ে যাচ্ছ, তা আমরা খেয়াল করি না।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, সেটা আবার কী? এককথায় এর উত্তর হচ্ছে গীবত বা পরনিন্দা। যখন আপনি কারো গীবত বা নিন্দা করেন তখন আপনার নামাজ ও রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তখন এই নামাজ ও রোজা কাজা আদায় করতে হয়।
আসলে আমরা অনেক সময় অসচেতনভাবেই কৌতুক করতে গিয়ে অনুপস্থিত ব্যক্তির চেহারা সুরত ওজন পোশাক বংশ ডিগ্রি যোগ্যতা দক্ষতা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করি। এই অনুপস্থিতিতে কারো নিন্দা করা কাউকে হেয় করা কাউকে ছোট করা এটাই হচ্ছে গীবত বা পরচর্চা পরনিন্দা।
নামাজ এবং রোজাকে নিষ্ফল এবং নষ্ট হতে না দেয়ার জন্যে আসুন সচেতনভাবে আমরা গীবত বা পরনিন্দা পরচর্চা থেকে বিরত থাকি। যত পরনিন্দা পরচর্চা থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন তত আপনার আত্মা দ্যুতিময় হবে আপনার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা বাড়বে।