১২ বছর ধরে (২০০৮-২০১৯) আমি কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছি। সেই শিশুবয়সে এখানে এসেছিলাম। জীবনের বড় ও মধুর একটা সময় আমি এখানেই পার করেছি। নানা আনন্দ-বেদনা জড়িয়ে আছে এর সাথে।
আমাকে দেখতে একটু চুপচাপ ধরনের মনে হয়। তবে পরিচিত পরিমণ্ডলে আমি হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করি। বন্ধুদের হাসাই। মজার একটা ঘটনা বলি। আমার দোষ বা গুণ দুটোই বলতে পারেন, আমি যে-কারো কণ্ঠ নকল করতে পারি। স্যার, ম্যাডাম, ব্রাদারদের কণ্ঠ নকল করে বন্ধুদের মজা দেখাতাম। বন্ধুরা আমার কাণ্ড দেখে হো-হো করে হাসত।
আমরা যে আবাসনে থাকতাম সেখানে ২০০ জন ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা ছিল। তিন তলাবিশিষ্ট খাট আমাদের। আমি মাঝের তলায় থাকতাম। যখন আবাসনে রাতে ঘুমানোর জন্যে ব্রাদার বাতি নিভিয়ে বেরিয়ে যেতেন, আমি চুপিসারে আমার বিছানা থেকে নামতাম। তারপর সেই ব্রাদারের মতো করে হাঁটতাম আর তার কণ্ঠ নকল করে বলতাম—অ্যাই সবাই ঘুমিয়ে যাও! বেশি দেরি করো না। ভোরে উঠতে হবে।
জুনিয়র-সিনিয়ররা রাতে আমার এই কাণ্ড বেশ উপভোগ করত। রাতে তো আর শব্দ করে হাসা যায় না। মিট মিট করে সবাই হাসত। আরো কত আনন্দ হাসির ঘটনা আছে। তবে শিক্ষক ও যত্নায়ন কর্মীদের আমি সম্মান করতাম। যদি মনের ভুলে কখনো তাদের সাথে বেয়াদবি করে ফেলি তাহলে তাদের কাছে এই অনুভূতি লেখার মাধ্যমে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
এছাড়াও আমার গল্পের বইয়ের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। এখনো আছে। বিশেষ করে গোয়েন্দা সিরিজ পড়তে ভালো লাগে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা আমার সবচেয়ে পছন্দ। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে আমি নিয়মিত বই নিয়ে পড়তাম। শার্লক হোমস পড়েছি বহুবার। এই বইগুলো পড়ার সময় নিজেকে আমি গল্পের নায়কের সাথে তুলনা করতাম। আর তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কী আনন্দের না ছিল সময়গুলো!
ছোটবেলা থেকে আমি ছবি আঁকতে পছন্দ করতাম। দশম শ্রেণিতে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা নিয়ে পড়ব। চারুকলায় অ্যাডমিশনের জন্যে যা যা পড়া লাগে তার খোঁজ করতে লাগলাম। ইন্টারনেট ব্যবহার করে খণ্ড খণ্ড তথ্য বের করে নিজের নোট নিজেই করতাম। বড় ভাইদেরও সাহায্য নিতাম।
এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। তারপর কলেজ শুরু হলো। একসময় এইচএসসি পরীক্ষা চলে এলো। কিন্তু সে-সময় সারাদেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। তাই জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়া হলো। আমার জেএসসি রেজাল্ট ভালো ছিল। কিন্তু এসএসসি-র তেমন ভালো না।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির পালা। করোনার কারণে আমরা বাইরে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আসলে একজন কোয়ান্টার পক্ষে হঠাৎ করে বাইরের জীবনের সাথে তাল মেলানোটা সহজ নয়। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। কী পড়ব না পড়ব কোনো গাইডলাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর আবার স্মার্টফোন নামক ভার্চুয়াল ভাইরাস তো আছেই। আসলে বাহিরের জীবনটা অনেক কঠিন। তবুও একটা বিশ্বাস নিয়ে লেগে থাকলাম। শুরু হলো আমার জীবনের সংগ্রামী সময়। কিন্তু এসময়ও আমাকে সাহায্য করল কোয়ান্টা জীবনের শিক্ষা।
বিশ্বাস ছিল আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। তাই চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। অটোসাজেশন চর্চা করতাম নিয়মিত। আর মেডিটেশন করতাম। আমার প্রিয় মেডিটেশন হলো ‘হও উন্নত শির’। এটি মূলত হীনম্মন্যতা দূর করার জন্যে। প্রতিটি মানুষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন রকমের হীনম্মন্যতা তাকে পিছিয়ে দেয়। তাই সুযোগ পেলেই আমি এই মেডিটেশন করি।
সে-বছর ৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলো। আম্মুকে জানালাম যে, পরীক্ষা ভালো হয়েছে। অপেক্ষা করছিলাম রেজাল্টের জন্যে। নভেম্বরের ১৪ তারিখে রেজাল্ট দেখলাম। শোকর আলহামদুলিল্লাহ! চারুকলায় আমি চান্স পেয়েছি।
কিন্তু আরেক সমস্যা দেখা দিল। প্রচলিত আছে চারুকলার ছাত্ররা বেপরোয়া হয়, পড়াশোনা কম করে! মানুষের মুখ থেকে এই কথা শুনে আমার আম্মু আমাকে এসে এসব বলেন। আমি বিশ্বাস করি, ভালো খারাপটা সবসময় নিজের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবজেক্ট দিয়ে ভালো খারাপ নির্বাচন করা যায় না। যা-হোক এখন আমার নতুন এক জীবন শুরু। পেছনে যা হয়েছে তাকে অতীতের গল্প বানিয়ে ভবিষ্যতের গল্পটাকে আরো সমৃদ্ধ করতে চাই। আরো যোগ্য হতে চাই।
অতীতের আরেকটি গল্প বলে আমার কথা এখানে শেষ করতে চাই। এটি আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি। কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের রুটিনগুলো আমার ভালো লাগত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যার যার ইভেন্টে অর্থাৎ খেলাধুলায় চলে যেতাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া। এরপর স্কুল-কলেজের পড়া। দুপুরের খাবার। তারপর আবার খেলাধুলা। সন্ধ্যার পর রিক্রিয়েশন ক্লাস। সবকিছুই একটা নিয়ম অনুযায়ী চলত।
আমার ইভেন্ট ছিল প্রথমে ভলিবল। কিন্তু ব্যান্ড প্রদর্শনী আমার পছন্দ ছিল। আমি গর্ব করে বলতে চাই, আমাদের স্কুলের প্যারেড ও ব্যান্ড টিম টানা পাঁচ বছর ধরে ঢাকায় গিয়ে জাতীয় শিশু-কিশোর কুচকাওয়াজে প্রথম হয়েছে।
স্বপ্ন দেখতাম আমাদের দলের আমি ব্যান্ড প্রধান হবো। কারণ ব্যান্ড প্রধান হাতে স্টিক নিয়ে নানা ভঙ্গি করে—এটা আমার খুব ভালো লাগত। আমিও লাঠি হাতে নিয়ে ওরকম করতাম পাশের জঙ্গলে গিয়ে, কেউ যেন না দেখে। বন্ধু আরমানকে সাথে নিতাম। ওকে দুষ্টুমির ছলে বলতাম, দেখিস আমি একদিন ব্যান্ড মেজর হবো! ও তখন হো-হো করে হাসত।
দশম শ্রেণিতে আমি ব্যান্ড টিমে যোগ দিলাম। প্রথমে আমি একজন স্রেফ ড্রামার ছিলাম। মন দিয়ে ড্রাম বাজাতাম। যার কারণে ২৬ মার্চের ঐ বর্ণাঢ্য আয়োজনে পাঁচ বার ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ছিল আমার জন্যে স্মরণীয় দিন। সেবার আমি ছিলাম ১৫০ সদস্য বিশিষ্ট ব্যান্ড টিমের প্রধান। প্রতিদিন দুইবেলা মেজর স্টিক হাতে নিয়ে অনুশীলন করতাম। হাতে ও পায়ে ফোসকা পড়েছে কত! হাতের কব্জির ব্যথা ছিল নিত্যসঙ্গী। আর প্রোগ্রামের তিন মাস আগে ক্যাম্পের সময়টা ছিল আরো কঠিন। খাওয়া ও ঘুমের সময়টা বাদে সারাদিন অনুশীলন। এত অনুশীলন, এত ঘাম এই সব কষ্টের অবসান ঘটেছিল সেই দিন। আমার হাতে মেজর স্টিক এবং আমার দলে ছিল ১৬ জন ক্লারিনেট, ৩২ জন ট্রাম্পেট, ৪০ জন ড্রামার, ৮ জন সেক্সোফোন, ৮ জন ইউফোনিয়াম, রাইফেলবাহী ১৬ জন, পতাকাবাহী ১৬ জন, ড্রাম মেজর ৮ জন। তাদের নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আগত হাজার হাজার দর্শকের সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই হাততালি দিচ্ছিল। ঐ মুহূর্তে আমার ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভূতি বয়ে যাচ্ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না।
আরো রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিল মন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নেয়ার সময়টা। মঞ্চে যখন কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের নামের সাথে আমার নাম ঘোষণা করল সেটা আমার জন্যে ছিল এক আনন্দঘন দম বন্ধ করা মুহূর্ত।
[ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘সব সম্ভব’ বই থেকে ]